কবির জীবন কখন সৃষ্টির একক রূপ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না, তাঁর জীবন দীপ্যমান হয়ে উঠে সৃষ্টি শতদলের প্রতিটি পরাগের অপূর্ব বিকাশে। সে পূর্ণ প্রস্ফুটিত প্রসূন মানবজীবনের সৌন্দর্য ও সৌরভের আকর। কবি কায়কোবাদের (১৮৫৭-১৯৫১) কাব্যে এ বিচিত্রতা রয়েছে। হয়তো বা সবক্ষেত্রে গভীর দ্যুতিময় নয়, কিন্তু তাতে ইঙ্গিত রয়েছে নব-সৃষ্টির ও নব জীবনের। পরিপূর্ণতা না থাকলেও নব নব ইঙ্গিতে তা শোভমান। কায়কোবাদের কাছ থেকে পেয়েছি গীতিকাব্যের তন্ময়তা শুধু সুখালসে লিপ্ত নয়-বেদনারঞ্জিত উপ্যাখ্যানও। কায়কোবাদের কাব্য শুধু বিষয় বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ নয়, প্রকরণগত দিক থেকেও বৈচিত্র্যময়। কায়কোবাদ তন্ময় এবং মন্ময় উভয় প্রকার কাব্যেরই স্রষ্টা। ব্যক্তিক ভাবনা দিয়ে কাব্য শুরু করলেও নৈর্ব্যক্তিক ভাবনাতে তাঁর উত্তরণ ঘটেছে। তাঁর কাব্য পরিক্রমায় বৈচিত্র্য রয়েছে। কাব্য-প্রকরণের বিশেষ একটি দিকে তাঁর সচেতন মনোযোগ লক্ষ করা গেলেও তিনি বৈচিত্র্যপূর্ণ কাব্য রচনা করেছেন। সাধারণভাবে খণ্ডকবিতা ও কাহিনি। কাব্যের পর্যায়ভুক্ত তাঁর কাব্য। কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেছে সবধরনের কাব্য রচনাতেই।
কায়কোবাদ মহাকবি হিসেবে অধিক পরিচিতি লাভ করলেও তিনি অনেক খণ্ড কবিতা রচনা করেছেন। খণ্ড কবিতা রচনা করে তিনি অত্যধিক সাফল্য লাভ করেছেন। তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভূত হন একজন গীতিকবি হিসেবে। গীতিকবির হৃদয়ের একান্ত অনুভূতিগুলো স্থান পেয়েছে তার খণ্ড কবিতায়। পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত তাঁর খণ্ড গীতিকাব্যগুলো হলো ‘বিরহ বিলাপ’ (১৮৭০), ‘প্রেমের ফুল’ (১৮৭০), ‘কুসুম কানন’ (১৮৭৩), ‘অশ্রুমালা’ (১৮৯৪), ‘অমিয় ধারা’ (১৯২০) ইত্যাদি। নিচে এসব খণ্ডকাব্যের বিষয় বৈচিত্র্য আলোচনা প্রসঙ্গে কায়কোবাদের কবিকীর্তি আলোচনা করা হলো:
মাত্র ১৩ বছর বয়সে কায়কোবাদের যে খণ্ডকাব্যের বইটি প্রকাশিত হয়েছিল সেটি হলো ‘বিরহ বিলাপ’। অকৃত্রিম আবেগ কবির মূল সম্পদ, কায়কোবাদের মধ্যে তা ছিল সহজাত। অল্প বয়সেই তিনি কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। আর তারই স্বাক্ষর নিয়ে তিনি প্রকাশ করেন ‘বিরহ বিলাপ’।
কায়কোবাদের খণ্ড কবিতার অন্যতম একটি বিষয় হলো প্রেম। ‘কুসুম কানন’ কাব্যের কয়েকটি কবিতায় তাঁর প্রেম সম্পর্কিত মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। বাল্যকালে গিরিবালা দেবী নামে এক হিন্দু বালিকার সাথে কবির বাল্যপ্রেমের যে কাহিনি সুপ্রচলিত এবং কবির দ্বারা সমর্থিত ছিল তার কিছু আভাস এ কাব্যের কবিতার মধ্যে পাওয়া যায়। আর এ কারণেই প্রেমের ব্যর্থতা, হতাশা ও দীর্ঘশ্বাস এখানে প্রাধান্য লাভ করেছে। যেমন এ কাব্যের ‘ভালোবাসা কিছু নহে’ কবিতায় তিনি বলেছেন,
“ভালবাসা কিছু নহে, শুধু এক নাম,
কেবল ছলনা মাত্র, সাধিতে স্বকাম।
তাই বলি শুন সবে, উপদেশ চয়।
এ জগতে কারো সহ কর না প্রণয়।”
কায়কোবাদের সার্থক গীতিকাব্য হলো ‘অশ্রুমালা’। এ কাব্যটি গীতিকবি হিসেবে কায়কোবাদের প্রতিভার সার্থক পরিচয় বাহক। সার্থকতার কারণে কাব্যটি তৎকালীন সুধীবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল। কাব্যটিতে জীবন জিজ্ঞাসা, স্নেহ প্রেম, ভালোবাসা প্রভৃতি হৃদয়ানুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। কায়কোবাদের অশ্রুমালা কাব্য প্রকাশ কালে বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবি সাহিত্যকের একান্ত অভাব ছিল বলে সহজে তার উপর সকলের স্বপ্রশংস দৃষ্টি নিপতিত হয়েছিল। মুসলমানদের অতীত সৌভাগ্যের স্মৃতি হৃদয়ে জাগ্রত রেখে কবি সে সময়ে কতকগুলো জাতীয় প্রেরণামূলক কবিতা রচনা করেছিলেন। ‘অশ্রুমালা’ কাব্যে এ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। গীতিকবির অকৃত্রিম আবেগ তাঁর হৃদয়ে ছিল বলে এ ক্ষেত্রে তিনি সার্থকতা লাভ করেছিলেন।
ব্যক্তি জীবন, সমাজজীবন ও জাতীয় জীবনের নানাবিধ খণ্ড অনুভূতিগুলো এক একটি অশ্রুবিন্দুর মতো করে কবি অনুপম ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন এ কাব্যে। নারীর প্রেম, রূপ, সৌন্দর্য, বিরহের যন্ত্রণা, আনন্দ বেদনা, রোমান্টিক চেতনায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ব্যক্তি জীবনের একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, জনবহুল লোকালয় ছেড়ে বনবাসী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, আধ্যাত্মিক চেতনা, ঈশ্বর ভক্তি, স্বজাতির বেদনাবোধ ইত্যাদি বিষয়ক নানাধরনের কবিতা এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। বিষয় বৈচিত্র্যে ‘অশ্রুমালা’ তাই খুব সমৃদ্ধ এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
‘অশ্রুমালা’ কাব্যের মূলসুর প্রেম হলেও এর মধ্যে প্রেমের সাথে প্রকৃতি একাকার হয়ে গেছে। প্রেমানুভূতির প্রগাঢ়তা এ কাব্যের খণ্ড কবিতার মধ্যে নৈপুণ্যের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। কবির ব্যক্তি জীবনের প্রেমের আবেগ অনুভূতি শেষ পর্যন্ত চিরন্তন প্রেমিক প্রেমিকার হৃদয়ানুভূতির রূপ লাভ করেছে। কবির প্রেয়সী গিরিবালা দেবীকে নিয়ে এ কাব্যের এক অসাধারণ খণ্ড কবিতা হলো ‘ভুল’। এ কবিতার মধ্যে কবি কৌশলে গিরিবালা দেবীর নাম ব্যবহার করেছেন। পংক্তির আদ্যাক্ষরের সমন্বয়ে গিরিবালা দেবীর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন-
“গিয়াছিনু প্রিয়তমে, প্রেমের নিকুঞ্জ বনে
রিক্ত করে ফিরে এনু না পাইনু ফুল।
বাতাসে গিয়াছে ঝরে, নাই আব বৃত্ত পরে
লাবণ্য মাটির মনে হয়ে গেছে ধূল।
দেখিনু সুগন্ধ তার, সমীর নিয়েছে ধারে
বিষাদে হৃদয় মোর মরু সমতুল।”
কবির পরিণত বয়সে রচিত এ কাব্যে কবি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মুসলমানদের অতীত গৌরবের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। এ কাব্যের ‘পাগলিনী’ ‘প্রেমের স্মৃতি’, ‘তারে ভালবাসি’, ‘মানস প্রতিমা’, ‘আমার প্রিয়া’ প্রভৃতি কবিতায় যেমন কবি তার প্রিয়ার রূপ সৌন্দর্যের কথা বলেছেন তেমনি ‘সিরাজ সমাধি’ ‘মোশ্লেম শ্মশান’ ‘দিল্লী’, ‘তাজমহল’ ‘ঈদ আহ্বান’ প্রভৃতি কবিতায় অতীতের বেদনাময় স্মৃতি রোমন্থন করেছেন।
কায়কোবাদের ঈশ্বর ভক্তি ও আধ্যাত্মিক প্রেম চেতনার সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘অমিয় ধারা’ কাব্যে। এ কাব্যের বিভিন্ন কবিতার মধ্যে ভক্ত কবির চিত্তটি সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কায়কোবাদ ছোটবেলা থেকে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। ঈশ্বরের প্রতি এ বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও শেষ জীবনে এসে বিদায়ের বেলা বিষাদের সুর কবির অন্তরে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই এ প্রার্থনা কবিতায় কবি বিধাতার কাছে প্রার্থনা করে বলেছেন,
“জীবনের আলোগুলে
একে একে নিবে গেছে।
লক্ষ্যহারা হয়ে নাথ
এসেছি তোমার কাছে।”
কায়কোবাদের মানসচৈতন্যে লালিত স্বদেশ প্রেমের যে উজ্জ্বল নিদর্শন তাঁর কবিকর্মে লাভ করেছে তাঁর প্রথম প্রকাশ ‘কুসুম কানন’ কাব্যেই প্রত্যক্ষ করা যায়। ‘কুসুম-কানন’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘জন্মভূমি দর্শনে’ কবি উচ্চারণ করেছেন:
“ধিক সে পামরগণে শত শত ধিক্
দেশের লাগিয়া যেই, না দেয় জীবন
তার সম এ জগতে পাতকী অধিক,
আছে কি আছে কি আর? বঙ্গবাসীগণ!”
আলোচনার পরিশেষে এসে আমরা বলতে পারি যে, কায়কোবাদের খণ্ড কবিতার বিষয়বস্তু বিচিত্রমুখী। খণ্ড কাব্যের কবিতার মধ্যে প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, স্বজাত্যবোধ ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলো স্থান পেয়েছে। তাই বলা যায় কায়কোবাদের খণ্ড কবিতায় যে সমস্ত বিষয়বৈচিত্র্য পাওয়া যায় তা বাংলা সাহিত্যকে অনেক সাফল্যমণ্ডিত করেছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment