ভূমিকা: উনিশ শতকের সৃষ্টি এবং পরবর্তীতে যুগস্রষ্টা, আধুনিক বাংলা কাব্যের এক বিরল বিস্ময়কর প্রতিভা মহাকবি মধুসূদন দত্ত [১৮২৪-৭৩]। অসামান্য মেধা আর অসাধারণ আন্তরিকতার যৌথ প্রযোজনায় যে ক’জন কবি বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছেন মধুসূদন দত্ত তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মধ্যযুগীয় দেবনির্ভর অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙে, পাশ্চাত্য আদর্শ ও উপকরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন। বাংলা কাব্যের সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রথম একটা বড়ো পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল মধুসূদনের কাব্যকৃতিতে। মধুসূদনের সাহিত্যজীবনের বিস্তার খুব বেশি নয়। তাঁর সাহিত্যচর্চার প্রধান পর্ব ১৮৫৮ থেকে ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত। মাদ্রাজ প্রবাস থেকে বাংলাদেশে কবি যখন প্রত্যাবর্তন করেন, সেই সময়ে বাংলার নবগঠিত সারস্বত সমাজের কাব্যরস পিপাসা নিবৃত্তির উপকরণ ছিল ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার পরিহাস রসিকতা এবং রঙ্গলালের রোমান্টিক কবিতা।

সাহিত্যরুচির ক্ষেত্রে তখন নতুন হাওয়া বইছিল, কিন্তু নবযুগের ভাবপ্রেরণা আত্মস্থ করে যথাযথভাবে নতুন কাব্যকলা সৃজনের উপযুক্ত প্রতিভার আবির্ভাব তখনো হয়নি। মধুসূদন এই সম্ভাবনাপূর্ণ অথচ অগঠিত একটা সাহিত্যিক আবহাওয়ায় কাজ শুরু করেন। উচ্চাভিলাসী যুবক মধুসূদন পাকা সাহেব হওয়ার বাসনায় একান্তভাবে ইউরোপমুখী হয়েছিলেন। বাইরের দিক থেকে স্বদেশের প্রতি উপেক্ষাই তাঁর সকল আচার আচরণে প্রকট ছিল। সুতরাং মাতৃভাষায় নতুন কিছু সৃষ্টি করা যে তাঁর পক্ষে সম্ভব একথা তখনকার সাহিত্যিক সমাজের কারো পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য ছিল না।

বাংলাভাষায় মৌলিক নাটকের অভাব লক্ষ করে তিনি স্বয়ং স্বেচ্ছায় এই গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করে ১৮৫৯ সালে ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক রচনা করেন। পরবর্তী বছরই তিনি ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামে দুটি প্রহসন এবং ‘পদ্মাবতী’ নামক অপর একটি নাটকও রচনা করেন। কিন্তু বাংলা গদ্যে যথাযথভাবে বীররস প্রকাশের সম্ভাব্যতা বিষয়ে যতীন্দ্রমোহনের সঙ্গে বিতর্ক প্রসঙ্গে মধুসূদন বাংলায় অমিত্রাক্ষর রচনায় প্রতিজ্ঞা করেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে দেশের সাহিত্যিক সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করলেন। বাজি রেখে অসম্ভবকে সম্ভব করার ঝোঁকে মধুসূদন অমিত্রাক্ষর ছন্দে “তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য সম্পূর্ণ করলেন। ১৮৬০-এ ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এ কাব্যে মধুসূদনের কবিজীবনের সূচনা, একাব্যেই বাংলা কবিতায় আধুনিক যুগেরও সূচনা।

১৮৬১ সালে মধুসূদন তাঁর অমরকীর্তি এবং বাংলাভাষার একমাত্র সার্থক মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, রচনা করেন। এছাড়া একই বছরে তিনি গীতিকাব্য ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ এবং পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে বিয়োগান্তক নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ রচনা করেন।

১৮৬২ সালে রচিত হয় বাংলাভাষায় প্রথম পত্রকাব্য-‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। এরপর তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে বিলেত চলে যান এবং সেখান থেকে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে অবস্থানকালে রচনা করেন বাংলাভাষায় প্রথম সনেট ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’। দেশে ফিরে আসার পর আরো কিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, কিন্তু সাহিত্যকৃতিরূপে তাদের মূল্য খুব উচ্চমানের নয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-হোমারের ‘ইলিয়াডে’র গদ্যানুবাদ ও ‘মায়াকানন’ নাটক।

তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য: নতুন ছন্দ সৃষ্টির প্রতিই কবির আগ্রহ প্রবল হওয়ায় কাহিনি বিন্যাস এবং গঠনের দিক থেকে ‘তিলোত্তমা’ অনেকাংশে অসম্পূর্ণ রচনা। দেবচরিত্রগুলো পরিকল্পনায় এবং এক সর্বাতিশায়ী দৈবশক্তির কল্পনায় মধুসূদন কিছু পরিমাণ গ্রিক কাব্যের অনুসরণ করলেও পুরানো কাহিনিতে কোনো মৌলিক পরিবর্তন সাধন করেননি। ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্যে একটা আখ্যানধারা আছে, কিন্তু সেই আখ্যানকে মহাকাব্যোচিত সংহত আকার দেওয়া হয়নি।

বিচ্ছিন্নভাবে এক একটা বর্ণনা, বিশেষভাবে নিসর্গ বর্ণনাগুলোতে কবির রোমান্টিক প্রবণতা এবং লিরিক ভাবোচ্ছাসে যথার্থ নতুন কাব্যরসের স্বাদ পাওয়া যায়। এ কাব্যের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য দুটি-এক. অমিত্রাক্ষর ছন্দে পূর্ণাঙ্গ পৌরাণিক কাব্য রচনার এই প্রথম প্রয়াস। দুই. ভারতীয় কাহিনি বিন্যাসে পাশ্চাত্য জীবনভাবনার মিশ্রণ।

অমিত্রাক্ষর ছন্দ: মৌলিক প্রতিভাসম্পন্ন কোনো কবিই অন্ধভাবে প্রচলিত কাব্যকলার অনুবর্তন করেন না। আপন জীবনভাবনালব্ধ সত্য এবং আপন কল্পনার জগৎটাকে প্রকাশের জন্য নতুন আঙ্গিক, নতুন ভাষা তাঁকে নির্মাণ করতে হয়। বাণীর নতুন রূপ সৃষ্টি মৌলিকপ্রতিভার একটা বিশিষ্ট লক্ষণ। আধুনিক কালের কবি মধুসূদনের পক্ষে রূপান্তরিক জীবন-চেতনা প্রকাশের জন্য নতুন কাব্যভাষা এবং নতুন আঙ্গিক উদ্ভাবন অপরিহার্য ছিল।

আত্মপ্রকাশের দুরন্ত আগ্রহে কবি প্রাচীন ছন্দের বন্ধন ভেঙে অমিত্রাক্ষর ছন্দ নির্মাণ করেছেন। মধুসূদনের এই প্রয়াসে বাংলা কাব্যে ছন্দোমুক্তির সূচনা হয়। এর পূর্বে চরণের আট এবং ছয় মাত্রার দুটি পর্বে গঠিত চরণে এবং দুটি অন্ত মিলযুক্ত চরণ নিয়ে অক্ষরবৃত্ত পয়ার গঠিত হতো। চরণের আট ও ছয়মাত্রার পর্ব দুটি একই সঙ্গে অর্থগত ভাগ এবং শ্বাসগত ভাগরূপে পরিগণিত হতো। সুতরাং এই ছন্দে ছেদ এবং যতি পড়ত একই স্থানে। মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে দৃশ্যত বড়ো বৈশিষ্ট্য দুই চরণের মধ্যে চরণাস্তিক মিলের অভাব, কিন্তু এটাই অমিত্রাক্ষরের প্রধান বৈশিষ্ট্য নয়।

প্রধান বৈশিষ্ট্য ছেদ ও যতি স্থাপনের নতুন পদ্ধতি। মধুসূদনের অমিত্রাক্ষরে শ্বাসগত বিভাগ প্রাচীন পয়ারের মতোই আট ছয় মাত্রার দুটি পর্বে কিন্তু অর্থের দিক থেকে এভাবে পর্ব ভাগ করা যায় না। চরণ অতিক্রম করেও বক্তব্যধারা অন্য চরণে সংক্রমিত হতে পারে। বস্তুতপক্ষে এই প্রবাহমানতায়ই অমিত্রাক্ষর ছন্দের অন্যতম প্রাণভোমরাটি যেন লুকিয়ে আছে। ফলে একটি ভাব দুটি চরণের পয়ারের মধ্যেই সম্পূর্ণ করবার বাধ্যবাধকতা নেই। যেমন-

“কিন্তু মায়াময়ী মায়া, বাহু প্রসারণে
ফেলাইলা দূরে সবে, জননী যেমতি
খেদান মশকবৃন্দে সুপ্ত সুত হতে
করপদ্ম সঞ্চালনে!

[মেঘনাদবধ, ষষ্ঠ সর্গ]

অমিত্রাক্ষর ছন্দের মূল শক্তি এই নতুন বিন্যাসরীতিতেই নিহিত। মিলের অভাবজনিত শূন্যতা কবি পূর্ণ করেছেন সুনির্বাচিত শব্দপ্রয়োগে সৃষ্ট ধ্বনির বিচিত্রতা দ্বারা। লঘু ও গুরু শব্দের সংঘাতে এই কবিতায় এমন ছন্দসংগীত সৃষ্টি হয়-যার ফলে মিলের অভাব অনুভূতই হয় না। ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে’ এই ছন্দ অনেকটা পরীক্ষামূলকভাবেই ব্যবহৃত হয়েছিল। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ই অমিত্রাক্ষর ছন্দের বিচিত্রতর ব্যবহার দেখা যায়। ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’ অমিত্রাক্ষর ছন্দের নমনীয়তা এবং সৌন্দর্যের চূড়ান্ত বিকাশ লক্ষ করা যায়। এ জাতীয় ছন্দ ও ভাষার ব্যবহারে মধুসূদনের কাব্য যে এক মহৎ মর্যাদার আসনে উন্নীত হয়েছিল এবং এ কাব্য যে দেশবাসীর দ্বারা অতিশয় সমাদৃত হয়েছিল, তার উল্লেখ করে ডক্টর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এইরূপ উদাত্ত ভাষা গৌরব ও ধ্বনিগাম্ভীর্য-সমন্বিত, অন্ত্যমিলহীন, অথচ অন্তচ্ছন্দঃস্পন্দের বিচিত্র প্রবাহের দ্বারা গীতোচ্ছাসময় কবিতার জন্য দেশের কেহই প্রস্তুত ছিলেন না। ইহার জন্ম মধুসূদনের পাশ্চাত্যকাব্যপুষ্ট, প্রতিবেশ-নিরপেক্ষ একক কল্পনার মধ্যে। কবিপ্রতিভার সহিত সমকালীন কাব্যরুচির এরূপ দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান অতিক্রম করবার শক্তি তিনি নিজ অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়ের মধ্যেই পাইয়াছিলেন।”

মেঘনাদবধ কাব্য: মধুসূদনের বিশিষ্ট প্রতিভার শক্তি পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে মেঘনাদবধ কাব্যে। তাঁর অমর সৃষ্টি “মেঘনাদবধ কাব্য” [১৮৬১)- যা বাংলা সাহিত্যে একমাত্র সার্থক এবং প্রথম মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃত। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে যে রাম বা রাবণ তা বাল্মীকি বা কৃত্তিবাসের নয়, বরং কবির নিজস্বতার অনুপম প্রয়াস। কবি গ্রিক পুরাণের উৎকৃষ্ট সৌরভটুকু নিয়ে সনাতন কাহিনিকে সুরভিত করে তুলেছেন। মধুসূদন দত্তের “মেঘনাদবধ কাব্য” সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্র অনুযায়ী মহাকাব্যের গৌরব সর্বাংশে দাবি করতে পারে না। তবে তিনি তাঁর কাব্যকে অষ্টাধিক সর্গে বিভক্ত করেছেন এবং সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্র অনুযায়ী কাব্যে নগর, বন, উপবন, শৈল, সমুদ্র, প্রভাত, সন্ধ্যা, যুদ্ধ, যন্ত্রণা প্রভৃতির সমাবেশ ঘটিয়েছেন। সর্বোপরি মহাকাব্য সুলভ বিশালতা সমন্বিত ও আশ্চর্যদীপ্তি কাব্য আনয়ন করেছেন। যদিও কবি নিজেও বলেছেন যে তিনি সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্র অনুযায়ী তাঁর কাব্য রচনা করেননি। বাল্মীকি রামায়ণ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন মাত্র। কাব্যের ভাব, কল্পনা, বিষয়বস্তু তিনি হোমারের ও মিলটনের কাব্য থেকে সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ স্বাধীন চিন্তা ধারায় তাঁর কাব্যের শরীর সাজিয়েছেন। তিনি তাদের মতো করেই কাব্যের শুরুতেই বীণাপাণির সাধনা করেছেন।

শুধু পরিকল্পনা নয়, চরিত্র সৃষ্টিতেও “মেঘনাদবধ কাব্য” মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্য বহন করে। মহাকাব্যের উপযোগী চরিত্র সৃষ্টিতে মধুসূদন দত্ত কোথাও দক্ষতার অভাব দেখাননি। ক্ষত্রীয় নয়, রাক্ষস কিন্তু তারা সদ্বংশজাত, ধীরোদাত্ত চরিত্র বিশিষ্ট এবং সর্বোপরি বীরত্বের মানবিকতায় উজ্জ্বল। এমনকি সরমা চরিত্রটি পর্যন্ত নারী চরিত্রের মহিমায় মহিয়সীন। এছাড়ও হোমারের আদর্শে মধুসূদন দত্ত এর সৃষ্ট দেব-দেবীর চরিত্রগুলো আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা শৌর্য ও শক্তিতে পরিপূর্ণ। মধুসূদন দত্তের “মেঘনাদবধ কাব্যে” Literary Epic প্রাণবস্তুর সাথে Authentic Epic এর বর্ণনাভঙ্গি ও ভাষার স্পষ্টতার অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের শুরুতেই কবি বলেছেন-

“গাহিব মা বীররসে ভাসি/ মহাগীত।”

মধুসুদন নানা দেশীয় মহাকবিগণের কাব্য উদ্যান হতে পুষ্প চয়নপূর্বক এ গ্রন্থখানি রচনা করেছেন। কিন্তু সেসব কুসুমরাজিতে যে অপূর্ব মালা গ্রথিত হয়েছে তা বঙ্গবাসীরা চিরকাল কণ্ঠে ধারণ করবেন। এ কাব্যের নায়ক রাবণ কবি ধৃত আধুনিক সংকটাপন্ন চরিত্র যেমন, তেমনি কবির স্বীয় জীবনের ও স্বদেশের বিপর্যয় ও পরাধীনতার প্রতীক। রাবণের আর্তনাদ আমাদের জাতীয় জীবনের ব্যষ্টি ও সমষ্টি মানবের আর্তনাদ। এ জাতীয়তাবোধ পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিক্ষা অর্জনেরই প্রভাবজাত। এ কাব্যে সরমা, সীতা ভারতীয় নারী চরিত্রের আদর্শ, কিন্তু অন্য নারী চরিত্রগুলোতে ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে তাদের ব্যক্তিত্ব, তেজস্বিতা, বীরত্ব পাশ্চাত্য নারীরই আদল। চিত্রাঙ্গদা বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী, যে স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে পুত্রের জন্য স্বামীর কাছে কৈফিয়ত চায়, যা পাশ্চাত্যের প্রভাব। প্রমীলা প্রেমিকা, স্বামী সোহাগিনী। পক্ষান্তরে, তেজস্বিনী, বীরাঙ্গনা, প্রমীলা চরিত্রটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নারী চরিত্রের সার্থক সমন্বয়। রামায়ণের রামচন্দ্র এখানে কবির আনুকূল্য পায়নি। লক্ষ্মণকে বীরের স্থলে তস্কর করে গড়েছেন। পক্ষান্তরে, রাক্ষসরাজ রাবণের প্রতি অনুকম্পা ও সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন বিশেষ দরদে, যা পাঠককে অশ্রুসিক্ত যেমন করে, তেমনি রাবণের দেশপ্রেম আমাদের মুগ্ধ করে। এখানে রাবণকে রাক্ষস না করে সংকটাপন্ন আধুনিক মানুষ করে তুলেছেন। কাব্যের অধিকাংশ চরিত্র রামায়ণ থেকে গৃহীত হলেও পুরাতনের আবেশ খুলে নতুনত্বের স্পর্শ দিয়েছেন। প্রমীলা, বীরবাহু ও চিত্রাঙ্গদা এ চরিত্র তিনটির স্বতন্ত্র উপস্থাপনই সেকথা প্রমাণ করে।

ভাষা ব্যবহারে ও বর্ণনার ক্ষেত্রে আমরা সর্বত্রই এ কাব্যে মহাকাব্যোচিত ওজস্বিতা গাম্ভীর্য ও বিস্তৃতির পরিচয় পাই। তিনি এ কাব্যে ছন্দের পরে ভাষায়ও বিবর্তন আনলেন। হোমার যেমন কোনো দেবতা বা বীরের নাম করলেই তার উপযুক্ত বিশেষণ প্রয়োগ করে তার বর্ণনায় সমৃদ্ধি আনয়ন করতেন। মহাকাব্যের অন্যতম লক্ষণ উপমা বৈশিষ্ট্য। এই উপমার প্রয়োগও মধুসূদন এর প্রতিভা আশ্চর্য নৈপুণ্যে সমাহিত। হোমারের মতোই তিনি অধিকাংশ বিষয়কে উপমার সাহায্যে বর্ণনা করেছেন। সাধারণত উপমাগুলোর উপমেয় এবং উপমানের বৈশিষ্ট্যকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করে মহাকাব্যকে মহাকাব্য সুলভ বিশালতা দান করেন। “মেঘনাদাবধ কাব্য”ই কবি অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম সার্থক ব্যবহার করেছেন। মহাকাব্যের প্রধান অবলম্বন হলো ‘রস’। এদিক দিয়েও “মেঘনাদাবধ কাব্য” মহাকাব্যের লক্ষণাক্রান্ত। কাব্যের প্রথম দিকে ‘গাইব মা বীর রসে ভাসি মহাগীত’ বললেও সমস্ত কাব্য বিচারে করুণ রসই প্রধান হয়ে উঠেছে। তবে স্থানে স্থানে আবার বীর রসও প্রবাহিত। মোটামুটি বীর রস ও করুণ রস মিলে মেঘনাদবধ কাব্য রস প্রবাহ উৎকর্ষতা লাভ করেছে। যেমন-

“করি স্নান সিন্ধুনীরে, রক্ষোদল এবে

ফিরিলা লঙ্কার পানে আর্দ্র অশ্রুনীরে-

বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে
সপ্ত দিবানিশী লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে।”

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, কাহিনির বিন্যাস, গ্রন্থ বিশালতা, চরিত্র সৃষ্টি, ভাব, ভাষা, শব্দ, উপমা, রস প্রভৃতির ক্ষেত্রে মেঘনাদবধ কাব্য মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্য বহন করে।

মধুসুদনের গীতিধর্মিতা: ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ই মধুসূদনের কবিখ্যাতির প্রধান অবলম্বন হওয়ায় তিনি মহাকাব্যের কবিরূপে পরিচিত। মেঘনাদবধের মহাকাব্যোচিত সমারোহের মধ্যেও মাঝে মাঝে গীতিরস উচ্ছসিত হয়ে উঠেছে। মেঘনাদবধের চতুর্থ সর্গে সীতার বিলাপে, রাবণের আর্তস্বরে মধুসূদনের প্রকৃতিগত রোমান্টিক লিরিক মানসপ্রবণতা প্রকাশ পায়।

মধুসূদনের কবিমানসের লিরিক প্রবণতার জন্যই মেঘনাদবধ রচনার সঙ্গে সঙ্গে রাধাবিরহ-প্রসঙ্গ নিয়ে কাব্য রচনার প্রেরণা তিনি অনুভব করেছিলেন। বৈষ্ণব কাব্যের রোমান্টিক পরিবেশ এবং রোমান্টিক প্রেমের সূক্ষ্ম সৌন্দর্য মধুসুদনের ব্রজাঙ্গনা কাব্যে নতুন ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে।

তাঁর বৃহৎ কাব্যগ্রন্থগুলোর পাশে খণ্ড খণ্ড গীতিকবিতার এই সংকলনটি তেমন মর্যাদা পায়নি, তবুও ‘ব্রজাঙ্গনা’র কবিতাগুলো ভাষা ও ছন্দের পরীক্ষার দিক থেকে আকর্ষণীয়। দেশজভাষার ছন্দস্পন্দ যে মধুসূদনের কাছে অপরিজ্ঞাত ছিল না ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য তার আদর্শ প্রমাণ।

“কেনে এত ফুল                            তুলিলি, সজনি-

ভরিয়া ডালা?

মেঘাবৃত হলে,                          পরে কি রজনী

তারার মালা?

আর কি যতনে                              কুসুম রতনে

ব্রজের বালা?”

মেঘনাদবধ রচনার সমসময়েই ব্রজাঙ্গনায় মধুসূদন এরূপ স্বাচ্ছন্দ্যময় লিরিক লিখেছেন। খাঁটি বাংলাভাষার ছন্দস্পন্দ যে তাঁর মজ্জাগত, উদ্ধৃত অংশটিতেই তা প্রমাণিত হয়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বিচিত্র ব্যবহার কবিতার গঠনে, যতি সংখ্যা এবং চরণ সংখ্যা বিন্যাসের অপরিসীম স্বাধীনতায় ও স্তবক গঠনে ‘ব্রজাঙ্গনা’র কবিতাগুলো বাংলা কবিতার আঙ্গিকগত পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

বীরাঙ্গনা কাব্য: ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনি থেকে এগারোজন নায়িকা চরিত্র নির্বাচন করে প্রেমাস্পদের উদ্দেশ্যে নায়িকাদের পত্রের আকারে এই কাব্যের এগারোটি সর্গ রচিত হয়েছে। প্রতিটি সর্গই স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু একটা নারী চরিত্রের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের আধারে প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রেমের স্তরগুলো সর্বত্র এক নয়, কিন্তু মধুসূদনের ভাষা ও ছন্দ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিষয়ের উপযুক্ত আধার হয়ে উঠেছে। ‘বীরাঙ্গনা’র পত্রিকাগুলোতে একেকটা আখ্যানের ক্ষীণ আভাস আছে, প্রতিটি সর্গই বিশেষভাবে চরিত্রগুলোর উক্তিরূপে রচিত। তবু তার মধ্যে আখ্যানকাব্যের নয়, গীতিকাব্যের ধর্মই বেশি স্ফুট হয়েছে।

প্রতিটি সর্গে একটা স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবের প্রকাশ হওয়ায় বস্তুত সর্গগুলো খণ্ড খণ্ড গীতিকাব্যেরই রূপ ধারণ করেছে। আর এই কাব্যে মধুসূদন ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’কে সপ্তস্বরা বাঁশীর মতো ব্যবহার করেছেন। তাতে বীর, করুণ, বীভৎস; বিভিন্ন রসের সার্থক সৃষ্টি করেও মধুসূদন এর দ্বারা গীতিকবিতাসুলভ মধুর রসসৃষ্টিতেই অধিকতর সার্থকতা দেখিয়েছেন। এই বিষয়ে মধুসূদনের ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ এবং ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ একসূত্রে গ্রথিত। বীরাঙ্গনার ভাষাকেও গীতিকাব্যের আদর্শ ভাষা বলা যায়।

চতুর্দশপদী কবিতাবলি: মধুসূদনের শেষতম কাব্যগ্রন্থ চতুর্দশপদী কবিতাবলী বা সনেট সংগ্রহ প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ সালে। সনেট বস্তুত গীতিকবিতারই একটা প্রকারভেদ। বাংলায় পাশ্চাত্য কাব্যকলা আত্মীকরণের ঝোঁক মধুসূদনের কবিজীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কবিজীবনের প্রথম পর্বেই তিনি সনেট রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন। তাঁর প্রথম সনেটটির রচনাকাল মেঘনাদবধের সমসাময়িক। কিন্তু এরপরে কবি দীর্ঘদিন এই কাব্যরূপটি চর্চা করেননি।

ইউরোপ প্রবাসকালে ১৮৬৫ সালে ভার্সাই শহরে কবি যখন বাস করছিলেন তখনই সনেটগুলো রচনা করেন। পরবাসে দুঃখদারিদ্র্যের মধ্যে কবির ক্লিষ্টচিত্ত স্বদেশের জন্য, দেশের কাব্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য যে ব্যাকুলতা অনুভব করত এই খণ্ড খণ্ড কবিতায় তাই অপরূপভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থেই ব্যক্তিমানুষ মধুসূদনের অন্তরঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়। আখ্যান নয়, চরিত্রসৃষ্টির আগ্রহ নয়, একান্তভাবে কবির নিজস্ব আবেগ অনুভূতি প্রত্যক্ষভাবে সনেটগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে।

ইতালীয় কবি পেত্রার্ক-কর্তৃক অনুপ্রাণিত হলেও মধুসূদন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিল্টনের মিলবিন্যাস রীতি অনুসরণ করেছেন। এই সনেটগুলোকে কবির আত্মা বহিঃপ্রকাশরূপেই চিহ্নিত করা চলে। কবি ওয়ার্ডস ওয়ার্থ মহাকবি শেক্সপিয়রের সনেটগুলো সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন যে ‘With this key he unlocked his heart’ অর্থাৎ এই সনেটগুলোকেই চাবিরূপে ব্যবহার করে শেক্সপিয়র তাঁর হৃদয় উন্মোচন করেছিলেন।

অনুরূপ মন্তব্য মধুসূদন সম্বন্ধেও যথাযথভাবেই প্রযুক্ত হতে পারে, কারণ এই সনেটগুলোতেই কবিপ্রাণের যথার্থ প্রকাশ ঘটেছে। অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন,

“নিজের আপন জনকে, দেশকে, জাতিকে, যথার্থভাবে জানতে হলে বোধ হয় একটু দূর থেকেই দেখতে হয়, হিমালয়ের বুকে বসে হিমালয়ের বিরাটত্ব উপলব্ধি করা যায় না, একমাত্র দূর থেকে দেখলেই তার সমগ্রতার বোধ আসে। তেমনি, মধুসূদনও দূর প্রবাসে অবস্থানকালেই স্বদেশ-স্বজনের স্মৃতিতে উদ্বেল হয়ে তার যথার্থ মূল্য অনুধাবন করতে পেরেছেন।”

পরিশেষে বলা যায়, মধুসূদনের কবিজীবনের বিস্তার খুব বেশি নয়। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত কবিজীবনে মাত্র কয়েকটা কাব্যগ্রন্থে তিনি বাংলা কবিতাকে আবহমান ধারায় মৌলিক রূপান্তর সাধন করে গেছেন। তিনিই বাংলা কবিতার বিশ্ব- কাব্যলোকের উন্নততর আদর্শ এবং রুচির প্রবর্তন করেন। ধর্মীয় জটিলতা, এবং অতিলৌকিকতায় আচ্ছন্ন বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে মানবিক অনুভূতির বিচিত্রতা ও মানব মহিমাকেই কাব্যবিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তিনি বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ মুক্তিপথ প্রস্তুত করে দিয়েছেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।