Image by Wisilife |
১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল, ভস্টক-১ নামের একটি মহাকাশযান এক নতুন ইতিহাসের জন্ম দেয়। মহাকাশযান টি সোভিয়েত মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিনকে নিয়ে পৃথিবীর চারপাশে সফলভাবে একবার প্রদক্ষিণ করে আসে। পৃথিবী সেদিন সাক্ষী হয় মানব ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়ের।
এরপর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মহাকাশচারী মহাকাশ ভ্রমণে গিয়েছে। বিভিন্ন মিশন সহ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়তই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মহাকাশযান পাঠানো হচ্ছে নভোচারীদের।
তবে যাই হোক না কেন, মহাশূন্য ভ্রমণ নিঃসন্দেহে একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। শুধু তাই নয়, প্রতিনিয়ত মহাকাশচারীদের অসংখ্য নতুন ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। কিংবা এমন ভাবে জীবনযাপন করতে হয় যা পৃথিবীর তুলনায় অনেকটাই আলাদা।
আজ আমরা এমনই কিছু ঘটনা সম্পর্কে জানব। তো চলুন তাহলে দেখে নেওয়া যাক নভোচারীদের সম্পর্কে ১৫ টি মজার এবং অবাক করা তথ্য।
১। নভোচারীরা ডায়াপার পরে থাকেন।
নভোচারীদের ব্যবহৃত এই ডায়াপারের অবশ্য কেতাবি নাম “Maximum Absorbency Garment”। তবে এর কাজ ডায়াপারের চেয়ে কোন অংশে ভিন্ন নয়। অনেকসময় অভিযানে বিলম্বের কথা মাথায় রেখে এমন ব্যবস্থা রাখা হয় যেন প্রয়োজন হলে নভোচারী কে তার পুরো স্যুট টি খুলতে না হয়।
২। “Astronaut” শব্দটি গ্রীক শব্দ “অ্যাস্ট্রোন নটস” থেকে এসেছে।
“Astronaut” শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হল নভোচারী। আর ইংরেজি এই শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ “অ্যাস্ট্রোন নটস” থেকে , যার অর্থ দাঁড়ায় “তারকা নাবিক”।
৩। নভোচারীদের রুশ ভাষা শিখতে হয়।
কোন নভোচারীকে যদি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকতে হয় তাহলে তাকে রাশিয়ান ম্যানুয়াল পড়তে বা তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে রুশ ভাষা শিখতে হয়।
৪। নভোচারীরা প্রতিদিন প্রায় ২ ঘণ্টা ব্যায়াম করে থাকেন।
মহাশূন্য ভ্রমণে নভোচারীকে হাড় ও পেশীর ক্ষয় রোধে সচেতন থাকতে হয়। যে জন্য নভোচারীরা প্রতিদিন প্রায় দুই ঘণ্টা করে ব্যায়াম করে থাকেন। তবে সেজন্য সাধারণ ব্যায়াম যন্ত্রপাতির বদলে মহাশূন্যের জন্য বানানো বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যাবহার করা হয়ে থাকে
৫। মহাশূন্যে নভোচারীদের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়।
মাইক্রোগ্র্যাভিটি তে থাকার কারণে নভোচারীদের উচ্চতা ৩% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। দীর্ঘদিন মহাশূন্যে থাকার কারণে এমন হয়। কারণ এ ক্ষেত্রে শরীরের উল্লম্ব দিকে প্রতিনিয়ত কোন বল কাজ করে না যা পৃথিবীতে থাকাকালীন অভিকর্ষ বল করে থাকে। ফলে শরীরের সংযোগ গুলো সামান্য প্রসারিত হয় এবং শরীরের উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়। তবে পৃথিবীতে ফিরে আসলে কয়েকমাসের মধ্যে নভোচারীদের এ বাড়তি উচ্চতা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
৬। চাঁদে নভোচারী ও তার পরিবারের ছবি।
অ্যাপোলো 16 নভোচারী চার্লস ডিউক তাঁর স্ত্রী এবং তাদের দুই ছেলের একটি ছবি চাঁদে রেখে এসেছিলেন। তিনি ছবিটির পেছনে স্বাক্ষর করেছিলেন এবং লিখেছিলেন যে, “এটি পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে আসা নভোচারী ডিউকের পরিবার। চাঁদে অবতরণের সময় ১৯৭২ সালের এপ্রিল।” ছবিটি এখনো অক্ষত আছে।
৭। নভোচারীদের টয়লেট ব্যাবহার এর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
স্পেস শিপ এর টয়লেট করার ব্যবস্থা মোটেও আমাদের চিরাচরিত বাসাবাড়ির মত না। এই টয়লেটগুলো মূলত ভ্যাকুয়ামের সাথে সংযুক্ত একটি পাইপ থাকে যা মূত্রত্যাগের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং ভ্যাকুয়ামের সাথে একটি সংযুক্ত ঝুড়ি থাকে যা মলত্যাগের জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, নভোচারীদের এই প্রশিক্ষণের সময় নিচের দিকে একটি ক্যামেরা যুক্ত করা থাকে যা দিয়ে নিরীক্ষা করা হয় যে তারা সঠিক-স্থানে বসছে কি না।
৮। মহিলা নভোচারীদের তুলনায় পুরুষ নভোচারীর সংখ্যা বেশি।
না, কোন লিঙ্গ বৈষম্যতার জন্য এমনটা করা হয় নি। এর কারণ পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মহাশূন্য রেডিয়েশনের ‘Threshold Exposure’ কম, তাই এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মহিলাদের জন্য স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে পরিণত হয়। নাসার বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাশূন্য বিকিরণের দীর্ঘস্থায়ী এক্সপোজার, সেটি কোন গ্রহের পৃষ্ঠেই হোক কিংবা গভীর মহাশূন্যে হোক, ক্যান্সারের মতো রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
৯। মহাশূন্যযানে নভোচারীদের অদ্ভুত ঘুম ঘুমাতে হয়।
মহাকাশে বসবাসের অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো ঘুমও অদ্ভুত। আমরা জানি যে মহাকাশযানে খুব কম মাধ্যাকর্ষণ রয়েছে, এটি “মাইক্রোগ্রাভিটি” নামেও পরিচিত। এই কারণে আমরা নভোচারী এবং মহাকাশযানে বিভিন্ন বস্তুর চারদিকে ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য দেখে থাকি। নিশ্চয়ই ঘুমানোর সময় এমন ভেসে বেড়ানো টা মোটেও নিরাপদ হবে না। তাই নভোচারীদের ঘুমানোর জন্য বিশেষ স্লিপিং ব্যাগ রয়েছে যা প্রত্যেকের নির্ধারিত স্থানে দেয়ালের সাথে সংযুক্ত করা যায় যাতে ঘুমন্ত অবস্থায় কোন নভোচারীকে ঘুরে বেড়াতে না হয় এবং কোন দুর্ঘটনা না ঘটাতে হয়।
১০। মহাকাশ ভ্রমণে অনেকদিন থাকলে সাময়িক অন্ধত্ব তৈরি হতে পারে।
Phys.org এর ২০১৬ সালের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নভোচারী আইএসএস এ কয়েক মাস কাটানোর পরে তাদের চোখের সমস্যা নিয়ে রিপোর্ট করেছেন। নাসার মতে, এমন অবস্থার লক্ষণসমূহ Space-Associated Neuro-Ocular Syndrome (SANS) নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে এবং প্রায় ৭০% সদস্যদের মধ্যে এ সমস্যা দেখা যায়। তাহলে SANS এর কারণ কী? নাসার মতে, এটি এখনও ঠিক পরিষ্কার নয়, তবে গবেষণার ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি কারণ পাওয়া যায়। যেমনঃ মস্তিস্কে অতিরিক্ত চাপ, রক্তনালীগুলির অতিরিক্ত পূর্ণতা, প্রদাহ, কার্বন ডাই অক্সাইডের উচ্চ স্তর, বিকিরণ, জিনেটিক্স এবং ভিটামিন বি এর অবস্থা। গবেষকরা আরও বিশ্বাস করেন যে মহাকাশ ভ্রমণে একজন মানুষ কতটা সময় ব্যয় হয়েছে তার উপরও এই বিষয়টি নির্ভর করে।
১১। মহাকাশ ভ্রমণে নভোচারীদের যৌন মিলন সম্পূর্ন নিষেধ।
প্রশ্নটি ওঠে যখন ২০১০ সালের একটি মিশনে মহিলাদের সংখ্যা এক থেকে চারগুণ করে চার পুরুষ এবং চারজন নারীকে পাঠানো হয়। আবার প্রথম বিবাহিত দম্পতি হিসেবে ১৯৯১ সালে মহাকাশে গিয়েছিলেন জ্যান ডেভিস এবং মার্ক লি। দু’জনই মিশনের সময় তাদের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেছেন। নাসা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে যে কেউ যদি কখনও মহাকাশে যৌনমিলন করেও থাকে, সে সম্পর্কে নাসা কিছুই জানে না।
১২। নভোচারীরা পৃথিবীতে ফিরে এসে গ্র্যাভিটি বিভ্রান্তিতে পড়ে।
মহাশূন্যে নভোচারীরা মাইক্রোগ্র্যাভিটি তে কাজ করে অভ্যস্ত। ফলে যে কোন জিনিস রাখতে হলে তারা কোন নির্দিষ্ট স্থানে সেটি রাখার চেয়ে বস্তুটি ছেড়ে দেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আর বস্তুগুলি সাধারণত শীপের ভেতর ভাসতে থাকে। কিন্তু সমস্যাটি বাধে যখন নভোচারীরা ফিরে আসেন। ফিরে আসার পর স্পেস শীপের মত করে তারা বিভিন্ন বস্তু ব্যাবহারের পর অভায়সবশত বাতাসে ছেড়ে দেয়। কিন্তু পৃথিবীতে তো আর মাইক্রোগ্রাভিটি থাকে না। ফলে অভিকর্ষের নিয়ে সেটি ভূপাতিত হয়।
১৩। মহাকাশ ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর নভোচারীরা সাময়িকভাবে চলাচলে অক্ষম হয়ে পরে।
দীর্ঘদিন মহাশূন্য ভ্রমণে নভোচারীদের অনেকটা সময় মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে থাকতে হয়। এই পরিবেশে তাদের চলাচলের জন্য পায়ের কোন ব্যাবহার করতে হয় না। কারণ তারা মহাকাশযানের ভেতর ভেসে ভেসে বেড়ায়। এই অবস্থায় বেশিদিন থাকলে নভোচারীদের পায়ের কার্যকারিতা কমে যেতে থাকে। ফলে পৃথিবীতে ল্যান্ডিং করার পর থেকে কয়েকমাস পর্যন্ত তাদের পায়ের উপর ভর করে চলাচলে অক্ষমতা প্রকাশ পায়।
১৪। প্রথম মহাশূন্যে হাঁটেন রাশিয়ার মহাকাশচারী আলেক্সি লিওনভ
যখনই কোনও মহাকাশচারী মহাশূন্যে থাকার সময় মহাকাশযান থেকে নামেন তখন তাকে স্পেসওয়াক বা EVA বলা হয়। 1965 সালের 18 মার্চ প্রথম স্পেসওয়াক করেন রাশিয়ার মহাকাশচারী আলেক্সি লিওনভ যা ১০ মিনিটের জন্য স্থায়ী হয়েছিল।
১৫। মহাশূন্যে গোসল করতে হলে ব্যাবহার করতে হয় বিশেষায়িত শাওয়ার।
যেহেতু পানি প্রবাহের জন্য মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রয়োজন, তাই মহাকাশযানের শাওয়ারগুলি কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে। পানির চারদিকে ছড়িয়ে পড়া রুখতে নভোচারীরা একটি সিলিন্ডার আকৃতির বদ্ধ শাওয়ার এর ভেতর গোসল করে থাকেন। এসময় শরীর ধৌত করার জন্য তারা একটি পানির স্প্রে ব্যাবহার করে এবং একটি ভ্যাকুয়ামের সাহায্যে তাদের শরীরে থাকে পানি শোষণ করার মাধ্যমে গা শুকান।
কমেন্ট বক্সে লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানান |
References:
Leave a comment