ভূমিকা (নামকরণ, উদ্ভব ও কাহিনী):- বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য-পূর্ব যুগেই যে মনসা মঙ্গল কাব্যের উদ্ভব ঘটেছিল, তার সাক্ষ্য দিয়েছেন চৈতন্যজীবনীকার বৃন্দাবন দাস। তিনি চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে চৈতন্য-আবির্ভাব কালের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে নবদ্বীপের তৎকালিক অবস্থা-সম্বন্ধে লিখেছেন :
দত্ত করি বিষহরী পূজে কোন জন।
দেবতা জানেন সবে ষষ্ঠী বিষহরী।
এই দেবী বিষহরীই দেবী মনসা যার মাহাত্ম্য-প্রচার উপলক্ষ্যে রচিত হয়েছিল অসংখ্য মনসামঙ্গল কাব্য বা পদ্মাপুরাণ। “চৈতন্য-পূর্বযুগেই অন্ততঃ তিন চারজন মনসামঙ্গল কাব্য রচয়িতার আবির্ভাব ঘটেছিল। এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দীকালে এই সংখ্যা বহুগুণিত হয়েছিল। তা ছাড়া এই কাব্যের সমগ্র বঙ্গে তাে ব্যাপ্তি ছিলই, এমন কি বহির্বঙ্গে আসামে এবং বিহারেও মনসামঙ্গলের প্রচার-বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত হওয়া যায়। দেবী মনসা সর্পদেবতা—আর হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত জল-জঙ্গলময় এই অঞ্চলে সর্পের প্রাচুর্য-হেতু তার হাত থেকে পরিত্রাণের নিমিত্ত মনসা বা বিষহরির শরণ গ্রহণ অতিশয় স্বাভাবিক বলেই অন্যান্য মঙ্গলকাব্য অপেক্ষা এই মনসামঙ্গলের প্রচার ও প্রসার ছিল অনেক বেশি।
দেবী মনসার উদ্ভব:
কিছু কিছু অর্বাচীন পুরাণে মনসার কাহিনী বিবৃত হলেও বস্তুতঃ মনসা যে কোন এক অনার্য সমাজ-থেকে গৃহীত হয়েছিলেন, এ বিষয়ে পণ্ডিতগণ প্রায় অভিন্ন মত। বেদে এবং মহাভারতে সর্প এবং নাগ জাতির বিবরণ থাকলেও দেবী মনসার পূজা ও মনসামঙ্গল কাহিনীর সঙ্গে এদের দূরতম সম্পর্কও কল্পনা করা যায় না। দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মনে মঞ্চাম্মা’ নামে এক সর্পদেবী পূজিতা হন, এ থেকে ‘মনচা মা’ বা ‘মনসা মা-এর বঙ্গীয় সমাজে আবির্ভাব ঘটাই স্বাভাবিক। অবশ্য এই নামের সঙ্গে আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যগত বিভিন্ন দেবীর গুণগত সম্পর্ক যুক্ত হয়ে থাকতে পারে। বৈদিক সরস্বতী ছিলেন সর্পবিষমােচয়িত্রী এবং শবরকন্যা; বৌদ্ধ দেবী জাঙ্গুলীও জঙ্গলবাসিনী, সর্পবিষমােচয়িত্রী এবং বীণাবাদিনী। মনসার আর্যীকরণের কালে দেবী সরস্বতী এবং জাঙ্গুলী দেবীর কিছু কিছু গুণাগুণ তার উপর আরােপিত হয়ে থাকতে পারে। দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেনবংশীয় রাজাদের সঙ্গে সঙ্গেই মনসাপূজাও বাঙলায় এসেছিল, এমন অনুমান অসঙ্গত নয়। বিজয়সেন-নামাঙ্কিত মনসামূর্তিই বাঙলার প্রাচীনতম মনসার নিদর্শন- এ থেকেও অনুমানটি সমর্থিত হয়। অতএব একাদশ শতাব্দীর পরই কোন এক সময় কোন কোন অর্বাচীন পুরাণে মনসা-পূজা এবং মনসামঙ্গল-কাহিনী সূত্রাকারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকতে পারে বলেই অনুমান করা হয়।
মনসামঙ্গল কাহিনীর উদ্ভব:
মনসামঙ্গল কাহিনীর উদ্ভব কীভাবে ঘটেছিল, এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। প্রথমাংশের দেবখণ্ড মুলতঃ পুরাণ থেকে এবং মহাভারতের আস্তীক মুনির কাহিনী থেকে নাগজাতির কিছু উপাদান গৃহীত হয়ে থাকতে পারে। অবশিষ্ট অংশ অর্থাৎ মূলকাহিনীটি সম্ভবতঃ কোন লৌকিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করেই রচিত; লখাই, বেছলা, সায়বেনে প্রভৃতি নাম থেকে কাহিনীটির অনার্য-সম্পর্ক মনে জাগে। বাঙলাদেশ এবং সন্নিহিত অঞ্চলে মনসামঙ্গল কাহিনীর সঙ্গে জড়িত কোন কোন স্থানের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয়। এ থেকে কাহিনীটির কোন ঐতিহাসিক ভিত্তির সম্ভাব্যতা অস্বীকার করা চলে না।
মনসামঙ্গল কাহিনীর তিনটি অংশ: প্রচলিত মনসামঙ্গল কাহিনীর তিনটি অংশ। প্রথম অংশটি পৌরাণিক কাহিনী; এতে শিবের সঙ্গে মনসার সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে চাঁদসদাগর ও দেবী মনসার সংঘর্ষের কাহিনীই প্রাধান্য লাভ করেছে। তৃতীয় অংশের প্রধান কাহিনীটি বেহুলা-লখিন্দরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। মনসাকে শিবকন্যারূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু সৎমা চণ্ডীর সঙ্গে তাঁর কলহ। মর্ত্যলােকে তার পূজা প্রচারের আকাঙ্ক্ষা এমন উগ্রতা লাভ করে যে, তার পক্ষে কিছুই অকরণীয় ছিল না। তার ক্রুরতা ও নিষ্ঠুরতা সীমাতীত। চাঁদসদাগরের পূজালাভের জন্য মনসা যথেষ্ট চেষ্টা করেও যখন কৃতকার্য হলেন না, তখন প্রতিহিংসাবশে তিনি চাদের বাগানবাড়ি ধ্বংস করলেন, তার মহাজ্ঞান মন্ত্র অপহরণ করলেন, সপ্তডিঙ্গা মধুকরকে ডুবিয়ে দিলেন এবং চাদের সাত পুত্রকে সর্পদংশনে হত্যা করলেন। চাঁদ তবু ছিল অচল- প্রতিষ্ঠ। শেষ পর্যন্ত কনিষ্ঠপুত্ৰ লখিন্দরও বিবাহরাত্রে লৌহবাসর ঘরে সর্পদংশনে মারা যায়। লখিন্দরের মৃতদেহ নিয়ে পুত্রবধূ বেহুলা ইন্দ্রসভায় উপস্থিত হয়ে নৃত্যগীতে দেবতাদের তুষ্ট করে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনলেন। কিন্তু তাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হলাে—সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে চাঁদসদাগর শেষ পর্যন্ত মনসার পূজা করলেন এবং মনসার বরে সকল পুত্রের প্রাণ, সপ্তডিঙ্গা মধুকর-আদি যাবতীয় ঐশ্বর্যই ফিরে পেলেন।
সমগ্র মধ্যযুগের কাব্যসাহিত্যে চাঁদের মতাে দৃপ্ত পৌরুষময় চরিত্র আর একটিও নেই। কাহিনীর প্রয়ােজনেই তাকে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে হয়েছিল। যে যুগে এই কাহিনী কল্পিত হয়েছিল সম্ভবতঃ তখন বঙ্গদেশের বাণিজ্যতরী বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতাে। ফলতঃ সমাজে বণিক সম্প্রদায়েরই ছিল প্রবল প্রাধান্য। তাই মনসা বণিকদের মধ্যেই আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে যেভাবেই হােক কিছুটা স্থান করে নিতে পেরেছিলেন। কোন এক অনার্য দেবীর আর্যসমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের কাহিনীর প্রয়ােজনেই যে মনসামঙ্গল কাহিনী গড়ে উঠেছিল, এ সত্য বিনা দ্বিধায় স্বীকার করা চলে।
(ক) বিজয়গুপ্ত:- মনসামঙ্গল কাব্য রচয়িতাদের মধ্যে বিজয়গুপ্ত সর্বাধিক পরিচিত ব্যক্তি। তাঁর কাব্যকে তিনি ‘পদ্মপুরাণ’ নামে অভিহিত করেছেন। কবি কাব্যে তার আত্মপরিচয় প্রসঙ্গে জানিয়েছেন। তিনি বর্তমান বাখরগঞ্জ জিলার গৈলা ফুল্লশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সনাতন, মাতা রুক্মিণী। কবি ছিলেন বৈদ্যবংশজাত। মনসার উপাসক। স্বগৃহে প্রতিষ্ঠিত ‘মনসার স্থান বঙ্গবিভাগকাল পর্যন্ত বর্তমান ছিল। পদ্মপুরাণ রচনার কালজ্ঞাপক যে শ্লোক তিনি রচনা করেন, তার অন্ততঃ তিনটি পাঠান্তর পাওয়া যায়। একটি আছে ঋতুশূন্য বেদ শশী শক পরিমাণ’—এতে পাওয়া যায় ১৪৮৬ খ্রীঃ। অপর একটি পাঠ—‘ঋতু শশী বেদ শশী শক পরিমাণ’ এর অর্থ—শকাব্দ বা ১৪৯৪ খ্রীঃ। আর একটি পাঠে আছে—‘ছায়াশূন্য বেদ শশী শক পরিমাণ’– একটি অর্থ উদ্ধার করা যায়নি। অপর একটি চরণে বিজয়গুপ্ত লিখেছেন-
সুলতান হােসেন শাহ নৃপতি তিলক।
অর্থাৎ তাঁর কাব্য রচনাকালে সুলতান হােসেন শাহ ছিলেন গৌড়াধিপতি। আলাউদ্দিন হােসেন শাহের রাজত্বকালে ১৪৯৩ খ্রীঃ থেকে ১৫১৮ খ্রীঃ-কেই বিজয়গুপ্তের পদ্মাপুরাণ রচনাকাল বলে গ্রহণ করা চলে। তবে ১৪৮৬ খ্রীঃ-র দাবিকেও অস্বীকার করা চলে না; ঐতিহাসিক আচার্য যদুনাথ সরকার মনে করেন যে জালালুদ্দিন ফতে শাহ-ও সুলতান হােসেন শাহ’ নামে ১৪৮১ খ্রীঃ পর্যন্ত বাঙলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই হিসেবে ১৪৮৬ খ্রীঃ-ও কাব্যের রচনাকাল হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু বিজয়গুপ্ত-রচিত গ্রন্থের খুব প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না বলে ডঃ সুকুমার সেন বিজয়গুপ্তের এত প্রাচীনত্ব বিষয়ে সন্দেহ পােষণ করেন। তার মতে বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা না হয়ে এর গায়েনও হয়ে থাকতে পারেন।
বিজয়গুপ্ত মনসার উপাসক ছিলেন বলেই সম্ভবতঃ সমগ্র কাব্যে তিনি মনসাকেই প্রাধান্য দিতে চেষ্টা করেছেন। তার ফলে, কাব্যের নায়ক চন্দ্রধর বা চাদসদাগর অনেকটা উপেক্ষিত হয়ে রয়েছেন। চাদসদাগরের যে পৌরুষদৃপ্ত চরিত্র অপর সকল মঙ্গলকাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে, বিজয়গুপ্তে তার বেদনাদায়ক অভাব পরিলক্ষিত হয়। শেষ পর্যন্ত কবি চাঁদসদাগরকে এমনভাবে মনসা-ভক্ত করে গড়ে তুলেছেন যে চাদচরিত্রে পূর্বাপর সঙ্গতিসাধন কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। কাহিনীর প্রয়ােজনে কবি মনসাকেও অতিশয় নিষ্ঠুর ও প্রতিহিংসা পরায়ণ করে তুলতে বাধ্য হয়েছেন, এবং মনসার সমর্থনে যথেষ্ট যুক্তি আরােপ করতেও চেষ্টা করেছেন। মনসা জন্মাবধি এমন কিছু কিছু প্রতিকূল শক্তির দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন যে পরবর্তীকালে তার নিরুদ্ধ চিত্তবেদনাই তাঁকে এমন নিষ্ঠুর, অত্যাচারী ও প্রতি হিংসাপরায়ণ করে তুলেছিল।
বিজয়গুপ্ত শুধু কবি ছিলেন না, তিনি বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্যেরও অধিকারী ছিলেন বলেই রচনায় কোন প্রকার শিথিলতা সহ্য করতে পারতেন না। তিনি পূর্বসূরী কবি হরিদন্ত সম্বন্ধে বলেছেন :
প্রথমে রচিল গীত কানা হরিদত্ত।
মূখে রচিল গীত না জানে মাহাত্ম্য।।
হরিদত্তের যত গীত লুপ্ত হৈল কালে।
জোড়া গাঁথা নাহি কিছু ভাবে মােরে ছলে।।
রচনা-বৈশিষ্ট্য: বিজয়গুপ্তের এই উক্তিতে পূর্বসূরী-সম্বন্ধে যথেষ্ট অবিনয় রয়েছে সত্য, কিন্তু কাব্য-গুণ-বিবর্ধক অলঙ্কারাদি-বিষয়ে যে তিনি অতিশয় সচেতন ছিলেন তার পরিচয় এখানে বিধৃত। বস্তুতঃ বিজয়গুপ্তের রচনায় তার পাণ্ডিত্যাভিমান অক্ষুন্ন রয়েছে,ছন্দ, মিল, অলঙ্কারাদি-বিষয়ে তিনি যথার্থ নিপুণতারও পরিচয় দিয়েছেন। তার কোন কোন উক্তি প্রবাদবাক্যের মর্যাদা লাভ করেছে। প্রচলিত অক্ষরবৃত্ত ছন্দে পয়ার-ত্রিপদী ছাড়াও তিনি লাচাড়ি’ নামে লৌকিক বা স্বরবৃত্ত ছন্দেরও সার্থক রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। ছন্দের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিজয়গুপ্ত সমসাময়িক কবিদের চেয়ে যে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ এখানেই পাওয়া যায়। এ বিষয়ে পরবর্তীকালে ভারতচন্দ্রকে অনেকেই বিজয়গুপ্তের সার্থক উত্তরসূরী বলে বিবেচনা করেন। ‘পদ্মপুরাণ’ বা ‘মনসামঙ্গল কাব্যে বিজয়গুপ্তের কৃতিত্ব-বিষয়ে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, “সমসাময়িক যুগ ও জীবন হইতে কবি যে অভিজ্ঞতা আহরণ করিয়াছিলেন, কাব্যে তাহার পরিচয় বর্তমান। তাহার অঙ্কিত সামাজিক চিত্রগুলিও অংশ বিশেষে রুচিবিগহিত বলিয়া মনে হইলেও ইহাদের বাস্তবতা নিসংশয়িত। এই প্রসঙ্গে তিনি যে রসিকতার পরিচয় দিয়াছেন, তাহা স্থল হইলেও যে সমসাময়িক যুগের পক্ষে বেমানান হয় নাই তাহাও অস্বীকার করা যায় না। বিজয়গুপ্তের দৃষ্টি ছিল বৈচিত্র্যের প্রতি। তাই সমগ্র কাহিনীটি যেন অনেকগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রায় পালায় বিভক্ত হইয়া আছে। কাহিনী-পরিকল্পনা হইতে আরম্ভ করিয়া তাহার ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার ইত্যাদি প্রায় সর্বত্রই কবির বৈচিত্র্য-প্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়।”
বিজয়গুপ্তের কাব্যের দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও এ কথা অবশ্য স্বীকার্য যে মনসামঙ্গল কাব্য রচয়িতাদের মধ্যে ব্যাপকতায় ও জনপ্রিয়তায় বিজয়গুপ্তই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়ে থাকেন।
(খ) নারায়ণদেব:- কবি নারায়ণদেব ছিলেন বাঙলার পূর্বাঞ্চলের অধিবাসী। তিনি তার গ্রন্থে যে আত্মপরিচয় বিবৃত করেছেন, তা থেকে জানা যায় যে তার পূর্ব-পুরুষগণ রাঢ়দেশে বসবাস করলেও পরে বােরগ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এই বোরগ্রাম বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। কবির পিতার নাম নরসিংহদেব এবং মাতা রুক্মিণী দেবী। কবি কায়স্থবংশােদ্ভূত। তার কাব্যে কোন কালবাচক ভণিতা না থাকায় তার জীবৎকাল-বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভবপর নয়। তবে বিভিন্ন বহিঃপ্রমাণের উপর নির্ভর করে এ বিষয়ে একটা আনুমানিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।
কবির কাল: কবির বংশধরদের নিকট থেকে প্রাপ্ত বংশতালিকা-অনুযায়ী কবি সাম্প্রতিক কাল থেকে অন্ততঃ পাঁচশ বছর পূর্বে বর্তমান ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। তাঁর কাব্যে চৈতন্যদেবের উল্লেখ কিংবা কোন প্রভাবচিহ্ন না থাকায় তাকে চৈতন্যপূর্ব যুগে সংস্থাপন করা চলে। বিজয়গুপ্তের কাব্যে যেমন পূর্ববর্তী কবি হরিদত্তের উল্লেখ রয়েছে, নারায়ণদেবের কাব্যে তেমন কোন পূর্ববর্তী কবির উল্লেখ না থাকায় অনুমান করা চলে যে তিনি হয়তাে বা বিজয়গুপ্তেরও পূর্ববর্তী ছিলেন।
এ ছাড়া তাঁর কাব্যে এমন কিছু অস্পষ্টতা ও সংক্ষিপ্ততা রয়েছে, যা থেকে অনুমান করা চলে যে মনসামঙ্গল কাব্যের তেমন কোন ধারা সৃষ্টি হবার পূর্বেই তিনি কাব্য রচনা করেছিলেন। কবির কাব্যটি যে শ্লথবদ্ধ, তা থেকেও অনুমান করা চলে কাব্যক্ষেত্রে ইতঃপূর্বে কোন সুনির্দিষ্ট আদর্শ রূপের সাক্ষাৎ তিনি পান নি। এই সমস্ত বহিঃপ্রমাণ থেকে এ কথাই মনে করা চলে যে নারায়ণদেব চৈতন্য-পূর্ব যুগে সম্ভবতঃ পঞ্চদশ শতকের কোন এক সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ডঃ সুকুমার সেন কবিকে ষােড়শ শতকের অন্তর্ভুক্ত করেছেন কিন্তু তিনি এর স্বপক্ষে কোন যুক্তি উপস্থাপিত করেন নি, কিংবা কাল বিচারও করেননি।
জনপ্রিয়তা: কবি নারায়ণদেবকে নিয়ে আরাে কটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। অসমীয়া ভাষায়ও নারায়ণদেবের ভণিতাযুক্ত মনসামঙ্গল কাব্য পাওয়া যায়—তাই অসমীয়াগণ কবিকে অসমীয়া বলে দাবি করে থাকেন। নারায়ণদেব বাঙলাদেশের যে অঞ্চলে বসবাস করতেন, তা’ অসামের অতি সন্নিহিত অঞ্চল। কবি যে কালে বর্তমান ছিলেন বলে অনুমান করা হয়, সেকালে পূর্ব-ময়মনসিংহের ভাষার সঙ্গে অসমীয়া ভাষার পার্থক্য অতি সামান্যই ছিল। কবির জনপ্রিয়তার কারণে অতি সহজেই তাঁর কাব্যের ভাষাকে অসমীয়া ভাষায় রূপান্তরিত করা সম্ভবপর ছিল। সম্ভবতঃ অসমীয়া ভাষায় এইরূপ রূপান্তরিত গ্রন্থের আধিক্যহেতুই আসামবাসীগণ কবিকে অসমীয়া বলে দাবি করে থাকেন। কিন্তু, কবি যে বঙ্গদেশীয়, তা’ আত্মপরিচয়-সূত্রে তিনি নিজেই বলে গেছেন।
‘বাইশ কবির মনসামঙ্গল’: কবি নারায়ণদেবের ভণিতাযুক্ত কোন সমগ্র গ্রন্থ পাওয়া যায় না। তার বহু গ্রন্থে ‘সুকবিবল্লভ ভণিতা থেকে অনুমিত হয় যে এটি ছিল কবিরই প্রাপ্ত উপাধি। এমন বহু পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে, যার বেশির ভাগ ভণিতা কবি নারায়ণদেবের হলেও তাতে আরো বহু কবির ভণিতাই যুক্ত হয়েছে জাতীয় মনসামঙ্গল কাব্যগুলিকে ‘বাইশা’ বা ‘বাইশ কবির মনসামঙ্গল’ নামে অভিহিত করা হয়। এর মূলভিত্তিতে রয়েছে কবি নারায়ণদেব। নারায়ণদেবের অসাধারণ জনপ্রিয়তার কারণেই যে অপর কবিরাও তাদের রচনা নারায়ণদেবের কাব্যে প্রক্ষিপ্ত ক’রে কালজয়ী হবার স্বপ্ন দেখতেন, এ ধারণা সম্ভবতঃ অবাস্তব নয়। নারায়ণদেবের এই জনপ্রিয়তা তার সার্থকতারই পরিচয় বহন করে।
কাহিনী-সূত্র: মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনীটি কে প্রথম কোথা থেকে গ্রহণ করেছিলেন, তা জানা যায় না। তবে নারায়ণদেব একাধিকবার উল্লেখ করেছেন যে তিনি সংস্কৃত পুরাণ থেকে তার কাব্যের উপাদান গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বর্তমান কালে প্রচলিত কোন সংস্কৃত পুরাণেই এ জাতীয় কাহিনীর সন্ধান পাওয়া যায় না। কবির উক্তি যদি যথার্থ হয়, তবে অবশ্যই স্বীকার করতে হয়, কবি যে সংস্কৃত পুরাণ বা উপ-পুরাণ থেকে কাহিনীটি গ্রহণ করেছিলেন, তার সম্ভবতঃ বিলুপ্তु ঘটেছে অপর অনেক পুরাণ বা উপপুরাণের মতােই। লােক-কবিদের গানের মধ্যে প্রচলিত লােক-পুরাণ এই মঙ্গল কাহিনীর অবলম্বন হয়ে থাকতে পারে। তবে নারায়ণদেব-বর্ণিত মনসামঙ্গলের সঙ্গে অপর সকল মনসামঙ্গলেরই মােটামুটি কাহিনীগত ঐক্য থাকায় অনুমিত হয়, মনসামঙ্গলকারদের মধ্যে কোন একজন যে কোন সূত্রে কাহিনীটি পেয়েছিলেন, অপরেরা তার অনুসরণ করেছেন। অথবা এরা প্রায় সকলেই কোন একটি সাধারণ উৎসমূল থেকেই কাহিনীটি গ্রহণ করে নিজেদের রুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের সাজিয়ে গুছিয়ে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, অন্ধকার ঘরে কালাে বিড়াল খুঁজে বার করার মতই এ বিষয়ে যথার্থ তথ্য আবিষ্কার করা এক দুরূহ ব্যাপার।
কাব্য-বৈশিষ্ট্য: নারায়ণদেব শুধু কবি ছিলেন না, তার রচনায় পাণ্ডিত্যেরও যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু তার এই পাণ্ডিত্য কাব্যের উপর কখনাে দুর্ভার হয়ে বসে নি। কবি সহজ কবিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। সহজ কবিত্ব এবং করুণ রসের যথাযথ প্রয়ােগ তার কাব্যটিকে স্নিগ্ধতায় মণ্ডিত করে রেখেছে। কাহিনী, বাগবৈদগ্ধ্য, ছন্দ বা অলঙ্কার বিষয়ে তিনি খুব বেশি সচেতনতার পরিচয় দেন নি। তার সর্বাধিক কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে গ্রন্থের নায়ক চাদসদাগরের চরিত্র সৃষ্টিতে। বস্তুতঃ সমগ্র মধ্যযুগের কাব্যসাহিত্যে একমাত্র নারায়ণদেবের সৃষ্ট চাঁদসদাগর-চরিত্রটিই আপন দৃপ্ত পৌরুষে এবং সমুন্নত মহিমায় মানব-মাহাত্ম-প্রকাশে সমর্থ হয়েছে। কাহিনীর প্রয়ােজনে নারায়ণদেবের চাদসদাগরের মনসার চরণে অঞ্জলি দিয়েছেন, কিন্তু আপনার মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দিয়ে শ্রদ্ধাভরে তার মাথা নত করেন নি। দেব-মানুষের অসম দ্বন্দ্বে দেবতার নিষ্ঠুরতা ও প্রতিহিংসা-পরায়ণতার দাপটে তিনি পরাজয় স্বীকার করেছেন, কিন্তু আত্মিক জয় ছিল তারই। বস্তুতঃ মনসামঙ্গল কাব্যকারদের মধ্যে একমাত্র নারায়ণদেবই চাঁদসদাগর-চরিত্রে আগাগােড়া সঙ্গতি বজায় রাখতে পেরেছেন। কাব্য হিসাবে নারায়ণদেবের মনসামঙ্গলটিতেই উল্লেখযােগ্য কবি-প্রতিভার স্বাক্ষর খুঁজে পাওয়া যাবে।
(গ) কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ:- মনসামঙ্গল কাব্যগুলির মধ্যে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ-রচিত গ্রন্থই সর্বপ্রথম মুদ্রণ-সৌভাগ্য লাভ করে বলে অন্ততঃ পশ্চিমবঙ্গে এঁরই প্রচার এবং খ্যাতি ছিল সর্বাধিক। উক্ত গ্রন্থ প্রকাশকদের বিভ্রান্তির কারণে একসময় কেতকাদাস এবং ক্ষেমানন্দ’ নামক দু’জন কবির অস্তিত্বে বিশ্বাস করা হতাে। কিন্তু কবির নাম ক্ষেমানন্দ এবং কেতকার অর্থাৎ মনসার দাস বলে তিনি ‘কেতকাদাস নামে আত্মপরিচয় জ্ঞাপন করেছেন। মনসাই কেতকা, এ কথার উল্লেখ কবি নিজেই করেছেন-
কিয়াপাতে জন্ম হৈল কেতুকাসুন্দরী।
অবশ্য এই কেতকাদাস-ক্ষেমানন্দ ছাড়াও ক্ষেমানন্দ’ নাম বা ছদ্মনামধারী অপর একজন কবিও মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।
কবি-পরিচয়: কবি ক্ষেমানন্দ তার কাব্যে বিস্তৃতভাবেই আত্মপরিচয় দিয়েছেন। তিনি দামােদর নদের তীরবর্তী কাদড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতার নাম শঙ্কর। সলিমাবাদ সরকারের শাসনকর্তা বারাখার অধীনে তিনি চাকরি করতেন। এক রাজনৈতিক বিপর্যয়ে বারাখা নিহিত হলে কবির পরিবার রাজা বিষ্ণুদাসের ভ্রাতা ভারামল্লের আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিশাের ক্ষেমানন্দ একদিন এক মুচিনীর সাক্ষাৎলাভ করেন। মুহূর্তকাল পরেই মুচিনি আবার দেবী মনসারূপে আর্বিভূত হয়ে কবিকে কাব্য রচনার আদেশ দিয়ে বলেন-
ওরে পুত্র ক্ষেমানন্দ কবিত্বে কর প্রবন্ধ
আমার মঙ্গল গাইয়া বুল।
কবির এই আত্মপরিচয় অংশে কবিকঙ্কণের অনুসরণ থাকলেও বিষয়টি কৌতূহলােদ্দীপক এবং মনােজ্ঞ। এতে তৎকালীনভাবে বিপর্যস্ত অঞ্চলটির একটি বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।
কবি কাব্যে যে বারাখার উল্লেখ করেছেন, তিনি ১৬৪০ খ্রীঃ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কাব্যে উক্ত ভারামল্লও ১৬৭৫-৮০ খ্রীঃ যুবা অবস্থায় ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। অতএব কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে বর্তমান ছিলেন এরূপ অনুমান অসঙ্গত নয়।
অনেকে অনুমান করেন যে পশ্চিমবঙ্গের মনসামঙ্গল কাব্যকারদের মধ্যে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দই সর্বাধিক শক্তিশালী কবি ছিলেন। কিন্তু ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার সম্বন্ধে বলেন – তার কবি-প্রতিভা নিতান্তই সাধারণ স্তরের, কিন্তু স্বল্প প্রতিভা সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যে অধিকতর খ্যাতিলাভ করেছেন।” মনসামঙ্গল কাব্যের তিনটি স্তর—প্রথম স্তরে দেবী মনসাই প্রধান, বিজয়গুপ্তের রচনায় মনসাই সর্বাধিক মনােযােগ আকর্ষণ করেছেন। দ্বিতীয় স্তরে প্রাধানয চাঁদ সদাগরের—এঁর চরিত্রাঙ্কনে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন নারায়ণদেব; তৃতীয় স্তরে প্রধান চরিত্র বেহুলা—কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের সমস্ত ক্ষমতা যেন কেন্দ্রীভূত হয়েছিল এই চরিত্রটির সৃষ্টিতেই। কবির কৃতিত্ব বিষয়ে ডঃ তারাপদ ভট্টাচার্য বলেন- ইনি সম্পূর্ণ রােমান্স-পাগল কবি। কেতকাদাস প্রজাপতির মতই সৌন্দর্যলােভী। চাঁদ ও মনসার দ্বন্দ্ব বর্ণনা তাঁহার স্বভাবের অনুকূল নহে, তাহার সৌন্দর্য-সন্ধানী সমগ্র দৃষ্টি পড়িয়াছে বেহুলা-চরিত্রে। তাঁহার বেহুলা শুধু বেহুলা নহে, বেহুলা-নাচনী একটি অপূর্ব লাস্যময়ী প্রাণচঞ্চলা কিশােরী। তাহাকে দেখিলে বসন্তবায়ু-হিল্লোলিত পুষ্প লতিকাকে মনে পড়ে। মনসামঙ্গলের ন্যায় ভয়ঙ্কর কাহিনীর রুক্ষতাকে এই বেহুলা নিজের কিশােরী জীবনের প্রাণচাঞ্চল্য ও মাধুর্য দিয়া মসৃণ-কোমল করিয়া তুলিয়াছে।
মনসামঙ্গল কাব্যে বেহুলা-লখিন্দরকে পুরাণের উষা-অনিরুদ্ধের অবতাররূপে দেখানাে হয়েছে, কেতকাদাস উষা ও অনিরুদ্ধের কাহিনী আরও অতি বিস্তৃতভাবে পরিবেশণ করেছেন। সমালােচকের ভাষায়- “রােমান্সপ্রিয় কেতকাদাস উষারূপিণী বেহুলার গােপন প্রেমকে বিস্তৃতভাবে রসাইয়া বর্ণনা করিয়া মনসামঙ্গলের অন্তর্গত উষাহরণ পালাকে একেবারে বিদ্যাসুন্দর কাব্যে পর্যবসিত করেছেন।”
কবি কাব্যে তার ভৌগােলিক জ্ঞানের উৎকৃষ্ট পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া দক্ষিণ রাঢ় অঞ্চলের লােকাচারের একটি প্রামাণিক চিত্রও গ্রন্থে উপস্থিত। দেবসভায় বেহুলার নৃত্য বর্ণনায় কবি সেকালে নটীনৃত্যের একটি দুর্লভ চিত্র উপস্থাপিত করেছেন। কবির ভাষা তৎসমবহুল এবং মােটামুটি পরিচ্ছন্ন।
মালভূম অঞ্চলের জনৈক ক্ষেমানন্দও অতিশয় সংক্ষিপ্ত, নয়টি মাত্র পদের সাহায্যে এক মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেন। এতে কেতকাদাস’ ভণিতা নেই এবং কেতকাদাসের রচনার সঙ্গে কোন সাদৃশ্যও নেই। ডঃ সুকুমার সেন এঁর চাদ চরিত্রটির উচ্চ প্রশংসা করেছেন। তিনি মনে করেন, “এই ক্ষুদ্র পাঁচালিটি বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করিয়া রাখিবে।”
(ঘ) অন্যান্য
-
‘বিপ্রদাস পিপলাই’- চব্বিশ পরগণার বদুড্যা (নাদুড্যা) বটগ্রামবাসী বিপ্রদাস পিপলাই তার মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখ করেছেন যে তিনি ১৪১৭ শকাব্দ বা ১৪৯৫ খ্রীঃ হােসেন শাহের রাজত্বকালে তার গ্রন্থ রচনা করেন। এই উক্তির স্বীকৃতিতে ডঃ সুকুমার সেন তাকে মনসামঙ্গল কাব্যের ‘আদিকবি’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু তাঁর কাব্যে হুগলী, ভাটিপাড়া, কাঁকিনাড়া, ভদ্রেশ্বর, ইচ্ছাপুর প্রভৃতির উল্লেখ থেকে তার প্রাচীনত্ব সন্দেহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।। অনেকে অনুমান করেন যে বিপ্রদাস নিজে গ্রন্থের সাতটি পালা রচনা করেছিলেন, অবশিষ্ট ছয়টি পালা অনেক পরবর্তীকালে সংযােজিত হয়েছে। কবিত্বশক্তি সাধারণ মাপের। বেহুলা, সনকা ও চাঁদসদাগরের চরিত্র চলনসই, মনসা-চরিত্রের রুক্ষতা তিনি বর্জন করেছেন। হাসান-হােসেন পালায় মুসলমান-সমাজের চিত্রাঙ্কনে তিনি বাস্তবতাবােধের পরিচয় দিয়েছেন।
-
‘তন্ত্রবিভূতি’- সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত ‘তন্ত্রবিভূতি’র মনসামঙ্গল কাব্যে কিছু বৈচিত্র্য সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গ্রন্থকর্তার নাম বিভূতি, সম্ভবতঃ তিনি তাতী ছিলেন বলেই নামের সঙ্গে ‘তন্ত্র’ শব্দটি যােগ করেছেন। কবি ছিলেন উত্তরবঙ্গবাসী—এই উত্তরবঙ্গে মনসা- মঙ্গল কাব্যের একটা স্বতন্ত্র ধারা প্রচলিত ছিল। কাহিনীতে এবং চরিত্রসৃষ্টিতেও কিছুটা নােতুনত্ব দেখা যায়। তন্ত্রবিভূতির কাহিনী এবং রচনারীতি প্রশংসনীয় হলেও এতে আদিরসের বাড়াবাড়ি নিন্দনীয়। কবি সম্ভবতঃ সপ্তদশ শতকে বর্তমান ছিলেন।
-
‘জগজ্জীবন ঘােষাল’– জগজ্জীবন ঘােষাল উত্তরবঙ্গের কবি। তাঁর আত্মপরিচয়ে জানা যায় যে তিনি দিনাজপুরের কুচিয়ামােড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রূপ, মাতা রেবতী। তিনি সপ্তদশ শতকের শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেন বলে অনুমান করা হয়। কবি চরিত্রসৃষ্টিতে স্বাভাবিক বর্ণনায় মােটামুটি প্রতিভার পরিচয় দিলেও গ্রন্থের বহু অংশ তন্ত্রবিভূতির সঙ্গে হুবহু এক—শুধু ভণিতায়ই পার্থক্য। আদিরসের আধিক্য কবির রুচি-বিকৃতিরই পরিচয় দেয়।
-
‘দ্বিজ বংশীদাস’- ওময়মনসিংহ জেলার পাতুয়ারি গ্রামের অধিবাসী দ্বিজ বংশীদাস একজন শক্তিমান কবি ছিলেন। তার গ্রন্থে তিনি যে কাল-পরিচয় জ্ঞাপক শ্লোক সন্নিবেশ করেছেন, তা প্রামাণিক হলে স্বীকার করতে হয় যে তিনি ১৫৭৫ খ্রীঃ কাব্যটি রচনা করেন। কবির পিতার নাম যাদবানন্দ; কবির কন্যা চন্দ্রাবতী বাঙলার প্রথম মহিলা কবি। কবি মােটামুটিভাবে প্রচলিত কাহিনীর অনুসরণ করলেও দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কাব্যে সংঘাত যেন দেবতা আর মানবে নয়—এই সংঘাত একেবারেই যেন পারিবারিক। কাব্যের ভাষার সরলতা ও অনাড়ম্বর বর্ণনা-ভঙ্গিই তার রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
-
‘হরিদত্ত’– আদিমধ্যযুগের কবি বিজয়গুপ্ত উল্লেখ করেছেন যে হরিদত্তই প্রথম মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেন এবং বিজয়গুপ্তের কালেই তার রচনা লােপ পেয়েছিল। কিন্তু হরিদত্তের ভণিতাযুক্ত কিছু কিছু পদ পাওয়া যায়। তবে এই সামান্য অংশ থেকে তাঁর প্রতিভার কোন পরিচয় পাওয়া সম্ভব নয়। তার সমস্ত পাণ্ডুলিপিই ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাওয়া গেছে বলে অনুমান করা হয় যে, তিনি সম্ভবতঃ এই অঞ্চলেরই অধিবাসী ছিলেন।
-
‘ষষ্ঠীবর’- কবি যষ্ঠীবর দত্ত সম্ভবতঃ শ্রীহট্ট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। এঁর উপাধি ছিল গুণরাজ খান। এর কাব্যে ভারতচন্দ্রের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বলে অনুমান করা চলে যে ইনি সম্ভবতঃ অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে তার কাব্য রচনা করেছিলেন। কবির কাব্য বর্ণনাত্মকগল্প জমিয়ে তােলার দিকে তাঁর বিশেষ লক্ষ্য ছিল; তার রচনায় পাণ্ডিত্য এবং অভিনবত্ব পাওয়া গেলেও তেমন উল্লেখযােগ্য কবিত্ব শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না।
- ‘জীবন মৈত্র’- করতােয়া তীরে লাহিড়ীপাড়া গ্রামের অধিবাসী জীবন মৈত্র ১৭৪৪ খ্রীঃ তার কাব্য রচনা করেন। আত্মপরিচয় প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর পিতার নাম অনন্তরাম, মাতা স্বর্ণমালা। কবি রাজা রঘুনাথের রাজ্যে বাস করতেন। কবির কাব্যে বিহার অঞ্চলে প্রচলিত কাহিনীর কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। কবি ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত-কাব্যে সেই পাণ্ডিত্যের ভারও কিছু লক্ষ্য করা যায়।
Leave a comment