দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের শাসনকাঠামােয় দুই ধরনের স্তর লক্ষ করা যায়। একটি কেন্দ্রীয়, অপরটি হল প্রাদেশিক।

[1] কেন্দ্রীয় বিভাগ

  • সুলতানি: সুলতানি রাষ্ট্র পরিচালনায় কেন্দ্রীয় স্তরের শীর্ষে ছিলেন সুলতান স্বয়ং। সুলতান নিজেই ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বশক্তির আধার এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। খলিফার অধীনে থেকে সুলতান কোরানের নির্দেশ মেনে শাসন চালাতেন। সুলতান একাধারে ছিলেন শাসন, বিচার, আইন ও সমর বিভাগের প্রধান।

    • দেওয়ান-ই-ওয়াজিরা: শাসন কাঠামােয় সুলতানের পরেই ছিল ওয়াজির বা প্রধানমন্ত্রীর স্থান। রাজস্ব আদায় ও প্রশাসন পরিচালনা ছাড়াও তিনি অসামরিক বিভাগেরও তত্ত্বাবধান করতেন। তাঁর দপ্তরের নাম ছিল ‘দেওয়ান ই- ওয়াজিরা।

    • দেওয়ান-ই-আর্জ: সামরিক বিভাগ বা দেওয়ান-ই-আর্জ’ এর প্রধান ছিলেন ‘আরিজ-ই-মামলিক। আরিজ-ই- মালিকের কাজ ছিল—সেনা ও যুদ্ধসরঞ্জাম সংগ্রহ করা, সেনাদের বেতন নির্ধারণ ও তা প্রদান করা, সেনাবাহিনীর দুর্নীতি দমন করা প্রভৃতি।

    • দেওয়ান-ই-রিসালত: কেন্দ্রীয় বিভাগের দেওয়ান-ই- রিসালত’ নামে বৈদেশিক দপ্তরের প্রধান ছিলেন সদর- উস-সুদূর। বিদেশি রাজদূত ও প্রতিনিধিরা এই দপ্তরের মাধ্যমে সুলতানি রাষ্ট্রের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করত।

    • দেওয়ান-ই-ইন্সা: এই দপ্তরের মাধ্যমে প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও বিভিন্ন সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সুলতানের গােপন যােগাযােগ রক্ষা করা হত।

    • অন্যান্য দপ্তর: অন্যান্য কয়েকটি দপ্তর ছিল—গুপ্তচর দপ্তর: বারিদই-মামালিক’, এটির প্রধান ছিলেন বারিদই খাস, কৃষিদপ্তর: দেওয়ান-ই-আমির-কোহী, পূর্তদপ্তর; দেওয়ান-ই-ইমারত, পেনশন দপ্তর: দেওয়ান-ই-ইস্তাক, দাতব্য দপ্তর: দেওয়ান-ই-খয়রাত প্রভৃতি।

  • রাজস্ব ব্যবস্থা: সুলতানি যুগে আয়ের কয়েকটি উৎস ছিল—ভূমিরাজস্ব, জাকাৎ, জিজিয়া, খামস, খনিজ, উত্তরাধিকারহীন সম্পদ প্রভৃতি। সুলতানি রাজস্বের অপর একটি উৎস ছিল ইক্তা প্রথা। ইক্তার শাসনকর্তা ছিলেন মাকৃতি বা মুক্তি নামে কর্মচারীরা।

  • বিচারব্যবস্থা: বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে থেকে সুলতান নিজে সপ্তাহে দু-দিন বিচার করতেন। প্রধান বিচারক ছিলেন কাজি-উলকাজাৎ’। মুফতি শরিয়তি আইনের যে ব্যাখ্যা দিতেন, তা অনুসরণ করেই বিচার হত।

  • পুলিশি ব্যবস্থা: শহরে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করত কোতােয়াল’। তাঁকে সাহায্য করত ‘মুহতাসিব। গ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করতেন গ্রাম্য চৌকিদার।

[2] প্রাদেশিক বিভাগ

  • নানান রূপ: সুলতানি সাম্রাজ্যে তিন ধরনের প্রদেশ লক্ষ করা যায়। যথা- (a) পূর্বতন ইক্তা, যার শাসনকর্তা ছিলেন মাতি। (b) নববিজিত রাজ্যসমূহ, যথা-বাংলা, জৌনপুর, খান্দেশ। এগুলির শাসনকর্তাকে বলা হত। ওয়ালি। (c) পরাজিত হিন্দু রাজাদের রাজ্যসমূহ।

  • বিভাগসমূহ: প্রদেশপুলি কয়েকটি শিক বা জেলায় বিভক্ত ছিল। শিক এর প্রধান ছিলেন শিকদার। শিকগুলি পরগনায় এবং পরগনাগুলি গ্রামে বিভক্ত ছিল।

অনেকের মতে দিল্লির সুলতানিরাষ্ট্র ছিল ধর্মাশ্রয়ী, আবার কারও কারও ধারণা হল—দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। বরনি এ ব্যাপারে ধর্মনিরপেক্ষ ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন।

[1] ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি: বরনি মনে করতেন, মধ্যযুগে দিল্লির শাসকগণ ইসলামের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন। তারা ইসলামীয় আদর্শ বা বিধি উপেক্ষা করেই সুলতানি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। প্রথম দিককার সুলতানগণ নিজেদেরকে খলিফার প্রতিনিধি বলে প্রচার করলেও কার্যত তারা ছিলেন স্বাধীন।

[2] রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতির পৃথকীকরণ: বরনির ধারণায় দিল্লির সুলতানগণ এটা অনুভব করেছিলেন যে, শাসনকালকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতি আলাদা হওয়া উচিত। সুলতানগণ এই আদর্শ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন।

[3] খলিফা ও উলেমাদের প্রতি আপাত আনুগত্য: ইলতুৎমিস-সহ প্রথমদিকের দিল্লির সুলতানগণ নিজেদের প্রয়ােজনে খলিফার প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে দিল্লির সুলতানগণ যেমন আলাউদ্দিন খলজি, তাঁর পুত্র মুবারক শাহ খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন বন্ধ করেন। বলবন, এমনকি মহম্মদ-বিন-তুঘলকও উলেমাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে শাসন পরিচালনা করতেন।