‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের ‘মনসা’ নামের উৎপত্তির মূল কারণটি অজ্ঞাত। ‘মনসা’ নামটি সম্বন্ধে সন্ধান করে যে সমস্ত তথ্য পাওয়া গেছে তা হলঃ দক্ষিণ ভারতে কর্ণাট অঞ্চলে এক নিম্নবর্ণীয় জাতি “মনে মঞ্চমা’ নামে এক সর্পিণীর পূজা করত। এই ‘মঞ্চ’ থেকে ‘মনসা’ নামের উৎপত্তি বলে অনুমিত হয়েছে। আবার পাণিনির ব্যাকরণে ‘মনসো নান্নি’ সূত্রেও ‘মনসা’র নামোল্লেখ দৃশ্যমান। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, ছোটনাগপুরের সিংভূম, মানভূম, বীরভূম ইত্যাদি জেলা থেকে ‘মনসা’ নামটি বাংলায় সম্প্রসারিত হয়েছিল। কোন কোন সংস্কৃত পুরাণে ‘মনসা’ নামের সামান্য পরিচয় বিদ্যমান। নানা দেবভাবনা ও রূপকল্পনার নানা দিক-দেশাগত কাহিনীর সঙ্গে মিশে গিয়ে ‘মনসা’ মূর্তির উদ্ভব হয়েছে। এমনকি বৌদ্ধ মহাযান সম্প্রদায়ের উপাসনা পদ্ধতিতেও মহামায়ূরী দেবী বা ‘জাঙ্গুলী তারা’ নামে দেবীর কথা শোনা যায়।
এই কাহিনীর সূত্রপাত বৈদিক যুগে এবং পূর্ব ভারতে বৈদিক যুগ বিদায় নেবার আগেই তিনি বাস্তুদেবতা ও গ্রাম্যদেবতা রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। পঞ্চদশ শতকেই এ কাহিনী পরিপূর্ণ পরিণত রূপ ধারণে সক্ষম হয়েছিল। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ ও ‘ধর্মমঙ্গল’-এর সুনির্দিষ্ট রূপধারণের আগেই এ কাহিনী গঠিত হয়েছিল। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিহারের গ্রাম অঞ্চলে ‘বিহুলা-কথা’ বা বেহুলার ছড়ার উল্লেখ আছে। চন্দ্রধর বা চঁাদসদাগরকে কেন্দ্র করেই ‘মনসামঙ্গল’ কাহিনীর সৃষ্টি। অন্যান্য কাব্যের মত এখানেও ‘দেবখণ্ড’ ও ‘নরখণ্ড’ নামে দুটি পৃথক খণ্ড দৃশ্যমান। তবে কাহিনীর ক্ল্যাইম্যাক্স আছে শেষ খণ্ডে।
মনসামঙ্গল কাব্য দীর্ঘকাল জনপ্রিয়তার জোয়ারে জীবিত ছিল। তার কারণ এ কাব্য ছিল অশ্রুভারাতুর মানবরসে ‘সর্বজন-হৃদয়-সংবেদ্য’। সর্পসঙ্কুল বাংলাদেশের মানুষের অসহায় অন্তরাত্মার অন্বেষণে এ কাব্যের ‘নবজাতক’ কবিমানসে জন্মগ্রহণ করেছিল। সংসারের আলিঙ্গনে আবদ্ধ ব্রতচারী গৃহস্থ কামনা করেছিল এমন এক জগতের যেখানে “কোথাও মৃত্যু কোথাও দুঃখ, কোথাও বিচ্ছেদ নেই।” সেই উপলক্ষে অনেকদিন আগে থেকেই বাস্তুদেবতা, আরোগ্যের দেবতা ও সম্পদের দেবতা বলে যে দেবীর পূজা প্রচলিত ছিল, সেই দেবীই মানুষের অনুরাগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মনসা বা সর্পের দেবী নাম নিয়ে আবির্ভূতা হলেন কবিমানসে।
শুধু তাই নয়, মনসামঙ্গল কাব্য একটি আদর্শের বোধে উদ্বুদ্ধ। সে আদর্শ আর্য ও অনার্যের সংঘাত, অন্যদিকে দেবতা ও মানবের প্রতিষ্ঠা বাসনা। একদিকে দৈবশক্তির জিঘাংসা, অন্যদিকে প্রবল পুরুষাকারের দৃপ্ত প্রতিজ্ঞা। এখানে দেবতার “অহিংসা পরম ধর্ম”-এর সুশান্ত স্বর নয়, রক্তাক্ত, প্রতিহিংসাজনিত পৈশাচিক আক্রোশই প্রধান। তবু “Our sweetest songs are those that tell of saddest thought”—এই ভাবনায় মনে-প্রাণে বিশ্বাসী মঙ্গল কবিরা যে দিকাঙ্কনে প্রয়াসী, সেখানে মানুষের বেদনাময় অনুভূতিই কাব্যের ধ্রুবপদ রূপে দেখা দিল। আবার অনেকের মতে, এখানে চন্দ্রধর মনসামঙ্গলের নায়ক আর্য প্রতিনিধি বলে সংকেতিত। অনার্য দেবী মনসা পূজাপ্রচারের জন্য তাঁর কৃপাপ্রার্থী। চন্দ্রধরের পূজা দেওয়ার তৃপ্তিতেই মনসার মর্ত্যজগতে হয়েছে মুক্তি।
‘মনসামঙ্গল কাব্য’ কোন রাজশক্তির ছত্রছায়ায় রচিত হয় নি। বিদগ্ধ রাজকবির আনুগত্য নয়, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার কথাই এর কাব্যবাণী। মনসামঙ্গল কাব্যপথে একাধিক কবিযাত্রীর পদচিহ্ন জাজ্জ্বল্যমান। সমজাতীয় ভাবনার বহুপ্রয়োগ এখানে থাকলেও মাঝে মাঝে কিছু কবির মধ্যে স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়।
Leave a comment