সাধারণত মনােযােগ বলতে আমরা বুঝে থাকি, অসংখ্য বিষয়বস্তুর মধ্য থেকে একটি বিশেষ বিষয় নির্বাচন করে নিয়ে তার প্রতি মনকে নিবিষ্ট করা বা নিযুক্ত করা। এই মনােযোগ সম্পর্কে ধারণা গঠন করতে হলে তার বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করা দরকার। বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(১) কেন্দ্রানুগ প্রক্রিয়া : মনােবিজ্ঞানী টিচনার-এর মতে, মনােযােগ প্রক্রিয়ায় আমাদের প্রত্যক্ষণের বিষয়বস্তু চেতনার কেন্দ্রস্থলে উপস্থাপিত হয়। তাই এটি একটি কেন্দ্রানুগ প্রক্রিয়া (Central Process)। এই প্রক্রিয়ায় মনােযােগের শ্রেণিভাগ দুটি এককেন্দ্রিক বৃত্তের মাধ্যমে বােঝানাে হয়েছে। বাইরের অংশটি অবচেতন মন(Unconscious mind) এবং কেন্দ্রটি হল চেতন মন (Conscious mind)।
(২) নির্বাচনধর্মী : অনেকসময় একাধিক উদ্দীপক আমাদের দৃষ্টিগােচর হয়। এইসকল উদ্দীপক মনােযােগ পেতে চায়। কিন্তু এই উদ্দীপকগুলির মধ্যে কয়েকটিকে আমরা নির্বাচন করি ও মনােযােগ দিই। তাই মনােযােগ প্রক্রিয়ার এই বিষয় নির্বাচন একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নির্বাচনি ক্ষমতা একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। আমরা অনেকসময় আন্তরিক চাহিদার দরুন বস্তুনির্বাচন করি, তাই মনােযােগকে এই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা— ঐচ্ছিক মনােযােগ (Voluntary attention) অনৈচ্ছিক মনোযোগ (Non voluntary attention)।
(৩) পরিবর্তনশীলতা : মনােযােগ প্রতিনিয়িত পরিবর্তনশীল। এটি দোলকের মতাে সবসময় আন্দোলিত হতে থাকে। কোনাে নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি তা স্থিরভাবে বসে থাকে না, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে সঞ্চালিত হয়। মনােযােগ কখনাে কোনাে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। স্বাভাবিক নিয়মে অন্য বস্তুতে স্থানান্তরিত হয়।
(৪) পরিসরযুক্ত : চেতনমনের কেন্দ্রে কতকগুলি বিষয় একসঙ্গে স্থাপিত হবে, তা ব্যক্তির মানসিক সংগঠনের উপর নির্ভর করে। ব্যক্তিগত এই বৈশিষ্ট্যকে মনােযােগের পরিসর বলা হয়। যে যন্ত্রের সাহায্যে মনােযােগের পরিসর পরিমাপ করা হয়, তার নাম ট্যাচিটোস্কোপ (Tachistoscope)।
(৫) মনােযােগের শর্ত : মনােযােগের শর্তগুলিকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়— বস্তুগত শর্ত ও ব্যক্তিগত শর্ত। বস্তুগত শর্তগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল উদ্দীপকের তীব্রতা, নতুনত্ব, আকার, পরিবর্তনশীলতা ইত্যাদি। ব্যক্তিগত শর্তগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল আগ্রহ, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি।
(৬) নতুনত্বের খােজ : মনােযােগের আর-একটি বৈশিষ্ট্য হল, এটি অনুসন্ধানমূলক। শিক্ষার্থীর অনুসন্ধিৎসু মনে অনুসন্ধানকালে নতুন নতুন জিনিসের প্রতি কৌতূহলের জন্ম দেয়, ফলে জ্ঞানের পরিধির বিস্তৃতি ঘটে।
(৭) মনােযােগের দিক : মনােযােগের দুটি দিক আছে— ইতিবাচক ও নেতিবাচক। যে বিষয়ের প্রতি মনঃসংযােগ করা হয় সেটি হল ইতিবাচক দিক।
(৮) সংশ্লেষণাত্মক ও বিশ্লেষণাত্মক : মনােযােগের সঙ্গে সংযুক্ত দুটি মানসিক প্রক্রিয়া হল সংশ্লেষণাত্মক ও বিশ্লেষণাত্মক প্রক্রিয়া। বিশ্লেষণাত্মক প্রক্রিয়া হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার সাহায্যে আমরা কোনাে বস্তুকে খণ্ড খণ্ড অংশে বিশ্লিষ্ট করে দেখি। আর সংশ্লেষণাত্মক প্রক্রিয়া হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার সাহায্যে আমরা বিশ্লিষ্ট অংশগুলিকে একত্রে জুড়ে তার সম্পর্কে একট সামগ্রিক ধারণা গঠন করি। মনােযােগের বিষয়সমূহ যখন চেতনার কেন্দ্রস্থলে থাকে তখন তার সম্পর্কে বিশ্লেষণাত্মক অভিজ্ঞতাকে সংশ্লেষণ (Synthesis) বলা হয়। অর্থাৎ এই সংশ্লেষণের মাধ্যমে সামগ্রিক ধারণা লাভ করা যায়।
সুতরাং উপরের আলােচনা থেকে মনােযােগ সম্পর্কে বলা যায় যে, মনােযােগ হল এমন একটি ইচ্ছামূলক, নির্বাচনধর্মী, পরিবর্তনশীল ও অনুসন্ধানী প্রক্রিয়া, যা বহু বস্তুর মধ্য থেকে কোনাে একটি বিশেষ বস্তুকে চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে হাজির করে এবং একক বস্তুধর্মী অভিজ্ঞতা অর্জনে সহয়তা করে।
Leave a comment