দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়ণী কথা’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-“মোটামুটি কাব্যকে দুই ভাগ করা যাক। কোন কাব্য বা একলা কবির কথা, কোন বা বৃহৎ সম্প্রদায়ের কথা…… তেমনি আর এক শ্রেণির কবি আছে যাহারা রচনার ভিতর দিয়া একটি সমগ্রদেশ, একটি সমগ্র যুগ, আপনার হৃদয়কে, আপনার অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করিয়া তাহাকে মানবের চিরন্তন সামগ্রী করিয়া তোলে।
এই দ্বিতীয় শ্রেণির কবিকে মহাকবি বলা যায়। মহাকাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই মস্তব্যই যথেষ্ট। কাব্যসাহিত্যে মহাকাব্য একটি প্রাচীন শাখা। মহাবৃক্ষের মতো একটা দেশ, জাতিকে ছায়া দান করে। সে অর্থে পৃথিবীতে প্রাচীন মহাকাব্য বলতে ইউরোপে হোমারের লেখা ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডেসি’ এবং ভারতবর্ষের ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’। গ্রীস দেশের অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডি প্রসঙ্গে মহাকাব্যের সঙ্গে তুলনায় মহাকাব্যের কিছু লক্ষণের কথা বলেছেন আবার সাহিত্য দর্পণকার বিশ্বনাথও এদেশে মহাকাব্যের বেশ কিছু লক্ষণের নির্দেশ দেন। কিন্তু আধুনিক কালেও কিছু মহাকাব্য রচিত হয়েছে। এই আধুনিক মহাকাব্যগুলি ভারতীয় অলংকার শাস্ত্র কিংবা অ্যারিস্টটলের আলোচনা সঙ্গে হুবহু মেলে না। কিন্তু আধুনিক জীবনভাবনার প্রতিফলনে সেগুলির ব্যাপ্তিও মহাকাব্যের মতো। তাই মহাকাব্যের স্পষ্টতঃই দুই শ্রেণি-প্রাচীন মহাকাব্য বা Old Epic এবং আধুনিক মহাকাব্য বা সাহিত্যিক মহাকাব্য Literary Epic । মহাকাব্যের লক্ষণগুলি সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের মন্তব্য—
- (i) (It is) an imitation of serious subjects in a grand kind of version narrative form.
- (ii) (It) should be based on a single action, one that is a Complete whole in itself, with a beginning middle and end, so as to enable the work to produce its own proper pleasure with all the organic unity of a living Creature.
- (iii) As for its metre the heroic has been assigned it from experience.”
অর্থাৎ মহাকাব্যও হবে গভীর বিষয়ে নিয়ে রচিত। তন্ময় ভঙ্গিতে লেখা। ট্র্যাজেডির মতো মূল আখ্যান থাকবে একটি, এবং তা আদি মধ্য ও অস্ত বিশিষ্ট সম্পূর্ণ। কিন্তু উপাখ্যান থাকবে বেশি। আর মহাকাব্য রচিত হবে ঐশ্বর্যবান রাজসিক ও গুণসম্পন্ন ভাষায় হিরোটিক মিটার ছন্দে।
‘সাহিত্যদর্পণ’ কার—বিশ্বনাথ মহাকাব্যের লক্ষণ নির্দেশ করেছেন—
(১) মহাকাব্য সর্গবিভক্ত হবে। কমপক্ষে নয়টি এবং বেশি হলে ত্রিশটি সর্গ থাকবে।
(২) প্রতিটি সর্গের নামকরণ থাকবে। একটি সর্গের শেষে পরবর্তী সর্গের সূচনা থাকবে। বিভিন্ন সর্গ একই ছন্দে লেখা হলেও সর্গশেষে ছন্দ বৈচিত্র্য থাকবে।
(৩) মহাকাব্যের আরম্ভে আর্শীবাদ, নমস্কার বা বস্তু নির্দেশ থাকবে।
(৪) সত্য ঘটনা বা ঐতিহাসিক কাহিনি মহাকাব্যের উপজীব্য হবে। অবশ্য দণ্ডী পুরাণের কথা বলেছেন। হোমার বলেছেন মহাকাব্যের বিষয় হল, বীর পুরুষের কথা।
(৫) মহাকাব্যের নায়ক হবে দেবতা বা সদ্বংশজাত ধীরোদাত্ত ক্ষত্রিয়।
(৬) মহাকাব্যে সূর্য, চন্দ্ৰ, সাগর, রজনী, প্রদোষ, প্রভাত, মৃগয়া, বন, পর্বত, জলক্রীড়া, বিবাহ, সম্ভোগ, বিরহ, যুদ্ধ, প্রভৃতির বর্ণনা থাকবে।
(৭) শৃঙ্গার, বীর ও শান্তরসের কোন একটা হবে মহাকাব্যের অঙ্গীরস, অন্যরসগুলির মূল রসের সহায়ক হবে।
(৮) কবিবৃত্তান্ত নায়ক অথবা কারুর নামে মহাকাব্যের নামকরণ হবে।
মহাকাব্যের এই লক্ষণগুলি থেকে এই কাব্যের যে রূপ গড়ে ওঠে প্রাচীন মহাকাব্য গুলিতে লক্ষণগুলি স্পষ্ট হলেও আধুনিক সাহিত্যিক মহাকাব্যে এর সবগুলিকে পাওয়া সম্ভব নয়।
বাংলা সাহিত্যের একমাত্র শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য অবশ্যই মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’। হেমচন্দ্র বা নবীনচন্দ্রের রচনায় মহাকাব্যের প্রয়াস থাকলেও সার্থক মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য। প্রাচীন মহাকাব্য থেকে আধুনিক মহাকাব্যের কিছু সাদৃশ্য আছে। প্রাচীন মহাকাব্য থেকে আধুনিক মহাকাব্যের উপাদান সংগ্রহ করা হয়। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের উপাদান নেওয়া হয়েছে রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডের রাম-রাবণের যুদ্ধ অংশ থেকে। ‘মেঘনাদবধ’ নয়টি সর্গে সমাপ্ত। প্রতিসর্গ স্বতন্ত্র নামকরণ চিহ্নিত। এই কাব্য ভিন্ন মানসিকতায় রচিত।
রামায়ণের মূল প্রতিপাদ্য পাপের পরাজয় ধর্মের জয় আর মেঘনাদবধের মূল বিষয় স্বাদেশিকতা। আধুনিক জীবনবোধে রামচন্দ্র বা লক্ষ্মণ বা দেবতারা নয়, রাবণ ও মেঘনাদের মত প্রকৃত বীরই এই কাব্যের নায়ক। কাব্যের নামকরণ করা হয়েছে প্রকৃতবীর নায়ক মেঘনাদের নাম অনুসারে। বীর ও করুণ এই দুটি রস মেঘনাদবধে প্রাধান্য পেয়েছে।
মহাকাব্যের সূচনায় সরস্বতী বন্দনা ও বস্তুনির্দেশ দেওয়া আছে। প্রাচীন মহাকাব্যের কবিকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা না গেলেও আধুনিক মহাকাব্য হিসেবে ‘মেঘনাদবধ’ ব্যক্তি চিহ্নিত মহাকাব্য। বস্তুত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মহাকাব্য, মধুসূদনই একমাত্র মহাকবি।
Leave a comment