চৈতন্য পরবর্তী যুগের একজন বিখ্যাত পদকর্তা গোবিন্দদাস কবিরাজ। ষোড়শ শতকের চতুর্থ দশকের মধ্যে বর্ধমান জেলার শ্রীখণ্ডে বৈদ্যবংশে তাঁর জন্ম। তিনি প্রথমে শাক্ত ছিলেন পরে শ্রীনিবাস আচার্য্যের কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। গোবিন্দদাসকে নিয়ে নানা সমস্যা আছে। ষোড়শ শতাব্দীতে অন্তত পক্ষে চারজন গোবিন্দের সন্ধান মেলে। গোবিন্দ ঘোষ এবং গোবিন্দদাস ছিলেন চৈতন্যদেবের পরিষদ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এনারা পদকর্তা। গোবিন্দদাস চক্রবর্তী নামক কবিও বহুপদ রচনা করেছিলেন। শ্রেষ্ঠ এবং চতুর্থ পদকর্তা হলেন গোবিন্দদাস কবিরাজ। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, গোবিন্দদাসের পদগুলি ব্রজবুলি ভাষাতে রচিত। কিন্তু তিনি বাংলা ভাষায় কোনও পদরচনা করেছিলেন কিনা সন্দেহ আছে। আনুমাণিক ১৬১৩ খ্রীঃ তিনি দেহত্যাগ করেন।
কবি প্রতিভা : জ্ঞানদাসকে যেমন চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য বলা হয়, তেমনি গোবিন্দদাসকেও বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বলে বিবেচনা করা হয়। বিদ্যাপতির পদের সঙ্গে গোবিন্দদাসের পদের ভাবসাদৃশ্য ও রূপসাদৃশ্য লক্ষ্য করলে তাঁকে ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ আখ্যায় ভূষিত করা তাৎপর্য উপলব্ধ হয়। গোবিন্দদাস রচিত অন্তত নয়টি পদের ভণিতায় বিদ্যাপতির নাম পাওয়া যায়। রাধামোহনঠাকুর অনুমান করেছিলেন— গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির অসম্পূর্ণ পদগুলি সম্পূর্ণ করে তাতে যুগ্ম ভূমিকা ব্যবহার করেছেন। কেউ কেউ অনুমান করেন গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির ত্রিচরণ পদের চতুর্থ পদ পুরণ করেছেন-
‘বিদ্যাপতি কহ নিদারুণ মাধব
গোবিন্দদাস রসপুর।
গোবিন্দদাসের ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা অবিমিশ্র। অনেকের মতে এতে বাংলাভাষার মিশ্রণ ঘটেনি। তদ্ভব শব্দ কম থাকলেও অধিকাংশ শব্দই তৎসম বা অর্ধতৎসম। পদগুলির আগাগোড়া বিশ্লেষণ করলে গোবিন্দদাসকে যে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দান করা হয়েছে তা অসঙ্গত মন হয় না।
ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার প্রয়োগে বিদ্যাপতির সার্থক উত্তরসুরী গোবিন্দদাস। তাঁর রচনার প্রধান গুণ শ্রুতির মাধুর্য—
“বসনারোচন শ্রবণ-বিলাস ।
রচই রুচির পদ গোবিন্দদাস।।”
এপ্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেন মন্তব্য করেছেন—“ইহার লেখায় ছন্দের বৈচিত্র্য যথেষ্ট আছে। অনুপ্রাসের ও উপমা রূপকাদির অর্থালঙ্কারের প্রয়োগ কবিরাজের মতো আর কোনো পদকর্তাই করিতে পারেন নাই। শব্দের ঝঙ্কারে এবং পদের লালিত্যে গোবিন্দদাস কবিরাজের গীতিকবিতাগুলি বাংলা সাহিত্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।”
গোবিন্দদাস ছিলেন সৌন্দর্যরসিক কবি। তাঁর রাধিকাকে তিনি তিলতিল করে সৌন্দর্যের সমারোহে তিলোত্তমা করে তুলেছেন। গোবিন্দদাসের রচনার একটি বড়োগুণ হল সঙ্গীতময়তা৷ এখানে তিনি বিদ্যাপতির ভাব শিষ্য নন, বৈষ্ণব কবিতার আদি পুরুষ জয়দেব গোস্বামীর কাছে থেকে যেন সুরের মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করেছেন। গোবিন্দদাসের রচনার আর একটি বিশেষগুণ— নাটকীয়তা ও চিত্রধর্মিতা। এই সমস্ত জ্ঞানাবলীর কারণে গোবিন্দদাসের পদগুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ এবং এরজন্য তাঁকে উচ্চস্থান দেওয়া হয়ে থাকে।
গোবিন্দদাস কৃষ্ণলীলার নানা পর্যায়ের পদ রচনা করেছেন, তারমধ্যে গৌরচন্দ্রিকা, রূপানুরাগ এবং অভিসারের পদগুলি রচনাকরে বেশী খ্যাতিনাম হয়েছেন।
গৌরচন্দ্রিকা : মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের দর্শন হতে বঞ্চিত ছিলেন গোবিন্দদাস। তিনি সম্ভবত তাঁর সমগ্র অন্তর দিয়ে গৌরাঙ্গের স্বরূপকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন। তার ফল হিসাবে বোধ হয় ‘গৌরচন্দ্রিকা’ পদের সৃষ্টি। এই পদরচনায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব অপরিসীম। মহাপ্রভুর রাধার মধ্যেই তিনি মহাপ্রভুর জীবন্ত রূপ লক্ষ করেছেন—
“অভিনব হেম কলুতরু সঞ্চরু
সুরধনী তীরে উজোর।।
গৌরাঙ্গের এ দিব্যোন্মাদ গৌরবোজ্জ্বল জীবন্ত রূপসৃষ্টির ‘প্রেমানুভূতির’ স্বরূপটি ও প্রকাশ করেছেন।—
‘পতিত হেরিয়া কাঁদে স্থির নাহি বাঁধে
করুণ নয়নে চায়।
এইজন্যই হয়ত সমালোচকগণ মনে করে—“গৌরচন্দ্রকে অগণিত মানুষ ভজনা করেছে কিন্তু চন্দ্রিকাটুকু একমাত্র প্রতিফলিত করতে পেরেছেন পরম ভক্ত কবিরাজ গোবিন্দদাস।”
রূপানুরাগ : শিল্পচাতুর্য এবং আন্তরিকতার গভীর প্রকাশ ঘটেছে গোবিন্দদাসের রূপানুরাগের পদগুলিতে। কবি তাঁর উপাস্য দেবতাকে অন্তরে ঠাঁই দিয়েছেন তাতে লীন হয়ে গেছেন কিন্তু আত্মহারা হননি। রূপানুরাগের পদগুলি গোবিন্দদাসের লিপিচাতুর্য, ছন্দোবৈচিত্র্য, শব্দৈশ্বর্য প্রভৃতি উৎকর্ষতা লাভ করেছে—
“ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি
অবনী বাহিয়া যায়।
হাসিয়া হাসিয়া অঙ্গ দোলাইয়া
নাচিয়া নাচিয়া যায়।”
অভিসার : অভিসার পদগুলির রচনা করে সর্বাধিক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন গোবিন্দদাস৷ কবিতাটিতে রাধিকার কৃচ্ছসাধনা প্রচেষ্টার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা যেন অক্ষরে অক্ষরে ক্ষরিত হচ্ছে—
“মন্দির বাহির কঠিন কপাট।
চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।”
পদটিতে রাধিকার অভিসারের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাতে ভক্ত হৃদয়ের আকৃতি রূপায়িত হয়ে উঠেছে।
অতএব বৈষ্ণব পদ রচনায় গোবিন্দদাসের অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া গেলেও মান-বিরহ পদে তাঁর ব্যর্থতার পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। তা সত্ত্বেও গোবিন্দদাসের রচনা কৌশল, শিল্প-চাতুর্থ, বাভঙ্গিমা, অলংকার-ছন্দের ঘনঘটা, সুরের মূর্ছনা, অপরিসীম রসোবোধ ও তীক্ষ্ণ শিল্প দৃষ্টি শ্রেষ্ঠ পদকর্তার মর্যাদা মর্যাদা দিয়েছে। গোবিন্দ দাস শ্রীরাধাগোবিন্দের লীলা বর্ণনা করেছেন প্রত্যক্ষ দর্শকের ন্যায়। তাই তাঁকে মহাজন পদমর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে।
Leave a comment