অথবা, মনের স্বরূপ সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদগুলাে ব্যাখ্যা মূল্যায়ন কর।
ভূমিকাঃ দর্শনের বিভিন্ন আলােচ্য বিষয়ের মধ্যে মনসম্পর্কিত আলােচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাকে কেন্দ্র করে মনােদর্শনের উৎপত্তি হয়েছে। এই মনােদর্শন সাম্প্রতিককালে দর্শনের বিশিষ্ট শাখা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন মনীষী মনের স্বরূপ কী বা মনের সাথে বস্তুর সম্পর্ক কী এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন। ফলে মন সম্পর্কে দর্শনের ইতিহাসে বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। নিম্নে সেই মতবাদগুলাে আলােচনা করা হলাে-
(১) মন সম্পর্কে আদি মতবাদঃ প্রাচীনকালে লােকেরা আত্মাকে দেহের ছায়াময় প্রতিরূপ বলে কল্পনা করত। প্রাচীন গ্রিক দর্শনে আত্মা বলতে এক জড় পদার্থকেই বােঝাত। যেমনঃ এনাক্সিমিনিস ‘বায়ু’কে আত্মা বলেন। হিরাক্লিটাস আত্মাকে ‘অগ্নি’ বলে মনে করেন। এনাক্সাগােরাস মন নামক অতি সূক্ষ্ম বস্তুকে আত্মা বলে স্বীকার করেন। সুতরাং তাদের মতে, আত্মা স্বরূপত জড়াত্মক। গ্রিক পদার্থবিদরাও মন ও জড়কে অভিন্ন সত্তা বলে মনে করতেন।
(২) মনের স্বরূপ সম্পর্কে আধ্যাত্মিক মতবাদঃ মানুষ প্রতি মুহূর্তে অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। এই অভিজ্ঞতা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। কিন্তু অভিজ্ঞতার ভিন্নতার দরুন মন ভিন্ন হয় না। মন বা আত্মা অভিন্ন, অপরিবর্তনীয় ও স্থায়ী থাকে বলেই বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আমাদের মনে থাকে। কাজেই আত্মাকে অপরিবর্তনীয় স্থায়ী আধ্যাত্মিক দ্রব্য বলা উচিত। দর্শনের ইতিহাসে এই মতবাদের প্রাচীন ও আধুনিক রূপ দেখতে পাই।
(৩) মনের স্বরূপ সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদঃ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক ডেভিড হিউম হচ্ছেন আত্মা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যার জনক। তার মতে, অভিজ্ঞতাই জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায়। যা অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায় না তার কোনাে অস্তিত্ব নেই। তিনি বলেন, অভিজ্ঞতায় আমরা কোনাে অপরিবর্তিত আত্মার সাক্ষাৎ পাই না। অভিজ্ঞতায় আমরা যে আত্মার দেখা পাই তা হলাে, আমাদের মানসিক বৃত্তিগুলাের সমষ্টি। তিনি বলেন, মন বা আত্মা কোন আধ্যাত্মিক দ্রব্য নয়। মন হচ্ছে কেবল সংবেদনের সমষ্টি মাত্র। তিনি মনে করেন, মন হলাে একটা রঙ্গমঞ্চ। রঙ্গমঞ্চে যেমন একটার পর একটা ঘটনা ঘটে চলেছে তেমনি আমাদের অভিজ্ঞতাও একটার পর একটা হয়ে চলেছে। এই অভিজ্ঞতার সমষ্টি বা সংবেদনের সমষ্টিকেই তিনি মন বলে অভিহিত করেছেন। এ ছাড়া অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল বলেন, সংবেদন এবং অন্তর অনুভূতিগুলাে যেভাবে ঘটে তাদের সম্ভাবনাই হলাে মন। জেমস আত্মা বা মনকে চৈতন্যপ্রবাহ বলে মনে করেন। তিনি বলেন, মন বিচ্ছিন্ন সংবেদনের সমষ্টি নয়। ‘মন’ হচ্ছে চৈতন্যের অখণ্ড ও অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ।
(৪) আত্মা সম্পর্কে কান্টের মতবাদ/অতীন্দ্রিয় মতবাদঃ অতীন্দ্রিয় মতবাদের জনক হচ্ছেন জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। তিনি আত্মা সম্পর্কে বলেন, আত্মা একটা আধ্যাত্ম দ্ৰব্য নয়, অন্যদিকে কতকগুলাে বিচ্ছিন্ন দ্রব্যের সমষ্টিও নয়। মন বা আত্মা হলাে একটা অতীন্দ্রিয় সত্তা, যা বিভিন্ন সংবেদনের অতিরিক্ত এক সংশ্লেষণমূলক ঐক্য-বিধায়ক প্রক্রিয়া বা সংপ্রত্যক্ষণের সংশ্লেষণী একত্ব, যা বিচ্ছিন্ন সংবেদনের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপন করে আমাদের অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের পথকে সুগম করে তােলে।
(৫) আত্মা সম্বন্ধে ভাববাদী মতবাদঃ হেগেল আত্মা সম্পর্কে ভাববাদী মত দেন। তিনি মনে করেন, সমস্ত সৃষ্টিই মন বা আত্মা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। আর বিশ্বজগৎহলাে আত্মার মধ্যে মূলীভূত। তার মতে, আত্মাকে নিষ্ক্রিয় আধ্যাত্মিক সত্তা বলার কোনাে অর্থ নেই, সংবেদনের সমষ্টি বলারও কোনাে যৌক্তিকতা নেই। আবার আত্মাকে অভিজ্ঞতার সমষ্টির অতিরিক্ত কোনাে পৃথক ঐক্য-বিধায়ক সত্তা মনে করারও কোনাে যৌক্তিকতা নেই। এক ঐক্য-বিধায়ক প্রক্রিয়ার দ্বারা, ঐক্যবদ্ধ অভিজ্ঞতার সমষ্টিই হলাে আত্মা। তিনি আত্মাকে পুরুষ বলে অভিহিত করেন। অর্থাৎ আত্মাকে পুরুষ করে তােলার এ জন্যই আত্মা সম্পর্কে হেগেলের মতবাদ পুরুষবাদ নামে পরিচিত।
(৬) আত্মসম্পকীয় জড়বাদী মতবাদঃ জড়বাদীদের মতে, জগতের আদিম সত্তা হলাে জড়। তারা সবকিছুকে জড়ের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। স্বরূপগত কারণেই তারা মন বা আত্মাকে অ-দৈহিক সত্তা হিসেবে গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ তারা মনকেও জড়ের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। জড়ের সাহায্যে মনের এই ব্যাখ্যা বিভিন্ন জড়বাদীর হাতে কিছুটা ভিন্নতা লাভ করলেও তাদের মূল প্রতিপাদ্য একই। প্রাচীন ভারতের সমাজ-ইতিহাস পাঠ করলে জানা যায় যে, লােকায়ত দার্শনিকগণ, বিশেষ করে চার্বাক দার্শনিকগণ মন ও দেহের মধ্যে অভেদ্য কোনাে সীমারেখা টানেননি। তারা মনকে দেহের সমতুল্য বলে মনে করতেন। প্রাচীন গ্রিক পরমাণুবাদীরা মনে করতেন যে, মন পরমাণু দ্বারা গঠিত। বলা বাহুল্য, তাদের পরমাণু ছিলাে জড় পদার্থ। দার্শনিক হাক্সলের মতে, মন হচ্ছে দেহের এমন বস্তু যা স্নায়ুমণ্ডলির জড়শক্তির কল্যাণে আত্মপ্রকাশ করে থাকে। অর্থাৎ হাক্সলের নিকট মন হচ্ছে দেহের উপবস্তু বিশেষ। মনােবিজ্ঞানী জন বি ওয়াটসন, ইভান প্যাভলভ ও অন্যান্য আচরণবাদীর মতে, জীবদেহে তার আচরণ বা ব্যবহার ছাড়া মন বা আত্মা বলে কিছুই নেই। তাদের মতে, বহির্বিশ্বের বিভিন্ন উত্তেজনার বিভিন্ন দৈহিক প্রতিক্রিয়ার সমষ্টির নামই মন। মানসিক অবস্থা ও প্রক্রিয়া বলে যা কথিত, তা আসলে দেহেরই বিভিন্ন কার্য বা ব্যবহার মাত্র। উন্মেষবাদী বিবর্তনবাদী লয়েড মর্গানের মতে, জড়ই বস্তুর আদি সত্তা। মন জড় থেকেই উন্মােষিত একটি গুণ মাত্র। আত্মা বা মনসম্পকীয় জড়বাদীদের মতবাদ সমালােচকের দৃষ্টিতে সন্তোষজনক নয়।
(৭) মন সম্পর্কে প্রয়ােগবাদী মতঃ মন সম্পর্কে প্রয়ােগবাদীদের ধারণা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। তাদের মতে বাস্তব জগতে যার অর্থ ও উপকারিতা আছে তা-ই সত্য। তারা মন সম্পর্কে আলােচনায়ও এই অভিমত ব্যক্ত করেন। তাদের মতে, মন হলাে জীবনের কতিপয় জটিল সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার বা উপকরণ। জীবনে বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিভিন্ন পরিস্থিতির মােকাবিলা করতে হয় এবং তা করতে গিয়ে আমাদের যথেষ্ট অভিযােজনক্ষম হতে হয়। আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে হয়। আর এই অভিযােজনক্ষম ক্ষমতা আসে চিন্তা, চেতনা, কল্পনাপূর্ব অভিজ্ঞতা প্রভৃতি থেকে। এই চিন্তা, কল্পনা ইত্যাদি মানসিক ব্যাপার। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মন তাদের কাছে জৈবিক। সমস্যা সমাধানের একটা হাতিয়ার বা উপকরণ হয়ে দাড়িয়েছে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মন সম্পর্কে ভিন্ন মতামত থেকেই বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। তবে একটার বিরুদ্ধে আরেকটা মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হলেও আগের মতকে একেবারে গুরুত্বহীন বলা যায় না। কেননা আগের মতের ওপর ভিত্তি করেই পরের মতবাদের আবির্ভাব হয়েছে। আলােচ্য মতবাদগুলাের মধ্যে হেগেল মন সম্পর্কিত যে মত দাঁড় করান, সেটাই ঐ সময়ের চূড়ান্ত মতবাদের রূপ লাভ করে। কাজেই তার মতবাদটি খুবই গুরুত্বের দাবিদার।
Leave a comment