মহম্মদ-বিন-তুঘলকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ:

মহম্মদ-বিন-তুঘলক দিল্লির সিংহাসনে আসীন ছিলেন পঁচিশ বছরের কিছু বেশি সময়। কিন্তু এর মধ্যে তাঁকে প্রায় বাইশটি বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। উত্তর-পশ্চিমে মুলতান থেকে পূর্বে বাংলাদেশ এবং দক্ষিণে মালাবার উপকূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল বিদ্রোহের আগুন। স্থানভেদে এই সকল বিদ্রোহের উৎস ও প্রকৃতির মধ্যে স্বাতন্ত্র্য অবশ্যই ছিল। কিন্তু গভীরভাবে অনুধাবন করলে ভারতব্যাপী এই সকল ছোটো-বড়ো বিদ্রোহের মধ্যে কয়েকটি মিল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। যেমন—

(১) অভিজাতদের প্রতি সুলতানের নীতি এই শাসকশ্রেণিকে ক্ষুব্ধ করেছিল। খলজি বংশের শাসনকাল তুর্কি ছাড়াও অন্যান্য শ্রেণির মুসলমান এমনকি ধর্মান্তরিত ভারতীয়দেরও অভিজাতর মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। মহম্মদ তুঘলক আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়ে নিম্নবংশজাত লোকেদেরও উচ্চ সরকারি পদ দিয়ে নতুন অভিজাতশ্রেণি গড়ে তোলেন। এদের মধ্যে ধর্মান্তরিত মুসলমান এবং হিন্দু উভয়েই ছিলেন। এঁরা অশিক্ষিত বা অযোগ্য ছিলেন না। তথাপি এঁদের অভিজাত হিসেবে মেনে নিতে উচ্চবংশজাত ও পুরোনো অভিজাতরা রাজি ছিলেন না। বারাণীর মতে, সুলতান কিছু বিদেশিকেও অভিজাত শ্রেণিভুক্ত করেন। অধ্যাপক সতীশ চন্দ্রের মতে, ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক নিয়ে মহম্মদ তুঘলকের অভিজাতশ্রেণি গড়ে ওঠার ফলে তাদের মধ্যে সংহতিবোধ এবং আনুগত্যবোধের অভাব দেখা দেয় এবং সামান্য কারণে এঁরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।

(২) মহম্মদের আমলে সাম্রাজ্যের বিরাট বিস্তৃতি ছিল, কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। সাম্রাজ্যের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে গিয়ে বিদ্রোহ দমন করা ছিল প্রায় অসম্ভব। স্বভাবতই বিপ্লবীরা স্বরাজ্য গড়ে তোলার অনুকুল সুযোগ পেয়েছিল।

(৩) মহম্মদ তুঘলকের ক্রোধ ও হটকারিতা এবং সন্দেহজনক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি অমানবিক আচরণ অনেকের সাধারণ ক্ষোভকে বিদ্রোহের আগুনে রূপান্তরিত করেছিল।

(৪) সুলতান বিদ্রোহ দমনের কাজে কাউকে বিশ্বাস করতেন না। তিনি নিজেই রাজ্যের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত ছুটে ছুটে বিদ্রোহ দমন করতেন। এই সুযোগ নিয়েছিলেন বিদ্রোহীরা। বিশেষত, সুলতান উত্তর ভারত বা পূর্ব ভারতে ব্যস্ত থাকলেই দক্ষিণ ভারতে বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত হত।

(৫) বিদ্রোহের মূল কারণ অনুসন্ধান করা এবং রাজনৈতিক বা কূটনৈতিকভাবে তা দূর করে বিপ্লবের সম্ভাবনা রোধ করার প্রচেষ্টা অস্থিরমতি সুলতান করতেন না। তাই মহম্মদ তুঘলকের রাজত্বকালে একদিকে দিল্লি সুলতানি যেমন উন্নতির চরম শিখরে উপনীত হয়, তেমনি অন্যদিকে সাম্রাজ্যের ভাঙনেরও সূত্রপাত তখনই হয়।

মহম্মদ তুঘলকের সিংহাসনারোহণের একেবারে গোড়ায় (১৩২৬-২৭ খ্রিঃ) তাঁর সম্পর্কিত ভাই বাহাউদ্দিন গুরুসাস্প প্রথম সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন। গুরুসাস্প দাক্ষিণাত্যে গুলবর্গার কাছে সাগর অঞ্চলে জায়গির ভোগ করতেন। এই সুত্রে তিনি ধনসম্পত্তির অধিকারী হন এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জায়গিরদারদের সমর্থনে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ইসামীর মতে, সুলতান মহম্মদ সিংহাসনে বসার এক বছর পরেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি সন্দেহপরায়ণ হয়ে ওঠেন এবং হিন্দুদের সমর্থনলাভের আশায় উলেমা ও অন্যান্য তুর্কি অভিজাতদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে শুরু করেন। তাঁর ন্যায়পরায়ণতা নৃশংসতায় রূপান্তরিত হয় এবং দয়ালু সুলতান পরিণত হয় দয়াহীন নিপীড়কে। এই কারণে গুরুসাস্প ক্ষুব্ধ হন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁর ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ক্ষোভ। ফেরিস্তা লিখেছেনঃ সুলতানের নিকটাত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও গুরুসাস্প কোনো সম্মানজনক রাজপদ পাননি। তাঁর পদোন্নতিও ঘটেনি। তাঁর থেকে কম বয়স্ক ও কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরাও উঁচুপদে উঠে যান, কিন্তু গুরুসাস্প সামান্য জায়গিরদার থেকে যান। এইভাবে ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও ধর্মীয় আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ইসামী লিখেছেনঃ সুলতানের আদেশ অমান্য করে গুরুসাস্প সৈন্য সংগ্রহ শুরু করেন এবং প্রকাশ্যে দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নিজ-কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত করতে থাকেন। ইবন বতুতার মতে, গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর সময় থেকেই গুরুসাস্প মহম্মদ তুঘলকের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন।

আহম্মদ-বিন্-আয়াজ (মালিকজাদা) -এর নেতৃত্বে সুলতানি বাহিনী দেবগিরিতে উপস্থিত হলে গুরুসাস্প তাদের অক্রমণ করেন। কিন্তু পরাজিত হয়ে সপরিবারে পার্শ্ববর্তী হিন্দুরাজ্য কাম্পিলিতে পালিয়ে যান। বেলারী, রায়চুর ও ধারওয়ার জেলা নিয়ে গঠিত কাম্পিলির ছোট্ট রাজ্যটি প্রথমে দেবগিরির যাদব-রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আলাউদ্দিন খলজির আমলে দেবগিরি দিল্লি-সুলতানির অন্তর্ভুক্ত হলে কাম্পিলি স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং মালিক কাফুরের আক্রমণ (১২১৩-‘১৫ খ্রিঃ) প্রতিহত করে নিজ-স্বাধীনতা রক্ষা করে। ক্রমে কাম্পিলি প্রভূত ক্ষমতা ও সম্পদের অধিকারী হয় এবং অনন্তপুর, চিতলদুর্গ, সিমোগা প্রভৃতি অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত হয়। রাজা কম্পিলদেব একজন রাজদ্রোহীকে নিছক মানবিক কারণে নাকি রাজনৈতিক কারণে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তা বলা কঠিন। ফেরিস্তার মতে, গুরুসাম্প-এর সাথে কাম্পিলদেবের গোপন মিত্রতা ছিল। সম্ভবত, দিল্লি সুলতানির বিরোধী এই হিন্দু-রাজ্যটি দিল্লির শত্রু হিসেবে রাজনৈতিক কারণে গুরুসাস্পের পক্ষাবলম্বন করেছিল। যাই হোক্, সুলতান এই রাজ্যের বিরুদ্ধে দ্রুত এক অভিযান প্রেরণ করেন। কাম্পিলদেব বীরত্বের সাথে সুলতানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দেন। দুর্গের মহিলাগণ জহরব্রত করে প্রাণ বিসর্জন দেন। কাম্পিলি দখল করে সুলতানি শাসন প্রবর্তন করা হয়। গভর্নর নিযুক্ত হন মালিক মহম্মদ। কিছু অভিজাত, তাদের পরিবারবর্গ এবং নিহত রাজার দুই পুত্র হরিহর ও বুক কে বন্দি করে দিল্লিতে আনা হয়। এদের ইসলামধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়। স্মরণীয় যে, পরবর্তীকালে এই দুই ভাই স্বাধীন বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সুলতানি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে হিন্দু প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।

কম্পিলদেব মৃত্যুর পূর্বে গুরুসাস্প ও তার পরিবারবর্গকে হোয়সলরাজ তৃতীয় বীরবল্লালের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে কাম্পিলি দখল করার পর সুলতানি বাহিনী হোয়সল রাজ্যের রাজধানী দ্বারসমূহ আক্রমণ করে। ফেরিস্তা লিখেছেন যে, বীরবল্লার সুলতানের শত্রুতার ভয়ে গুরুসাস্পকে বন্দি করে সেনাপতি খাজাজাহনের কাছে পাঠিয়ে দেন এবং দিল্লির বশ্যতা স্বীকার করে নেন। কিন্তু রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, এই বিবরণ সত্য নয়। কারণ জনৈক মুসলিম লেখকের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সুলতানি বাহিনী ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বারসমূহ ধ্বংস করে। আবার ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের একটি লিপিতে জানা যায়, এই সময় পর্যন্ত তৃতীয় বীরবল্লাল স্বাধীন রাজা হিসেবে রাজত্ব করেছিলেন। তাই অনুমান করা যায় যে, বীরবল্লাল প্রথমে দিল্লির বাহিনীকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন। তবে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ করেন এবং সুলতানের অনুমতি সপেক্ষে আরও কিছুকাল সাম্রাজ্যের একাংশে রাজত্ব করার সুযোগ পান। যাই হোক্, সুলতানের নির্দেশে জীবন্ত অবস্থায় গুরুসাস্প-এর গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল এবং তাঁর মাংস রান্না করে তাঁরই পরিবারবর্গকে ভক্ষণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এটি নিঃসন্দেহে সুলতান মহম্মদের নৃশংসতা ও বিকৃত মানসিকতার অন্যতম দৃষ্টান্ত।

গুরুসাম্প-এর বিদ্রোহের ফলে দক্ষিণ ভারতে স্বাধীন হিন্দু-রাজ্যের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে যায়। আলাউদ্দিন যাদব-রাজ্য দেবগিরি দখল করেছিলেন। তুঘলক বংশের আমলে বরঙ্গল, মাদুরা, কাম্পিলি এবং হোয়সল রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল দিল্লি-সুলতানির অন্তর্গত হয়। একমাত্র কাশ্মীর, উড়িষ্যা, রাজস্থান এবং মালাবার উপকূলের একাংশ ছাড়া প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ দিল্লি-সুলতানির অধীনে চলে আসে।

গুরুসাস্প-এর বিদ্রোহের অল্পকালের মধ্যে মুলতানের শাসনকর্তা বাহরাম আইবা কিশলু খাঁ বিদ্রোহ করেন (১৭২৭-‘২৮ খ্রিঃ)। বারাণী এটিকে ‘মহম্মদের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, সুলতান দিল্লির অভিজাতবর্গ ও তাদের পরিবার-পরিজনকে নতুন রাজধানী দিল্লি যাবার নির্দেশ দিলে বাহরাম তা মানতে অস্বীকার করেন এবং বিদ্রোহী হন। আহম্মদ সিরহিন্দির মতে, সুলতান বাহরামের জামাতা আলি খাতাতিকে হত্যা করলে বাহরাম বিদ্রোহী হন। ইবন বতুতার বিবরণ অনুযায়ী সুলতানি বাহিনী গুরুসাস্প ও গিয়াসুদ্দিন বাহাদুরের মৃতদেহ প্রদর্শন করে ঘুরতে ঘুরতে মুলতানে এলে কিশলু খাঁ তা কবরস্থ করার নির্দেশ দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সম্রাট কিশলু খাঁ’কে রাজধানীতে তলব করেন। কিন্তু কিশলু খাঁ সেই নির্দেশ অমান্য করে বিদ্রোহী হন। কিন্তু ইবন বতুতার মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ গুরুসাস্প ও গিয়াসউদ্দিন বাহাদুরের বিদ্রোহ ঘোষণার মাঝে কম করেও পাঁচ বছরের ব্যবধান ছিল। স্বভাবতই দুজনের মৃতদেহ একই সঙ্গে প্রদর্শন করা সম্ভব ছিল না। অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, দিল্লি ত্যাগ করে দৌলতাবাদ যাবার নির্দেশের বিরুদ্ধেই বাহরামের বিদ্রোহ ধ্বনিত হয়েছিল। যাই হোক্, সীমান্তরাজ্যে এই বিদ্রোহ সুলতানকে শঙ্কিত করেছিল। তিনি দ্রুত দাক্ষিণাত্য থেকে মুলতানে অগ্রসর হন এবং বাহরামকে পরাজিত করেন। ড. হোসেনের মতে, কিশলু খাঁ’র বিদ্রোহ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। সুলতানও এই বিদ্রোহকে উলেমাতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্রের বিদ্রোহী মানসিকতার অন্যতম প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করেন। তাই সুলতান মুলতানের কাজিকেও চরম শাস্তি দেন এবং কিশলু খাঁ’র ছিন্ন মুণ্ড শহরের প্রবেশদ্বারে ঝুলিয়ে রেখে বিদ্রোহের করুণ পরিণতি সম্পর্কে সবাইকে সাবধান করে দেন।

এর অল্পকালের মধ্যে সিন্ধুর নিকটে কমলপুরের কাজি ও খাতিব বিদ্রোহী হন। ইবন বতুতার ‘বিবরণ’ থেকে জানা যায় যে, সুলতানের নির্দেশে উজির খাজা জাহান কমলপুরে উপস্থিত হয়ে বিদ্রোহীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেন এবং সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। স্যার উলসী হেগ-এর মতে, মুলতান থেকে সুলতান দৌলতাবাদে ফিরে যান এবং ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। কিন্তু বারাণী, ইসামী ও ইবন বতুতার লেখা থেকে জানা যায় যে, মুলতান থেকে ফিরে সুলতান দিল্লিতে অবস্থান করেন এবং সেই সময় তিনি আরও কিছু বিদ্রোহ দমন করেন।

১৩৩০-৩১ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁ’র (বাংলাদেশ) শাসক গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর বুরা বিদ্রোহী হন। বাংলাদেশের শাসনক্ষেত্রকে লখনৌতি, সোনারগাঁ এবং সাতগাঁ—এই তিন অংশে বিভক্ত করে মহম্মদ স্বতন্ত্র শাসক নিয়োগ করেন। সোনারগাঁ’র শাসনভার অর্পণ করেন যৌথভাবে গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর ও তাঁর ভাই বাহরাম খাঁ’র হাতে। শর্ত ছিল যে, শাসকদের পুত্ররা সুলতানের অধীনে জামিন হিসেবে রক্ষিত থাকবে। কিন্তু গিয়াসউদ্দিন নানা অজুহাতে তাঁর পুত্রকে দিল্লি পাঠাতে অস্বীকার করেন। ক্ষুব্ধ সম্রাট তাকে দমন করার জন্য নিজ ভ্রাতা বাহরামকে সোনারগাঁ প্রেরণ করেন। তিনি বিদ্রোহী গিয়াসউদ্দিনকে পরাজিত করে তার গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে তা সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দেন।

ড. মেহদী হোসেনের মতে, মহম্মদের বিরুদ্ধে পঞ্চম বিদ্রোহ ঘটেছিল সিওয়ান (Schwan) প্রদেশে। বিদ্রোহের কারণ হিসেবে তিনি লিখেছেন যে, সুলতান জনৈক হিন্দু রতনকে সিওয়ান প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত করলে উনুর এবং রুমীর নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়। তারা রতনকে হত্যা করে উনুরকে সিওয়ান-এর গভর্নর নিযুক্ত করে। কিন্তু উনুর নিজের করুণ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সিওয়ান ছেড়ে পালিয়ে যান। এখন বিদ্রোহীরা রুমীকে নেতা মনোনীত করে। মুলতানের গভর্নর মালিক সারতাজ এই বিদ্রোহের সংবাদ পাওয়ামাত্র সিওয়ানে উপস্থিত হয়ে বিদ্রোহীদের হত্যা করেন। ইবন বতুতা সিওয়ানে পদার্পণ করে ক্রুশবিদ্ধ বিদ্রোহীদের সারিবদ্ধ মৃতদেহ লক্ষ্য করেছিলেন। তাই অনুমিত হয়, ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল।

মহম্মদ-বিন-তুঘলকের বিরুদ্ধে পরবর্তী বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল দোয়াব অঞ্চলে। সুলতান সেখানে নতুন করে কর বসালে কৃষকরা বিদ্রোহী হয় এবং ঘরবাড়ি, জমি ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে থাকে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আগেই করা হয়েছে। যাই হোক্, সুলতান শেষ পর্যন্ত কঠোরতা ত্যাগ করে সহানুভূতির সাথে দোয়াবের কৃষকদের সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করেছিলেন।

দোয়াবের কৃষক-বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে সুলতান যখন উজ্জয়িনীতে অবস্থান করছিলেন, তখন সুদূর দক্ষিণে মাবারের শাসনকর্তা সৈয়দ আহশান শাহ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন (১৩৩৪-৩৫ খ্রিঃ)। দিল্লি থেকে মাবারের দুরত্ব, দোয়াব, মালব, পূর্ব পাঞ্জাবের দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সম্ভবত আহশান শাহ’কে বিদ্রোহী হতে প্ররোচিত করে। মহম্মদ তুঘলক বিদ্রোহের সংবাদ পাওয়া মাত্র কনৌজ থেকে দিল্লিতে ফিরে আসেন এবং সসৈন্যে মাবারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে দৌলতাবাদে উপস্থিত হন। সেখান থেকে তিনি বরঙ্গলে আসেন। কিন্তু এখানে তিনি স্বয়ং এবং তাঁর সেনাবাহিনী ভয়াবহ প্লেগ রোগে আক্রান্ত হন। সুলতান ভাগ্যক্রমে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেও, তাঁর সেনাবাহিনীর বহু সদস্য প্রাণ হারায়। সুলতানের বিশ্বস্ত আমলাদের প্রায় অর্ধেক এবং সেনাবাহিনীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান। এমতাবস্থায় সুলতান মাবার অভিযান বাতিল করে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। মাবার স্বাধীন হয়ে যায়। আহশান শাহ মাদুরায় স্বাধীন-সুলতানির সূচনা করেন। দৌলতাবাদে পৌঁছে মহম্মদ তুঘলক দক্ষিণের রাজ্যগুলির দায়িত্ব বাৎসরিক রাজস্ব প্রদানের শর্তে তাঁর বিশ্বস্ত আমিরদের হাতে ন্যস্ত করেন। মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত সুলতান দিল্লির ইচ্ছুক নাগরিকদের দিল্লিতে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেন।

ড. নিজামীর মতে, ১৩৩৫ খ্রিস্টাব্দের পর মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের সামরিক ক্ষমতা এমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। প্রাদেশিক শাসকদের সাহায্যে বিদ্রোহ দমন করা সুলতানের পক্ষে ছিল দুরূহ। এই সময়ে সুলতানি সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক জীবনে দুটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন- (১) সুলতান সামান্যতম সন্দেহ হলেই যে-কোনো ব্যক্তিকে কঠোর শাস্তি দিতে শুরু করেন। তিনি ভেবেছিলেন, নৃশংসতা দ্বারা অন্তত কিছুদিন বিক্ষুব্ধদের দমন করে রাখা যাবে। কিন্তু এর ফলে বহু নিরপরাধ ব্যক্তিও সুলতানের রোষের শিকার হয়। (২) সুলতানের সামরিক দুর্বলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার ফলে বহু অভিজাত সংগঠিত বিদ্রোহের দিকে এগিয়ে যান। কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন যে, অকারণে সুলতানের অত্যাচারের মুখে পড়ার থেকে বিদ্রোহ করে নতুন জীবনের সন্ধান করাই ভালো। ধর্মান্তরিত মোঙ্গল নেতা হলাকু, দৌলতাবাদের শাসক মালিক হুসাং এবং সুলতানের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা মাসুদ খাঁ প্রমুখের বিদ্রোহগুলিকে (১৩৩৫-৩৬ খ্রিঃ) এই বৈশিষ্ট্যের নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।

একই ধারায় বহিঃপ্রকাশ দক্ষিণ ভারতে ছিল আরও স্পষ্ট। তবে এখানকার বিদ্রোহ বা আন্দোলন অন্য কারণে ছিল নতুন। পূর্বে বর্ণিত বিদ্রোহগুলির নায়ক ছিলেন মুসলমান; কিন্তু দক্ষিণের আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন হিন্দু নায়েকগণ। ড. রমেশচন্দ্র মুজমদার হিন্দু নায়েকদের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মধ্যে ‘হিন্দু জাগরণবাদ’-এর আভাস লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি লিখেছেনঃ “It appears that the organisation of a sort of Hindu Confederacy was attempted in the south in order to free the country from the yoke of the Muslims.” এই সংঘের উদ্যোক্তা ছিলেন দক্ষিণ অন্ধ্রের জনৈক প্রলয় নায়ক। তাঁর প্রধান সহায়ক ছিলেন প্রলয় ভেমা এবং ভক্তিরাজা নামক দুই দক্ষিণী রাজপুরুষ। প্রবল নায়কের নেতৃত্বে হিন্দুরা অন্ধ্র-উপকূল অঞ্চল থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। অতঃপর প্রলয়ের ভ্রাতুষ্পুত্র কৃষ্ণ নায়কের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে হিন্দু প্রতিরোধ আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে মহম্মদ তুঘলক তেলেঙ্গানা অঞ্চলকে দুটি প্রশাসনিক এককে বিভক্ত করেন। বরঙ্গল ও কাম্পিলিতে সদর দপ্তর করে দুটি বিভাগের দায়িত্ব দুজনের ওপর ন্যস্ত করেন। কিন্তু কৃষ্ণ নায়ক ও হোয়সলরাজ তৃতীয় বল্লালের নেতৃত্বে প্রায় ৭৫ জন হিন্দু-নায়েকের শক্তিসংঘ বরঙ্গলের শাসক মালিক মকবুলকে বিতাড়িত করে অন্ধ্রকে মুসলিম শাসনমুক্ত করে। একইভাবে চালুক্য সোমদেব এবং প্রলয় ভেমার নেতৃত্বে কাম্পিলিতেও হিন্দুরা সুলতানি শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মহম্মদ তুঘলক কাম্পিলির ধর্মান্তরিত দুই রাজপুত্র হরিহর এবং বুক্ককে মালিক মহম্মদের পরিবর্তে কাম্পিলির শাসক ও উপশাসক নিয়োগ করে হিন্দু প্রতিরোধকে সামাল দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এবারেও হিন্দুরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইতিমধ্যে হরিহর ও বুব্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মাধব বিদ্যারণ্যের সংস্পর্শে এসে মতপরিবর্তন করেন। এঁরা ইসলামধর্ম ত্যাগ করে পুনরায় হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন এবং হিন্দু জাগরণের নেতা হিসেবে ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন বিজয়নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। এইভাবে মহম্মদ-বিন্-তুঘলক দাক্ষিণাত্যে দিল্লি-সুলতানির কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত করার দশ বছরের মধ্যেই আপন দুর্বলতার জন্য সেখান থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। কৃষ্ণা-তুঙ্গভদ্রার সমগ্র দক্ষিণভাগ, বরঙ্গলের একাংশ এবং অন্ধ্রের উপকূল অঞ্চল দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের বাইরে চলে যায়।

কেবল দক্ষিণ ভারত নয়, উত্তর, পূর্ব এবং মধ্য ভারতেও বিদ্রোহের আগুন সুলতানকে বিব্রত করে সুলতান বরঙ্গল থেকে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করে এক সর্বনাশা দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর মুখোমুখি হন। জীবন রক্ষার তাগিদে সুলতান তাঁর পরিবারবর্গ এবং সভাসদদের নিয়ে সামসাবাদের সন্নিকটে ‘স্বর্গদ্বারি’ নামক নবনির্মিত শহরে এসে কিছুদিন অতিবাহিত করেন। এই সময় বাংলা, মুলতান, গুজরাট, সামানা, কারা, বিদর, গুলবর্গা, অযোধ্যা প্রভৃতি স্থানে সংঘটিত বিদ্রোহ সুলতানকে বিব্রত করতে থাকে।

দিল্লি থেকে দূরত্বের কারণে বাংলাদেশ কোনোদিনই দিল্লির কার্যকর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকেনি। তুঘলক আমলে বাংলাকে তিনভাগে বিভক্ত করে শাসন করার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থাও স্থায়ী হতে পারেনি। সুলতানের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা বাহরাম খাঁ মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শিলদার মালিক ফকরউদ্দিন নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন (১৩৩৮-৩৯ খ্রিঃ) এবং ‘সুলতান ফকরউদ্দিন’ উপাধি নিয়ে সোনারগাঁ শাসন করতে শুরু করেন। লখনৌতির শাসক কদর খাঁ ফকরউদ্দিনকে জব্দ করার জন্য উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাঁর ব্যবহারে সেনাদল অসন্তুষ্ট ছিল। ফলে তিনি সহজেই ফকরউদ্দিনের হাতে নিহত হন এবং লখনৌতি ফকরউদ্দিনের হস্তগত হয়। সুলতান মহম্মদ তুঘলক রাজ্যের খরা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি দিতে পারেননি। ফলে সোনারগাঁ ও লখনৌতি দিল্লির হাতছাড়া হয়ে যায়। মালিক হাজি ইলিয়াসের নেতৃত্বে পরবর্তীকালে বাংলায় একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়।

বাংলার বিদ্রোহের অব্যবহিত পরেই (১৩৪০-৪১ খ্রিঃ) অযোধ্যা ও জাফরাবাদের শাসক আইন উল-মুল্ক-এর সাথে সুলতানের বিরোধ বাধে। দোয়াবের দুর্ভিক্ষ কিংবা কারার শাসক নিজাম মিঞার বিদ্রোহদমনের সময় আইন-উল-মুল্ক নানাভাবে সুলতানকে সাহায্য করেছিলেন। স্বভাবতই উভয়ের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু আইন-উল-মুল্ক-এর শক্তি ও সম্পদ সুলতানকে সন্দিগ্ধ করে তুলেছিল। পরস্তু দিল্লি, দোয়াব অঞ্চল থেকে আগত বহু অভিজাতকে তিনি অযোধ্যায় পুনর্বাসিত করেন, যদিও সুলতান এই কাজ নিষিদ্ধ করেছিলেন। ক্ষুব্ধ সুলতান আইন-উল-মুল্ককে জব্দ করার জন্য দৌলতাবাদের শাসক নিযুক্ত করেন। অবশ্য শাসক হিসেবে আইন-উল-মুল্ক ছিলেন পারদর্শী এবং তখন দৌলতাবাদে তাঁর মতো দক্ষ ও অভিজ্ঞ শাসকের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সুলতানের দুরভিসন্ধি জানতে পেরে তিনি দৌলতাবাদে যেতে অস্বীকার করেন। সুলতানি বাহিনী তাঁকে অল্প আয়াসে বন্দি কবে দিল্লিতে নিয়ে আসে। সুলতান অবশ্য বিশ্বস্ত মালিকদের সাথে আলোচনা করে আইন-উল মুলকের অপরাধ তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য মাপ করে দেন।

প্লেগ, অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ এবং বিদ্রোহের উপর্যুপরি ঢেউ, এই পর্যায়ে এসে, মহম্মদ তুঘলকের মনে কিছুটা ভাবান্তর এনেছিল। সুলতান উপলব্ধি করেন যে, কেবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা ক্ষোভের রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশ রূপে বিদ্রোহগুলি সংগঠিত হচ্ছে না। উলেমা, কাজি প্রমুখ মুসলিম ধর্মগুরুদের ইন্ধনও বিদ্রোহগুলিকে সংগঠিত হতে সাহায্য করছে। তাই সুলতান দীর্ঘ ঔদাসীন্যের পর খলিফার অনুমোদন লাভের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠেন। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাবংশ তখন নেই। মিশরে ছিল ফতেমীয় খলিফাদের অবস্থান। তাই সুলতান মিশরের খলিফার অনুমোদন প্রার্থনা করেন এবং নিজ মুদ্রায় খলিফার নাম খোদাই করে তাঁকে আনুগত্য ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। ১৩৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ তুঘলক খলিফার ‘মনশুর’ বা পরোয়ানা পান। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উগ্র সমর্থক মহম্মদ-বিন্-তুঘলক অকস্মাৎ খলিফার অনুমোদন লাভের জন্য এত ব্যগ্র হলেন কেন—এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। শিরাত ই-ফিরোজশাহি গ্রন্থের মতে, সুলতান নানা গ্রন্থ পাঠ করে নিশ্চিত হন যে, খলিফার অনুমোদন ছাড়া তাঁর পক্ষে রাজনৈতিক ন্যায়বিধান করা সম্ভব হবে না। ‘তারিখ-ই-আলফী’র মতে, সুলতানের শিক্ষক কুতলঘ খাঁ এ কাজে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু ড. নিজামীর মতে, সুলতান তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক জটিলতম মুহূর্তে খলিফার কথা চিন্তা করেছিলেন। তাই এটিকে কেবল ধর্মীয় প্রেরণাসঞ্জাত বলা চলে না। সুলতান তাঁর বিরুদ্ধে সংগঠিত বিদ্রোহের ঢেউ ভাঙার জন্য একটা অস্ত্র হিসেবেই খলিফার অনুমোদনের কথা ভেবেছিলেন। বদর-ই-চাচ-এর মন্তব্যেও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়।

এই সময় দৌলতাবাদ এবং গুজরাট ছাড়া প্রায় সারা দেশই দিল্লি-সুলতানির কর্তৃত্বমুক্ত হয়ে গিয়েছিল। মহম্মদ তুঘলকের কয়েকটি হটকারী সিদ্ধান্ত এই দুটি সুলতানি রাজ্যেও বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে এবং সেই আগুনই সুলতান মহম্মদ-বিন্-তুঘলককে গ্রাস করে। এই দুটি অঞ্চলে ‘সদাহ আমির’ (আমিরান-ই-সদাহ) নামক একশ্রেণির মুসলিম কর্মচারী রাজকার্যে নিয়োজিত ছিল। এরা ছিল সম্ভবত বিদেশি এবং মোঙ্গলদের মধ্য থেকেই এদের সৃষ্টি হয়েছিল। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, এরা একশত জন সৈন্যের অধিনায়ক ছিল, নাকি একশত গ্রামের নিয়ন্ত্রক ছিল— তা বলা কঠিন। তবে এরা যে সামরিক ও অসামরিক উভয় কাজের দায়িত্ব পালন করত এরূপ মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। যাই হোক্, সুলতান দৌলতাবাদের অভিজ্ঞ শাসক কুতলঘ খাঁ’কে অপসারিত করে তাঁর ভাই নিজামউদ্দিনকে ওই পদে বসালে সদাহ আমিররা ক্ষুব্ধ হয়। কারণ কুতলুঘ খাঁ নানা সময়ে সুলতানের রোষ থেকে এই বহিরাগত আমিরদের রক্ষা করতেন। এখন কুতলঘ খাঁ’র অপসারণের ঘটনায় তারা সুলতানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়।

সদাহ আমিরদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয় সুলতানের আর একটি সিদ্ধান্তে। সুলতান এই সময় আজিজ খামার নামক জনৈক ব্যক্তিকে মালবের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। সুলতান সদাহ আমিরদের কাজকর্ম সম্পর্কে সচেতন থাকতে এবং সামান্যতম সন্দেহ হলে তাদের কঠোর শাস্তি দেবার নির্দেশ দেন। আজিজ রাজ্যে পৌঁছেই নানাভাবে সদাহ আমিরদের বিব্রত করতে থাকেন। সন্দেহবশত তিনি ৮৯ জন সদাহ আমিরকে হত্যা করেন। এই কাজের জন্য সুলতান আজিজকে নানা সম্মানে ও পুরস্কারে অভিনন্দিত করেন। এই ঘটনা দৌলতাবাদ থেকে গুজরাট সর্বত্রই সদাহ আমিরদের মধ্যে ভীতি ও ক্ষোভ সঞ্চার করে। তারা বিদ্রোহমুখী হয়ে ওঠে। ড. নিজামীর ভাষায়: “Their petty acts of insubordination and misbehaviour were now replaced by organised rebellions and pitched battles.” গুজরাটের নায়েব উজির মুকবিল-এর বিরুদ্ধে দাভোয় এবং বরোদায় সদাহ আমিররা সংঘবদ্ধ হয়ে সরকারি কোষাগার লুঠ করে এবং বহু সরকারি কর্মীকে বন্দি করে। জুরানবল, কাজি জালাল, ইবন লালা এবং ঝুল্লা’র নেতৃত্বে বিদ্রোহী আমিররা ক্যাম্বেতে উপস্থিত হয় এবং প্রাক্তন সাহানা-ই-বার্গ তাঘীকে বন্দিমুক্ত করে নিজেদের বিদ্রোহের সামিল করে নেয়। কিন্তু তাঘী বিদ্রোহীদের সঙ্গ ত্যাগ করে পালিয়ে যান এবং মুকবিলের সাথে যোগ দেন। বিদ্রোহীদের দমন করার উদ্দেশ্যে আজিজ খামার সসৈন্যে গুজরাটে উপস্থিত হন। ইসামীর মতে, সুলতানি সৈন্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয় হাজারে। কিন্তু বিদ্রোহীদের সৈন্য ছিল সাকুল্যে সাতশো! কিন্তু এই অসমযুদ্ধেও সদাহ আমিররা বিজয়ী হয়। আজিজ খামার বন্দি ও নিহত হন। মুকবিল সমস্ত রসদ, অর্থ ইত্যাদি বিদ্রোহীদের হাতে তুলে দিয়ে রক্ষা পান।

আজিজের মৃত্যসংবাদ পাওয়ার পর সুলতান দিল্লি থেকে গুজরাটের উদ্দেশ্যে রওনা হন বলে ইসামী লিখেছেন। কিন্তু বারাণীর মতে, এই সময় সুলতানপুরে ঘাঁটি গেড়ে তিনি গুজরাটের পরিস্থিতির ওপর লক্ষ্য রাখছিলেন। যাই হোক্, মালিক কবিরের হাতে দিল্লির দায়িত্ব ন্যস্ত করে সুলতান গুজরাটের দিকে রওনা হন। সদাহ আমিরদের বিদ্রোহের ক্ষেত্র ছিল নানা অংশে প্রসারিত। তাই সুলতান একই সাথে বহুমুখী আক্রমণ রচনার কৌশল নেন। ইসামী লিখেছেন: সুলতান নাগৌর থেকে আজম মালিককে ব্রোচে পাঠান, মাউন্ট আবু থেকে শেখ মুইজউদ্দিনকে পাঠান অনহিলবারার উদ্দেশ্যে এবং ব্রোচ থেকে মালিক মুকবিলকে পাঠান দৌলতাবাদে। ব্রোচ-এর যুদ্ধে বিদ্রোহী আমির ঝুল্লা নিহত হয় এবং অন্যেরা ছত্রভঙ্গ অবস্থায় নানা দিকে পালিয়ে যায়।

এই সময় সুলতানের একটা ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত দৌলতাবাদের পরিস্থিতিকে আবার অগ্নিগর্ভ করে তোলে। সুলতান দৌলতাবাদের শাসনকর্তা আইন-উল-মুল্ক-এর কাছে এক গোপন নির্দেশ পাঠিয়ে সেখানকার সদাহ আমিরদের ব্রোচে পাঠাতে বলেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আইন-উল-মুল্ক সুলতানের নির্দেশ পালন করেন। কিন্তু ব্রোচের উদ্দেশ্যে কিছুটা অগ্রসর হবার পরেই আমিরগণ সুলতানের অশুভ উদ্দেশ্য বুঝতে পারে এবং সুলতানের প্রহরীদের হত্যা করে দৌলতাবাদ আক্রমণ করে। তিন দিন যুদ্ধ করে দৌলতাবাদ তাদের অধীনে আসে। অবশ্য আইন-উল-মুল্ককে বন্দি করেও, তাঁকে নিরপরাধী বিবেচনা করে বিদ্রোহীরা মুক্তি দেয়। অতঃপর বিদ্রোহী আমিররা মালিক ইসমাইল মুখ নামক জনৈক আফগানীকে তাদের শাসক মনোনীত করে। এই ব্যর্থতার সংবাদে সুলতান এতটাই বিচলিত হন যে, তিনি তিন দিন তিন রাত নিদ্রাহীন অবস্থায় কাটিয়ে দেন। অতঃপর ছ’মাস ধরে তিনি সৈন্য সংগ্রহ করে। দৌলতাবাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। দৌলতবাদ ও গুলবার্গ থেকে সুলতান সাফল্যের সাথে বিদ্রোহীদের বিতাড়িত করে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। এই সময়ে তিনি গুজরাট থেকে তাঘীর বিদ্রোহের সংবাদ পান এবং তৎক্ষণাৎ গুজরাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এদিকে সুলতান দৌলতাবাদ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহী আমিররা সুলতানের প্রতিনিধি ইমাদ-উল-মুল্ককে পরাজিত ও বিতাড়িত করে দৌলতাবাদ দুর্গ পুনরাধিকার করে। এবারে বিদ্রোহীরা হাসান গম্বুকে তাদের নেতা মনোনীত করে। হাসান আলাউদ্দিন আবুল মুজফর বাহমন শাহ উপাধি নিয়ে দাক্ষিণাত্যে বাহমনী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন (১৩৪৭ খ্রিঃ)। বারাণীর মতে, সুলতান মহম্মদ তুঘলক তখন এতটাই শ্রান্ত, ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত ছিলেন যে, দক্ষিণ ভারতের ওপর সত্বর দিল্লির আধিপত্য পুনরুদ্ধারে কোনো চেষ্টাই আর করেননি।

বিদ্রোহী তাঘীর বিরুদ্ধে অভিযানই ছিল মহম্মদ-বিন-তুঘলকের জীবনের শেষ সামরিক কর্মসূচি। তাঘী ছিলেন শক্তিহীন, কিন্তু চতুর। তাই সুলতানের মুখোমুখি না হয়ে তার্থীস্থান থেকে স্থানান্তরে আত্মগোপন করে সুলতানের ধৈর্য ও শক্তি ক্ষয় করতে থাকেন। ব্রোচ থেকে ক্যাম্বে, সেখান থেকে অসওয়াল হয়ে পাতন, এবং শেষ পর্যন্ত গিরনার হয়ে সিন্ধুদেশে চলে আসেন তাঘী। সুলতানও মরিয়া হয়ে এবং প্রচণ্ড অসুস্থতা সত্ত্বেও সিন্ধুর উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু থাট্টার সন্নিকটে সোণ্ডা নামক স্থানে পৌঁছে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক সপ্তাহ পরে সেখানেই প্রাণত্যাগ করেন (২০শে মার্চ, ১৩৫১ খ্রিঃ)।