মহাকাব্যের যুগের শিক্ষাকে আদি বৈদিক শিক্ষারই পরিপােষক বলা যায়। এই শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল一

(১) লক্ষ্য: মহাকাব্যের যুগের শিক্ষার লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের মানসিক শক্তির বিকাশ, আত্মসক্রিয়তার অনুশীলন, জীবনবিকাশের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও পবিত্রতা রক্ষা এবং সুপ্ত প্রতিভার যথাযথ বিকাশে সাহায্য করা।

(২) শিক্ষার অধিকার ও শিক্ষালয়: মহাকাব্যের যুগে বর্ণভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যরা শিক্ষার সুযােগ ভােগ করলেও শূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষেরা শিক্ষার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হত। শিক্ষাদান মূলত গুরুগৃহে বা গুরুকুলে সম্পন্ন হত। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আশ্রমে বিভিন্ন ধরনের বিভাগ ছিল। এই বিভাগগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল-

  • ব্রহস্থান (পড়াশোনার স্থান),

  • বিয়ুস্থান (রাজনীতির স্থান), ও

  • অগ্নিস্থান (পূজাপার্বপের স্থান),

  • মহেন্দ্রস্থান (যুদ্ধশিক্ষা দানের স্থান),

  • সােমস্থান (উদ্ভিদ বিষয়ে আলােচনার স্থান),

  • গরুড়স্থান (পরিবহণের স্থান) ইত্যাদি। 

মহাকাব্যের যুগের একটি উল্লেখযােগ্য শিক্ষাকেন্দ্র হল নৈমিষারণ্য আশ্রম।

(৩) পাঠক্রম: মহাকাব্যের যুগে বর্ণভেদ অনুযায়ী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান করা হত। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের ধর্মশাস্ত্র, বেদ, নীতিশাস্ত্র, ইতিহাস, যুদ্ধবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে এবং ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের যুদ্ধবিদ্যা, ব্যহরচনা, রথচালনা প্রভৃতি বিষয়ে পাঠদান করা হত। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাব্যপাঠ, অঙ্কন, লিখন, শরীরচর্চা প্রভৃতি বিষয়েও শিক্ষাদান করা হত।

(৪) শিক্ষণপদ্ধতি: মহাকাব্যের যুগে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য বক্তৃতা, আলােচনা, তর্কবিতর্ক , প্রশ্নোত্তর প্রভৃতি পদ্ধতি অবলম্বন করা হত। শিক্ষাদানের সময় শিক্ষার্থীদের সক্রিয়তার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হত।

(৫) শিক্ষকের স্থান: মহাকাব্যের যুগে শিক্ষকদের স্থান ছিল খুবই সম্মানজনক। তাঁদের আধ্যাত্মিক জন্মদাতা হিসেবে স্বীকার করা হত। শিক্ষকরা ছিলেন মহান ব্যক্তি, সৎ চরিত্রের অধিকারী, বুদ্ধিমান, পণ্ডিত, স্নেহপ্রবণ ও ধৈর্যশীল। তারা শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত যত্নসহকারে পাঠদান করতেন।

(৬) বৃত্তিশিক্ষা: মহাকাব্যের যুগে বৃত্তিশিক্ষার প্রচলন ছিল। শিক্ষার্থীরা শিল্পকলা, চিকিৎসাবিদ্যা, ভাস্কর্য, কারিগরি প্রভৃতি বিষয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করত।

(৭) নারীশিক্ষা: মহাকাব্যের যুগে নারীশিক্ষার প্রচলন ছিল। বহু নারী উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সেই যুগে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। মহাভারতে ব্রয়চারিণীর কথা উল্লিখিত আছে। গারগাঁও সে-যুগে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন।

মহাকাব্যের যুগের শিক্ষা বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার তুলনায় অনেক বেশি বি নসম্মত ও তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত ছিল। তবে বর্ণভেদপ্রথা বজায় থাকায় ওই শিক্ষাব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না।

(১) উপনয়নের গুরুত্ব: ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষারত্তের অনুষ্ঠানকে বলা হত উপনয়ন। এর অর্থ হল, শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীকে গুরুর কাছে নিয়ে যাওয়া, বর্ণভেদে উপনয়নের বয়স নির্দিষ্ট ছিল। ব্রাহ্মগ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য শিক্ষার্থীদের উপনয়নের বয়স যথাক্রমে ছিল আট, এগারাে ও বারাে বছর। শূদ্রদের শিক্ষার অধিকার না থাকায় উপনয়নের প্রশ্ন ছিল না। উপনয়নের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক ও নিয়মনিষ্ঠ পড়াশােনা শুরু হত। প্রথম দিকে উপনয়ন আবশ্যিক না হলেও পরবর্তী সময়ে উপনয়ন আবশ্যিক হয়। উপনয়ন এমন একটি অনুষ্ঠান যার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা ব্রত, সংযম, বেদ, নিয়ম, দেবতা ও গুরুর সংস্পর্শে আসতেন। উপনয়নের পরে শিক্ষার্থী গুরুর কাছে শিষ্যত্বের জন্য আবেদন করতেন। গুরুও তাকে গ্রহণ করে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করতেন।

(২) সমাবর্তনের গুরুত্ব: ব্রাহ্মণ্যকুলে যে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম শেষ হত তাকে সমাবর্তন বলা হত। সমাবর্তনে শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা অনুযায়ী শংসাপত্র দেওয়া হত। যেমন বিদ্যা স্নাতক, ব্রত স্নাতক ও বিদ্যাব্রত স্নাতক। এ ছাড়া সমাবর্তনের সময় গুরু শিষ্যকে আশীর্বাদ দিতেন। সত্য বলা, কর্তব্যপালন, বেদ অধ্যয়ন এবং দেবঋণ, ঋষিণ, পিতৃঋণ পরিশােধ করাই ছিল আশীর্বচনের মূল কথা। এই সময় গুরু শিষ্যকে বিনয়ী, কর্তব্যনিষ্ঠ, চরিত্রবান ও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হওয়ার উপদেশ দিতেন।