মহম্মদ ইসামী:
আসল নাম তাখাল্লাস, ইসামী ছদ্মনাম। ইসামীর বিখ্যাত ইতিহাসমূলক গ্রন্থ ফুতূহ-উস-সালাতিন (ফুঁতু-অল-সালাতিন)। মহম্মদ-বিন-তুঘলকের রাজত্বের শেষ দিকে ইসামী এই গ্রন্থ রচনা সম্পূর্ণ করেছিলেন। এতে সুলতান মামুদ থেকে মহম্মদ তুঘলকের আমল পর্যন্ত প্রায় তিনশো পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ফিরদৌসীর ‘শাহনামা’র অনুকরণে ইসামী ছন্দে তাঁর বইটি লিখেছেন। প্রায় এগারো হাজার কবিতার চরণ তিনি রচনা করেছেন। ‘ফুতুহ’ রচনার আগেই তিনি দিল্লি ছেড়ে নব্য স্বাধীন বাহমনী রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই গ্রন্থটি তিনি সুলতান আলাউদ্দিন বাহমান শাহকে উৎসর্গ করেন। এক বিশেষ কারণে ‘ফুতুহ্-উস্- সালাতিন’ গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ। মিনহাজউদ্দিনের ‘তবাকত-ই-নাসিরী’ এবং বারাণীর ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’ গ্রন্থ দুটির যোগসূত্র হিসেবে ইসামীয় রচনাটি বিবেচিত হয়। মিনহাজউদ্দিন আলোচনা করেছেন সুলতান নাসিরুদ্দিনের রাজত্বের প্রথম কয়েক বছর পর্যন্ত। অন্যদিকে বারাণী তাঁর লেখা শুরু করেছেন বলবনের শাসনকাল থেকে। এদের মধ্যবর্তী কয়েক বছরের শূন্যস্থান পূরণ করেছে ইসামীর ‘ফুতুহ-উস্-সালাতিন।
ইসামী তাঁর গ্রন্থের শুরুতে আদম থেকে শুরু করে ইরাণীয় বীর কায়ুমার্থ, আলোকজান্ডারের ইরাণ আক্রমণ, পয়গম্বর ও খলিফাদের বিবরণ সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। তারপর ভারতে মুসলমান শাসকদের গৌরবকাহিনি সবিস্তারে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইসামী গজনীর সুলতান মামুদের ভারত বিজয়ের প্রশংসা করেছেন। প্রশংসা পেয়েছেন মহম্মদ ঘুরি থেকে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক পর্যন্ত সকল সুলতান। দিল্লির সুলতানদের বীরত্ব কাহিনি, দানশীলতা, সদাশয়তা, ন্যায় বিচার ইত্যাদির তিনি প্রশংসা করেছেন। কিন্তু মহম্মদ তুঘলকের দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের ঘটনাকে তিনি নিন্দা করেছেন। এই ঘটনায় তাঁর পিতা পথশ্রমে মারা গিয়েছিলেন বলে ইসামী উল্লেখ করেছেন। তাই ব্যক্তিগত বেদনা থেকে তিনি সুলতানকে হটকারী বলে অভিহিত করেছেন।
ইসামীর ইতিহাসচর্চায় ধর্ম, ঈশ্বর, নিয়তি, নৈতিকতা, যাদুবিদ্যা সবকিছুই স্থান পেয়েছে। তাঁর মতে, ঈশ্বর হলেন স্রষ্টা এবং মানুষের সুখ-দুঃখের নিয়ামক। তাঁর কাছে সত্য, ন্যায়পরায়ণতার ধারণা সবই এসেছে ইসলামী শাস্ত্র থেকে। সেই ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ হলেন পয়গম্বর মহম্মদ। অর্থাৎ নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাসবোধের পরিবর্তে ইসলামীয় বিশ্ববীক্ষার কাঠামোর মধ্যেই তিনি ইতিহাসের উপাদান খুঁজতে প্রয়াসী ছিলেন। সুন্নীদের পাশাপাশি সুফী সাধকদের ধর্ম ও সমাজ ভাবনারও তিনি প্রশংসা করেছেন। জালালউদ্দিন খলজি কর্তৃক সিধি মৌলার হত্যাকাণ্ড কিংবা মহম্মদ তুঘলকের আমলে সুফী সাধক নিজামুল হকের দিল্লি ত্যাগের ঘটনাকে ইসামী সুলতানী শাসনের দুর্ভোগের কারণ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
ইসামীর রচনাশৈলী আকর্ষণীয়। মধুর বাক্যবিন্যাস দ্বারা তিনি ঘটনাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁর রচনার ইতিহাসগত গুণাবলীর অভাব স্পষ্ট। ইসামী ঘটনা-ভিত্তিক (episodic) ইতিহাস লিখেছেন। তাঁর রচনায় ধারাবাহিকতা নেই। বর্ণিত ঘটনাবলীর মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার বা রক্ষার তাগিদ তিনি অনুভব করেন নি। কোনো ঘটনার তারিখ তিনি উল্লেখ করেন নি। আলাউদ্দিন খলজীর শুধুমাত্র মৃত্যু তারিখটি উল্লেখ করেছেন। কালানুক্রমিকতা যে ইতিহাস রচনার একটি অপরিহার্য শর্ত, একথা তিনি উপলব্ধি করেন নি। কাব্যের ছন্দ মেলানোর প্রয়োজনে তিনি ‘একদিন’, ‘কয়েকদিন’ ইত্যাদি ভাববাচক, শব্দ ব্যবহার করেছেন। ফলে তাঁর ‘ফুতুহ-উস্-সালাতিন’ ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে অনেকটাই দূর্বলতায় আকীর্ণ। বাস্তবতার পরিবর্তে ইসামী ঈশ্বরের ইচ্ছাকে ঘটনাপ্রবাহের মূল শক্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ইলতুৎমিসের প্রতিদ্বন্দ্বী নাসিরুদ্দিন কুবাচার নদীতে ডুবে মৃত্যু, বলবনের হাতে বিদ্রোহী তুমিল খাঁ’র মৃত্যু, কিংবা সোমনাথ অভিযান থেকে ফেরার সময় সুলতান মামুদের সেনাবাহিনীর জলকষ্টের মধ্যে পড়া এবং তা থেকে মুক্তিলাভ সবকিছুতেই তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখেছেন। ইসামী তাঁর বিবরণীর সূত্র হিসেবে উপাদানের উল্লেখ করেননি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি ‘আমি শুনেছি’ বলেছেন। আসলে তিনি সাহিত্যিক হতে চেয়েছেন, ঐতিহাসিক নয়। অধ্যাপক মেহদি হুসেনের মতে, ইসামীর ‘ফুতুহ’ হল মধ্যযুগের ভারতের ‘শাহনামা’। তাঁর রচনা নীতিকথা নয়, ধর্মশাস্ত্রও নয়; এটি আসলে একটি আকর্ষণীয় মহাকাব্য। তাই ফুতুহ উস্-সালাতিন’ ‘ইতিহাস গ্রন্থ নয়। তবে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এর গুরুত্ব কম নয়।
তুর্কি-আফগান সুলতানদের কেউ কেউ আত্মজীবনীমূলক সাহিত্য রচনায় আগ্রহী ছিলেন। এঁদের রচনাও নির্বাচিতভাবে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে উপযোগী। এ ধরনের একটি অতি বিখ্যাত গ্রন্থ হল সুলতান ফিরোজ শাহ্ তুঘলকের আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘ফুতুহ্-ই-ফিরোজশাহি’। এ ছাড়া ফিরোজ তুঘলকের রাজত্বকালে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি গ্রন্থ হল ‘শামস্-ই-সিরাজ আফিক’ রচিত ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি’ এবং অজ্ঞাতনামা সমকালীন জনৈক লেখকের ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজশাহি। সৈয়দ বংশের শাসনাধীন পর্বের ইতিহাসমূলক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল ইয়াহিয়া-বিন-আহমদের ‘তারিখ-ই-মুবারকশাহি’। ঘটনার উপস্থাপনা এবং সময়কাল নির্দেশের ক্ষেত্রে গ্রন্থটির সততা সর্বজনস্বীকৃত। আব্বাস শেরওয়ানীর ‘তারিখ-ই-শেরশাহি, নিয়মাউল্লাহর ‘মাঘজান-ই-আফগান’ (১৬২৬ খ্রিঃ)। আবদুল্লা রচিত ‘তারিখ-ই-দাউদি’ (১৬২৭ খ্রিঃ) প্রভৃতি গ্রন্থ পরবর্তীকালে রচিত হলেও তুর্কি-আফগান শাসনের শেষ পর্ব বিশেষত লোদীবংশের রাজত্বকালের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
Leave a comment