একাধারে কবি ও প্রাবন্ধিক হলেও মহাদেবী বর্মা (১৯৭০-১৯৮৭) ছিলেন মূলত হিন্দি ছায়াবাদ যুগের অন্যতম শক্তিমান কবি। মূলত গীতিকবির প্রতিভাধর্মে সঞ্জীবিত ছিল তাঁর কবি প্রতিভা। বিশেষত প্রেমের কবিতায় তাঁর কৃতিত্ব এ ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ। পীড়াবাদ তথা দুঃখবাদের কবি হিসাবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। মহাদেবীর কাব্য নমনীয় এবং শিল্পরস সমৃদ্ধ। বিশুদ্ধ অনুভূতি ও বৌদ্ধিক কল্পনায় যেমন, তেমনই তীব্র ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ামলুক সূক্ষ্ম ও নাটকীয়তাযুক্ত কাব্য নির্মাণে মহাদেবীর শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত। তার কবি স্বরূপের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ

১। প্রেমের কবিতায় মহাদেবী ইন্দ্রিয়াশ্রিত বাস্তবতা ও অপার্থিব ভক্তিবাদের মিলন ঘটিয়েছে। ছায়াবাদী কবিত্বের বৈশিষ্ট্য মেনে তিনি যেমন ইন্দ্রিয়াশ্রিত প্রেমের উদাত্ত রূপের বর্ণনা দিয়েছেন তেমনি পৌরাণিক এবং আধ্যাত্মবাদমূলক কবিতা লিখেছেন।

২। মহাদেবী বর্মার কবি স্বরূপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল—সাংগীতিক মূর্ছণা যা মূলত গীতিকাব্যের সুরে ধ্বনিত। হৃদয়াবেগের সহজ উচ্ছ্বাসমাত্রে আবদ্ধ না থেকে তাঁর কবিতা রমণীর কলানির্মিতিরও তাৎপর্যপূর্ণ নিদর্শন।

৩। কাব্য স্বভাবে মহাদেবী মূলত বিরহাত্মক। অমূর্ত তথা কল্পিত বিষয় অবলম্বনের প্রতি অনুরাগ থেকে জাত বিরহ চেতনা ও বিষণ্ণতা তাঁর কাব্যকে স্বতন্ত্র করেছে।

৪। মহাদেবী বর্মার কবিতা দার্শনিকতা সম্পৃক্ত। সেখানে আবেগতপ্ত প্রেমের মানবীয় আকৃতির সঙ্গে মিশেছে মিষ্টিকতার তাত্ত্বিক দার্শনিকতা। 

৫। কল্যাণ ও মঙ্গল কামনায় সমৃদ্ধ মহাদেবীর কাব্য ফসল। কবির বিশ্বাস ছিল ব্যক্তিপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের সম্পৃক্তিকরণে চিহ্নিত হয় মঙ্গলময়তা। 

৬। মহাদেবীর কবিতা বিষাদক্রান্ত। জীবন ও জগৎকে তিনি বিষাদের আলোকে প্রত্যক্ষ করেছেন। সদর্থে রোমান্টিক বেদনার তীব্রতা বিরহ ও অতৃপ্তির যন্ত্রণা মহাদেবীর কবিচিত্তে সর্বদা বিরাজমান ছিল, যা তাঁকে ছায়াবাদের ‘মীরা’ নামে চিহ্নিত করেছে। এতসব বৈশিষ্ট্য জারিত তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল—

  • ১। নিহার (১৯৩০) ; 

  • ২। রশ্মি (১৯৩২); 

  • ৩। নীরজা (১৯৩৪); 

  • ৪। সন্ধ্যাগীত (১৯৩৬); 

  • ৫। যামা (১৯৩৯); 

  • ৬। দীপশিখা (১৯৪২) ; 

  • ৭। সন্দিনী (১৯৬৫); 

  • ৮। সপ্তকর্ণা অনুবাদ কাব্য (১৯৬০)।

মহাদেবী রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির পরিচয় এবার পর্যায়ক্রমে উন্মোচিত করা যেতে পারে। যথা—

নিহার : নিহার মহাদেবী বর্মার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হলেও এখানেই তাঁর কবি স্বভাবের সব ক-টি সম্ভাবনাই বীজাকারে প্রস্ফুটিত । গীতিধর্মিতা, রোমান্টিকতা, কল্যাণবাদিতা, বেদনা-বিরহ-বিষাদময়তা—এর সব ক-টি সুরই নিহারের নানা কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে। তবে নিহারের মূলীভূত বৈশিষ্ট্য হল কৌতূহল মিশ্রিত বেদনার সুর সঙ্গে আছে রোমান্টিকতা—

“নিশা কো ধো দেতা রাকেশ, চাঁদনি যে জব অলকে খোল,

কলি সে কহতা থা মধুমাস, বর্তা দে মধুমদিরা কা মোল।”

অর্থাৎ চন্দ্র কিরণ দিয়ে রাকেশ যখন নিশার অলকগুচ্ছ ধুয়ে দেয়/কলিকে বলে ‘বসন্ত’ বলে দাও তোমার মধুরিমার মূল্য। ধ্বংসের মধ্যেই যে নির্মাণের বীজ আছে আর বেদনার মধ্যে সুখানুভূতি সে কবি সত্য নিহারের নানা কবিতার উন্মেষিত।

রশ্মি : রশ্মি কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে মহাদেবী নিজেই বলেছেন—’রশ্মিতে এসে আমার অনুভূতির চাইতেও আমার চিন্তা-ভাবনা প্রধান হয়ে দেখা দিল।’—এ মন্তব্য জানিয়ে দিচ্ছে যে, এই কাব্য একই সঙ্গে মন-মনন ও তাত্ত্বিক দর্শনের সমন্বয়ে সম্পৃক্ত। সঙ্গে রয়েছে ছায়াবাদ সুলভ আধ্যাত্মচেতনাও। আছে জীবন মৃত্যুর ভাবনা সমন্বিত কাব্যরস প্রবাহও। এই কাব্যের নানা কবিতায় সৃষ্টি, প্রকৃতি, ঈশ্বর ও আত্মার অবিনশ্বরতা বিষয় হিসাবে উপস্থিত। সৃষ্টি সম্পর্কে তাঁর ভাবনা—ঈশ্বর নিজ অসম্পূর্ণতাকে দূর করার জন্যই সৃষ্টির অবতারণায় মগ্ন—

হুয়া জ্যো সুনেপন কা ভান, প্রথম কিসকে ওর সে অম্মান? 

আউর কিস শিল্পী নে অঞ্জান, বিশ্ব প্রতিম কর দি নির্মাণ?

অর্থাৎ এই যে শূন্যতার ভান, প্রথমে কার হৃদয় হল অম্লান?/আর কে সেই শিল্পী অপরিচিত, বিশ্ব প্রতিম করেছে যে নির্মাণ? অন্য একটি কবিতায় জীবন মৃত্যুর পরিপূরক সম্পর্ক ও অবিনশ্বরতার ভাব জীবন্তু—‘অমরতা হ্যায় জীবনকা হ্রাস/মৃত্যু জীবন কা চরম বিকাশ। তবে মহাদেবীর স্বকীয় বেদনা বোধের প্রকাশ রশ্মির বেশ কিছু কবিতাকে অনন্য করেছে। যেমন—মেরে ছোটে সে জীবন যে, দেনা ন তৃপ্তি কা কণ ভর/বহনে দো প্যাসি আগে ভরতি আঁসুকে সাগর । অর্থাৎ ‘আমার এ ক্ষুদ্র জীবনে, দিও না ভরে তৃপ্তি কণা/রইতে দাও তৃষ্মার্ত নয়নে, ভরে অশ্রু সাগর।

নিরজা : তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নিরজা’তেই মহাদেবী বর্মার কাব্যপ্রতিভার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে। প্রেম ভাবনা ও আধ্যাত্মানুভূতির অনন্য মেলবন্ধনে এ কাব্যের বেশিরভাগ কবিতা রসসিক্ত। প্রেমের অনুভব অনির্বচনীয় তন্ময়তা পেয়েছে। প্রেম এখানে শরীরী স্থূলতাকে ছেড়ে তত্ত্বময়তার পরিচ্ছদে আবৃত হয়েছে, পরবর্তী স্তরে তা কল্পনার ডানায় ভর করে মিস্টিক রহস্য চেতনায় উত্তরিত। সুখ-দুঃখের সামঞ্জস্য বোধ, ধ্বংসের নির্মাণের মধ্যে গঠনের সম্ভাবনা, বেদনা মধ্যে আনন্দের উদ্ভাসন নিরজার কবিতাগুলিকে স্বতন্ত্র করেছে। অশ্রু থেকে আনন্দাশ্রুতে গতাগতি এখানে নিরজার পরম কাম্য। অশ্রুকে যারা অভিশাপ ভাবে—তাদের দলে থাকতে চান না কবি—

‘জল না হি প্রকাশ হ্যায়, ওসমে সুখ 

বুঝনা হি তম হ্যায়, তম মে দুধ 

তুঝমেঁ চির দুখ, মুঝমেঁ চির সুখ 

ক্যায়সে হোগা প্যার। 

পাগল সংসার।

অর্থাৎ জ্বলতে থাকাই প্রকাশ, তাই দহনেই সুখ/নিভে যাওয়াই অন্ধকার, তাই অন্ধকারেই দুখ/তোমাতে চির দুখ, আমাতে চির সুখ/কেমনে হবে এ প্রেম/পাগল সংসার।

নিরজা কাব্যের সিদ্ধি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রখ্যাত হিন্দি-চিন্তাবিদ ড. বিজয়েন্দ্র স্নাতক বলেছেন—’মহাদেবী বর্মার রচনাগুলির মধ্যে নিরজার স্থান অনেক দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ ……. আনন্দ এবং উল্লাসের স্নিগ্ধ প্রকাশ কবির অন্তরে নিরজা রূপে বিকশিত হতে পেরে তাঁকে আনন্দময় পরিবেশে বিচরণ করার নিরন্তর প্রেরণা দান করেছে।

সান্ধ্যগীত : সান্ধ্যগীত মহাদেবী পরিণতির ধারাক্রম স্পষ্ট। এখানে ধ্বংস-নির্মাণ, মিলন-বিরহ, আশা-নিরাশা, বন্ধন-মুক্তি ইত্যাদি বৈপরীত্য মূলক ভাবনালোক শেষাবধি কল্যাণ ও গঠনময়তায় উত্তরিত। চিত্ররূপময়তা সান্ধ্যগীতের বড়ো গুণ। একই সঙ্গে পুলক, অব্যক্ত বেদনা ও অতৃপ্তিজনিত বিবাদ সমন্বিত হয়ে মহাদেবীর মানসলোকের সামঞ্জসকে এখানে প্রকাশিত করেছে। বেদনা ও দুঃখ এখানে শান্ত কোমল রূপে উন্মেষিত।

দীপশিখা : মহাদেবীর পঞ্চম কাব্য দীপশিখা। একাব্য আশাবাদের কাব্য। দুঃখ দহনের স্তর পেরিয়ে, বিষাদপূর্ণ হতাশার পরিবর্তে এখানে আশার বাণী উচ্চারিত নিজেকে নিঃশেষিত করে অন্যের আশার শিখা প্রজ্বলনের মানসিকতাই দীপশিখার মূল সুর :

সব বুঝে দীপক জলা লু

ঘির রহা হম আজ দীপক

রাগিনী অপনি জগা লু

অর্থাৎ সমস্ত নিভে যাওয়া দীপ আজ জ্বালিয়ে দেব/ঘিরছে আজ অন্ধকারকে দীপ/রাগিণী এক জাগিয়ে যাব।

এই পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ কবির মৌলিক গ্রন্থ। আর যামা ও সন্ধিনী মাত্র। নিহার, রশ্মি, নিরজা এবং সান্ধ্যগীতের সব ক-টি কবিতা সংকলিত। সন্ধিনীতে প্রেম, প্রকৃতি, বেদনা, আধ্যাত্মবাদ, সমর্পণ ও মৃত্যুবিষয়ক নির্বাচিত কবিতা সংকলিত।

সপ্তপর্ণ : সপ্তপর্ণ অনুবাদগ্রন্থ। আর্যবাণী, বাল্মীকি, গোরগাথা, অশ্বঘোষ কালিদাস, ভবভূতি এবং জয়দেবের মতো কবিদের ৩৯টি কাব্য খণ্ডের অনুবাদ সপ্তপর্ণতে আছে। অনুবাদে কবি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

সব মিলিয়ে বলতে হয় ছায়াবাদ যুগের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে মহাদেবী বর্মার কবিতাগুলি হিন্দি কাব্য সাহিত্যের অনন্য সম্পদ।