মিলটনের রাজনৈতিক তথা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে লিখিত পুস্তিকাগুলি বাদ দিলে মিল্টন সমস্ত অর্থেই কবি, চিরস্মরণীয় এক কাব্য প্রতিভা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলনের পবিত্রতাকে যে আন্তরিকতায় তিনি তাঁর কাব্যে স্থান দিয়েছেন তা এককথায় অতুলনীয়। দৃষ্টিভঙ্গির রক্ষণশীলতা ও প্রচারধর্মীতা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পীড়াদায়ক মনে হলেও নৈতিক আদর্শের উচ্চতা তার রচনাগুলিকে এক স্বতন্ত্র মাত্রা প্রদান করে যা সমস্ত সমালোচনার অতীত। লাতিন ও ইংরেজি, উভয় ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর দক্ষতা, বিভিন্ন ধ্রুপদী কাব্যরূপের প্রয়োগে তাঁর নিপুণতা, ধ্রুপদী তথা পৌরাণিক অনুসঙ্গ ও চিত্রকল্প, সমৃদ্ধ তাঁর অনুকরণীয়, উচ্চাঙ্গ ভাষাশৈলী তাঁর গাম্ভীর্য ও উদাত্ততা ইত্যাদি ইংরাজি তথা বিশ্ব কাব্যের ইতিহাসে মিলটনকে এক সুউচ্চমহিমায় স্থান দিয়েছে। এলিজাবেথীয় যুগের অবসানে এক সংকটের কালে যখন কবিতা ও নাটক ছিল এক বিশৃঙ্খল অনিশ্চয়তার কবলে তখন মিলটনই ছিলেন সেই যুগন্ধর প্রতিভা যিনি ইতিহাস তথা সাহিত্যের এক সন্ধিক্ষণে শাশ্বত, ঐতিহানুসারী মহাকাব্যিক এক ঔদার্য্যমণ্ডিত প্রজ্ঞার মহাশঙ্খে ফুঁ দিয়েছিলেন।

রচনাসমূহ : মিলটনের সমগ্র রচনাগুলিকে মূলত তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে। যথা—

(ক) গদ্য রচনা : ১৬৩৯ থেকে ১৬৬০-এর মধ্যবর্তী বছরগুলিতেই তাঁর সদ্য রচনাগুলির রচিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় মিলটন প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক তথা ধর্মীয় বিতর্ক ও সংঘাতের সঙ্গে, ব্যক্তিগত জীবনের কিছু প্রসঙ্গ ও সমকালীন বিতর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই সময় থেকে রচিত হতে থাকে মিলটনের পুস্তিকাগুলি। সর্বমোট পঁচিশটি পুস্তিকা তিনি প্রণয়ন করেন, তার মধ্যে ইংরেজিতে একুশটি এবং অন্য চারটি লাতিল ভাষায়। তাঁর পুস্তিকা রচনার সূত্রপাত চার্চ সংক্রান্ত বিতর্কের সূত্র ধরে যোশেফ হলের বিরুদ্ধে কয়েকটি শানিত গদ্য রচনা প্রকাশ করেন। তারপর বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ম-নীতি প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি পুস্তিকা রচনা করেন। Tractate of Education, Areo Pagitica নামক পুস্তিকা দুটি এই সময় রচিত। প্রথমটি শিক্ষা বিষয়ক, দ্বিতীয়টি মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক। প্রথম চার্লসের নিধনের পর মিলটন লিখেছিলেন ‘টেনিওর অব কিংস অ্যান্ড ম্যাজিস্ট্রেট (Tenure of Kings and Magistrate 1649) নামক একটি পুস্তিকা, ইত্যাদি। অবশ্য এইসব রচনাতে রসবোধ, কল্পনাশক্তি এবং সর্বোপরি সংযমের অভাব আছে।

কবিতা : কবি হিসাবে মিলটনের প্রস্তুতি পর্বের প্রথম ফসল On the Morning of Christ’s Nativity নামক বহুখ্যাত ‘Ode’-টি বেথেলহেমের আস্তাবলে জাত জিশু খ্রিস্টের উদ্দেশ্যে প্রাচ্যের তিন জ্ঞানী ব্যক্তির মাত্রা বিবৃত হয়েছে এই কবিতায়। এর পরেই মিলটন রচনা করেন ‘On Shakespeare’ এবং ‘On arri Ning at the Age of Twenty three কবিতা দুটি। এর পরবর্তী রচনা ‘লালেগরো’ L’Allegro এবং ‘ইল পেনসেরোসো’ ‘It Penseroso’ এই কবিতা দুটি। কবি মনের বিচিত্র সংবেদন, আবেগ ও অনুভূতির সূক্ষ্মতা যথাযথ চিত্রকল্পে বাণীরূপ লাভ করেছে এই যুগ্ম কবিতায়। ১৬৩৩-এ মিলটন রচনা করেন একটি সংক্ষিপ্ত গীতিকবিতা—আর্কেডস ‘Arcades’ রাখালিয়া মুখোশ নৃত্যগীত-এর আদলে রচিত এই কবিতায় রয়েছে পরী ও মেষপালকদের গান। কোমাস ‘Comus’ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রচনা, এটিও একটি রূপকধর্মী রাখালিয়া কবিতা। মিলটনের কেমব্রিজের সহপাঠী এডওয়ার্ড কিং-এর অকাল মৃত্যুতে ১৬৩৮-এ তিনি একটি শোকগাথার সংকলন প্রকাশ করেন। এই কবিতাগুলির মধ্যে Lycidas’ বন্ধু বিয়োগ উপলক্ষ্যে রাখালিয়া শোকগাথা ‘(Pastoral Elegy)-র আকারে লিখিত। এছাড়াও আরও কয়েকটি ছোটো ছোটো কবিতা রচনা করে তিনি কবি প্রতিভার শীর্ষদেশে আরোহণ করেছিলেন।

মহাকাব্য : কেমব্রিজের ছাত্রাবস্থা থেকেই মিলটনের সর্বকালের স্মরণীয় একটি কাব্য, রচনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। মহাকাব্যধর্মী এক মহৎ কাব্য রচনার স্বপ্ন। ইংলন্ডের ইতিহাস ও বাইবেল থেকে বিষয়বস্তুর সন্ধানে রত ছিলেন তিনি। অবশেষে ‘বাইবেল’ বর্ণিত মানুষের স্বর্গচ্যুত হওয়ার কাহিনি নির্বাচন করে তিনি রচনা করলেন ‘Paradise Lost.’ ১৬৫৮ তে এই মহাকাব্য রচনার সূত্রপাত। যা দশটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে প্রকাশিত হয় ১৬৬৭-তে। ঠিক এর সাত বছর পর Paradise Lost পুনঃপ্রকাশিত হয় বারোটি খণ্ডে সংকলিত অবস্থায়। মানুষের পতনের কাহিনিই ‘প্যারাডাইস লস্টের’ জটিল রূপকল্পের কেন্দ্রবিন্দু। মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক সূত্র এবং খ্রিস্টের ভূমিকার তাৎপর্য মিলটনের রচনার মূল বিচার্য। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী ও পরে নরকে পতিত শয়তান ও বিদ্রোহী দেবদূতগণ সামগ্রিক বিচারে গৌণ, তারা কেবলমাত্র আদম ও ইভের পতনের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করেছে এবং শয়তান নয়, আদমই সমগ্র কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র। মূলত ঈশ্বরানুরাগী শুদ্ধবাদী মিলটন তো ঈশ্বরের কার্যাবলিকেই যথার্থ প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে Paradise Lost রচনা করেছিলেন।

১৬৭৬-এ একই বছরে প্রকাশিত হয় মিলটনের সর্বশেষ দুটি রচনা প্যারাডাইস রিগেইন্ড (Paradise Regained) ও স্যামসন অ্যাগোনিসটেট্স (Samson Agonistes)। মিলটনের বন্ধু টমাস এলউড (Thomas Ellwood) প্যারাডাইস লস্টের পাণ্ডুলিপি পড়বার সময় বলেছিলেন “স্বর্গ থেকে অ্যাডাম এবং ঈভ নির্বাসিত হলেন। কিন্তু তাঁরা করে আবার স্বর্গে ফিরে যেতে পারবেন ?” এই প্রশ্নের উত্তর প্যারাডাইস রিগেইল্ড, চারটি খণ্ডে এ কাব্যটি রচিত। মিলটনের বহুদিন থেকেই ইচ্ছা ছিল যে প্রাচীন গ্রিক কবিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি এমন একটি ট্র্যাজেডি রচনা করবেন যা গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো বাহুল্য বর্জিত এবং নিরাত্তরস হবে। গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো আগ্রি এবং সুর তিনি নিয়ে এলেন স্যামসন অ্যাগোনিসটিসে। গ্রিক সাহিত্যে সুপণ্ডিত মিলটন অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন। বাইবেল ছিল তার জীবনের ধ্রুবতারা। তিনি বাইবেল থেকে কল্পাংশটুকু গ্রহণ করে রেনেসাঁন্স যুগের গ্রিক সাহিত্যপ্রিয়তা এবং পিউরিটাস যুগের ধর্মভীরুতার এক অপূর্ব সমন্বয় সাধন করেছেন।

অবদান : মিলটন ইংরাজি কবিতাকে দিয়েছিলেন এক ধ্রুপদী দাঢ্য ও স্বর গাম্ভীর্য, ধ্রুপদী সাহিত্য ও পুরাণের উপমা চিত্রকল্পে তাঁর কবিকল্পনা পেয়েছিল এক স্বতন্ত্র মাত্রা। মহাকাব্যের মতো এক সুউচ্চমহিলা সাহিত্যরূপকে মিলটন চিরস্থায়ী করেছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্তে। সর্বোপরি উল্লেখ্য তাঁর অমিত্র ছন্দের ব্যবহার, শেকসপিয়র যে ছন্দরীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেই অমিত্র ছন্দের অনবদ্য ও উপযোগী প্রয়োগ দেখা গেল মিলটনে সবমিলিয়ে বলতে গেলে মিলটন সম্পর্কে ওয়ার্ডসওয়ার্থের সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করতে হয়: “Thou hadst a voice whose sound was like the sea. “