কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্য প্রতিভার একটি সর্বাঙ্গীণ অথচ সংক্ষিপ্ত পরিচয় দান করো।

কবিকঙ্কণ মঙ্গলকাব্য শাখার গতানুগতিক ধারার মধ্যেও স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছেন। ‘কালকেতু উপাখ্যানে’র চরিত্রসৃষ্টিতে ঘটনা বর্ণনার মধ্যে তাঁহার স্বকীয়তার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাহা লিপিবদ্ধ করো।

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর কবি মুকুন্দের কাবো যে বাস্তবানুভূতি, চরিত্রসৃষ্টি প্রচেষ্টা এবং সঙ্কীর্ণ ধর্মগত প্রয়োজনাতিক্রমী উদার মানবতাবোধ ও সার্বভৌম রস পরিবেশিত হয়েছে, প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা মেলে না ভারতচন্দ্রের অসাধারণ প্রতিভার কথা স্মরণে রেখেও কথাটি স্বীকার করা চলে। সুদীর্ঘকাল পুর্বেই মনীষী রমেশচন্দ্র দত্ত কবিকঙ্কণ কাব্য-বিষয়ে অনুরূপ উক্তি করে গেছেন; তিনি বলেন, “The thought and feelings and sayings of his men and women are perfectly natural recorded with fidelity which has no parallel in the whole range of Bengali literature.” প্রাচ্যবিদ্যারসিক, ই.বি. কাউয়েল (E. B. Cowell) কবিকঙ্কণ চণ্ডীমঙ্গল কাব্য পাঠে সন্তোষ লাভ করে মন্তব্য করেছেন. It is this vivid realism which gives such a permanent value to this description.”

কবি মুকুন্দের কাব্যে যে সকল গুণের সন্নিবেশ ঘটেছে, একে একে তার পরিচয় দেওয়া যাক। গ্রছারম্ভে কবি যে সকল দেব-দেবীর বন্দনা করেছেন, তাতে তার অতিশয় উদার ধর্মবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি শক্তি দেবতার মাহাত্ম্যসূচক কাব্য রচনা করতে গিয়েও চৈতন্য বন্দনার কৃপণতা প্রকাশ করেন নি, যদিও অনুমান করা চলে যে ঐ যুগটি ছিল অনেকটা ধর্মীয় গোঁড়ামির এবং সাম্প্রদায়িক রেষারেষির যুগ— ধর্ম বিষয়ে অনুদারতা ও অসহিষ্ণুতা ছিল তৎকালোচিত সাধারণ মনোভাব অতিশয় উদার মানবিকতাবোধই কবিকে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করেছে। তা ছাড়াও ব্যাধকূল-জাত কালকেতু-ফুল্লরাকে নায়ক নায়িকারূপে গ্রহণ ক’রে তৎকালে কাব্য রচনার মধ্যে যে দুঃসাহসিকতার পরিচয় রয়েছে, তারও মূলে আছে সেই উদার, অসাম্প্রদায়িক মানবিক বোধ।

কবিকঙ্কণ আত্মপরিচয়জ্ঞাপক যে অংশটুকু রচনা করেছেন, তেমন বাস্তব রস ও মানবিক আবেদনে সমৃদ্ধ সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন রচনা সেকালে আর দেখা যায় না। বিশেষত এই সামান্য অবকাশে তিনি যে ইতিহাস চেতনার পরিচয় দিয়েছেন, তার মূল্যও অসামান্য। এই প্রসঙ্গে গ্রন্থোৎপত্তির বিবরণে সামস্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কৃষ্ণক-প্রজার কাহিনীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কাহিনী-রচনায় কবিকঙ্কণের মৌলিকতা প্রদর্শনের কোনো সুযোগ ছিল না, কিন্তু যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি কাহিনী পরিবেষণ করেছেন কবির মৌলিকতার পরিচয় পাওয়া যায় সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে।

তাই হর-গৌরীর জীবনযাত্রার চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে তিনি কোনো স্বর্গীয় ব্যাপার ঘটিয়ে না তুলে এই স্বল্পতম অবকাশেই নিম্নবিত্ত বাঙালী জীবনের যে চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, কোনো ঐতিহাসিকের পক্ষেও এর চেয়ে বাস্তব ও নিখুঁত চিত্রাঙ্কন সহজসাধ্য হতো না। মা মেনকা ও কন্যা গৌরীর কলহ;অভিমান-ভরে গৌরীর পিতৃগৃহ ত্যাগ, শিবের ভিক্ষা, হর গৌরীর কলহ— এ সকল ঘটনার মধ্যে যে জীবন রস-রসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়, সে সবই কবির কাব্যের বস্তু-সঞ্চয়কে বাস্তবরসে পরিণত করেছে। শুধু এখানেই নয়, মূল কাহিনীতে কালকেতুর জীবনযাত্রায়, ফুল্লরার বা কালকেতুর রাজ্যপত্তনে, এমন কি পশুদের কাতর ক্রন্দনেও কবি মুকুন্দের বাস্তব চিত্রাঙ্কন ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়।

কবিকঙ্কণের অপর বিশিষ্টতার পরিচয় পাওয়া যায় চরিত্র সৃষ্টিতে। অনুরূপ সার্থকতা সেকালে ছিল অন্যত্রদুর্লভ। হরগৌরীর কাহিনীতে মেনকা, গৌরী এবং শিব–তিনটি দেবচরিত্রেই মানবিকতা আরোপ করে কবি তাদের তিনটি খাঁটি নিম্নবিত্ত বাঙালীতে রূপান্তরিত করে তুলেছেন। মানবচরিত্র সৃষ্টিতেও কবি অনুরূপ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কালকেতু-চরিত্র আঁকতে গিয়ে তাঁকে ভদ্রবীরে পরিণত না করে কবি তাকে স্বভাবসিদ্ধ ব্যাধসন্তান রূপেই উপস্থিত করেছেন—

“শয়ন কুৎসিত বীরের ভোজন বিট্‌ক্কাল। 

ছোট গ্রাস তোলে যেন তে-আঁটিয়া তাল।।

আবার ফুল্লরা সখী বিমলার বাড়িতে গেলে বিমলা তাকে বলেন—

“আস্য গো প্রাণের সই বস্য গো বুহিনী।

মোর মাথায় গোটা কত দেখহ উকুনি।।’

কবি মুকুন্দ চরিত্র সৃষ্টিতে খুব মহৎ কিছু করে উঠতে না পারলেও খণ্ড চরিত্র অঙ্কনে অতিশয় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ স্বল্পতম রেখায় অঙ্কিত মুরারি শীল এবং বিশেষভাবে ভাড়ু দত্তের চরিত্রটির কথা উল্লেখ করা চলে। এই প্রসঙ্গে বণিক খণ্ডের অর্থাৎ ধনপতি সদাগর কাহিনীর দুর্বলা দাসীর চরিত্রটির কথাও উল্লেখ করা চলে। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মুকুন্দরাম খুব বৃহৎ মহৎ বিস্ময়কর বিশাল চরিত্র সৃষ্টি করিতে না পারিলেও সাধারণ, প্রত্যক্ষ, পরিচিত ও পাঁচাপাঁচি বাস্তব চরিত্রাঙ্কনে অসাধারণ কুশলতা দেখাইয়াছেন।”

কবি মুকুন্দের অপর কৃতিত্বের পরিচয় বিধৃত রয়েছে সমাজচিত্রাঙ্কনে। ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত কালকেতুর কাহিনীতে সমসাময়িক যুগের সমাজ-বিবর্তনের ইতিহাস লক্ষ্য করেছেন। প্রাচীন বর্ণগত কৌলীন্য প্রথা কীভাবে ক্রমশ কাঞ্চন কৌলীন্যকেই স্বীকৃতি জানালেন, তারই পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে কালকেতু-কাহিনীতে। বিত্তবান অনার্য ব্যাধসস্তানকে দমিয়ে রাখবার জন্য ব্রাহ্মণ্য সমাজাশ্রিত কলিঙ্গরাজ যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। প্রজাসাধারণও প্রথমত, অনার্য ব্যাধরাজার রাজ্যে বসবাসে অনিচ্ছুক ছিল। অবশেষে কাঞ্চনকৌলীন্যেরই জয় ঘোষিত হল, কলিঙ্গরাজ অনার্য ব্যাধসস্তান কালকেতুর সঙ্গে সন্ধিবন্ধনে আবদ্ধ হ’লেন। এই অতিশয় মূল্যবান্ সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসটুকু ছাড়াও কৃষক প্রজার ওপর সামস্ততান্ত্রিক অধিকর্তারা কতরকম উৎপীড়ন চালাতেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় কবির আত্মবিবরণে এবং ক্রন্দনে। আবার এরি একটা উল্টোপিঠের ছবি পাই কালকেতু কর্তৃক গুজরাট নগর পত্তনে একে একালের হিতকারী স্বৈরাচারীতার (benevolent dictatorship) প্রতিরূপ বলে গ্রহণ করতে পারি। কালকেতু পরিকল্পিত ‘গুজরাট-নগর’ একটি স্বয়ন্তর প্রাচীন গ্রীক নগর রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এ ধরনের পরিকল্পনামাফিক নগর-নির্মাণের স্বপ্ন শুধু একালেই বাস্তবে রূপায়িত হ’তে পারে।

এগুলি ছাড়াও মুকুন্দ কবির চণ্ডীমঙ্গলে রয়েছে তৎকালীন সমাজ-জীবনের, বিশেষত নিম্নবিত্ত গৃহস্থের নিত্য ও নৈমিত্তিক জীবনচর্যার কাহিনী। সামাজিক আচার-আচরণের, খাদ্য-পরিচ্ছদাদির, বিভিন্ন ক্রিয়া-কলাপের খুঁটিনাটি বিবরণ গ্রন্থের ইতস্তত মণিমুক্তার মতো ছড়িয়ে রয়েছে।

কবিকঙ্কণের কবিপ্রতিভা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা তাঁর জীবনবোধের, গতানুগতিকতার মধ্যেও স্বীয় প্রতিভার সাহায্যে স্বকীয়তা সৃষ্টির এবং ধর্মীয় সাহিত্য রচনা করতে গিয়েও ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা অতিক্রম করে যে সর্বজনীন উদার মানসিকতা বোধের পরিচয় পাই তাতে সেকালে তাঁর তুল্য কৃতী পুরুষের সাক্ষাৎ পাই না বল্লেও যথেষ্ট বলা হয় না; একালের উপন্যাস নামক শিল্পটিরও যেন একটি আদল তার কাব্যে দেখতে পাই। প্রসঙ্গক্রমে হরগৌরীর কাহিনীটির কথাই বলা যায়। বস্তুত প্রসঙ্গহীনভাবে বিচার করলে, এটি যে কোনো দেবতার লীলাকাহিনী – এ কথা কারো বুঝবার উপায় নেই। এই কাহিনীটিকে যদি গদ্যভাষায় রূপান্তরিত করা যায়, তাহলে এটিকে অনায়াসে একটি নিম্নবিত্ত বাঙালী পরিবারের চিত্র বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। কবিকঙ্কণ তাঁর কাব্যে এই যে শাশ্বত বাঙালী জীবনের এক অনুপম আলেখ্য রচনা করেছেন, তাকেই তার কবিকৃতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে গণ্য করলে তার প্রতি অন্যায় আচরণ করা হবে না।

অতএব দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য সূচক কাব্য রচনা করতে গিয়েও কবিকঙ্কণ যে কোনো ক্রমেই কোনো ধর্মীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না থেকে বৃহত্তর ও মহত্তর জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি সর্বজনপ্রিয় কাব্য রচনাতেই প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কবি মুকুন্দ যে ব্যক্তি জীবনেও কোনো সঙ্কীর্ণ ধর্মমতের প্রবক্তা ছিলেন না, তার প্রমাণ—তিনি চণ্ডীমাহাত্ম্য রচনা করতে গিয়েও শুধু পঞ্চদেবতার বন্দনাই করেননি, চৈতন্যদেবেরও প্রশস্তি রচনা করেছিলেন।

মুকুন্দ চক্রবর্তীর প্রতিভার বিষয়ে কতিপয় অভিমত:

একালের বাঙালী বিজ্ঞ মনীধীরা মধ্যযুগের কাব্য ও কবি-প্রতিভা আলোচনা প্রসঙ্গে কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী এ বিষয়ে যে সকল অভিমত জ্ঞাপন করেছেন, তার কিছু কিছু অংশ নিচে তুলে ধরা হচ্ছে, এ থেকে কবিপ্রতিভার স্বরূপটি উত্তমরূপে উপলব্ধি করা সম্ভবপর।

(১) ‘বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ গ্রন্থে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: “মুকুন্দরামের কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে ফুটোজ্জ্বল বাস্তবচিত্রে, দক্ষ চরিত্রাঙ্কনে কুশল ঘটনাসন্নিবেশে ও সর্বোপরি, আধ্যায়িকা ও চরিত্রের মধ্যে একটি সুক্ষ্ম ও জীবন্ত সম্বন্ধ স্থাপনে, আমরা ভবিষ্যৎকালের উপন্যাসের বেশ সুস্পষ্ট পূর্বাভাস পাইয়া থাকি। মুকুন্দরাম কেবল সময়ের প্রভাব অতিক্রম করিতে, অতীত প্রথার সহিত আপনাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করিতে, অলৌকিকতার হাত হইতে সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ করিতে পারেন নাই বলিয়াই একজন খাঁটি ঔপন্যাসিক হইতে পারেন নাই। দক্ষ ঔপন্যাসিকের অধিকাংশ গুণই তাহার মধ্যে বর্তমান ছিল। এযুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে কবি না হইয়া একজন ঔপন্যাসিক হইতেন, তাহাতে সংশয়মাত্র নাই।”

(২) বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস – ১ম খণ্ডে ডঃ সুকুমার সেন লিখেছেন: “কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্য চণ্ডীমঙ্গল-পাঞ্চালীর শ্রেষ্ঠ এবং প্রাচীনতম (জ্ঞাত) রচনা তো বটেই, আধুনিক পূর্ব বাঙ্গালা সাহিতো – কিছু বৈষ্ণব কবিতা এবং চৈতন্যভাগবত ও চরিতামৃত বাদ দিলে সবচেয়ে মূল্যবান রচনা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের আগে পর্যন্ত যা কিছু লেখা হইয়াছে তাহার মধ্যে সাহিত্যের ও শিল্পের বিচারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যদি কোনো একটিমাত্র রচনার নাম করিতে হয় তবে তাহা মুকুন্দের ‘চণ্ডীমঙ্গল’। বইটির মধ্যে মহাকাব্যের (epic) ঔদার্যগুণ কিছু আছে।

“মুকুন্দ পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্যে ও অলঙ্কারে তাহার ব্যুৎপত্তির পরিচয় কাবা-মধ্যে যত্রতত্র লভ্য। সেই সঙ্গে দেশিবিদ্যায় অর্থাৎ লোক-ব্যবহার, ছেলে-ভূলানো, ছেলেখেলা, মেয়েলি ক্রিয়াকাণ্ড, ঘরকন্নার ব্যবস্থা, রাঁধাবাড়া ইত্যাদি বিভিন্ন অনপেক্ষিত সামাজিক ও সাংসারিক ব্যাপারেও তিনি বিস্ময়কর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়াছেন। সাধারণ নর নারীর মনে সাংসারিক ঘটনা-দুর্ঘটনায় যে স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রয়া প্রত্যাশিত তাহা তিনি সুনিপুণ অথচ অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে প্রতিফলিত করিয়াছেন। শুধু আপনার বা প্রতিবেশীর ঘরের কথায় নয়, নিজের বা আশেপাশের সমাজের কথায়ও নয়, দেশের যেখানে যতটুকু তাহার গোচরে আসিয়াছিল তাহার সবকিছুতেই তাঁহার রচনারও স্থানে স্থানে প্রস্ফুটিত হইয়া তাঁহার শিল্পকে সমসাময়িক মানের ঊর্ধ্বে তুলিয়াছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের আগে বাঙ্গালা ভাষায় যদি এমন কোনো একটি প্রশ্নের নাম করিতে হয় যাহাতে আধুনিক কালের সাহিত্যবস্তুর–উপন্যাসের রস কিছু পরিমাণেও পাওয়া যাইতে পারে তবে সে বই কী তাহা সহহৃদয় যিনি মানে বুঝিয়া মুকুন্দের রচনা পড়িয়াছেন তিনিই বুঝিবেন। নিপুণ পর্যবেক্ষণ, সহহৃদয়তা, জীবনে আস্থাব্যাপক অভিজ্ঞতা ইত্যাদি যে সব গুণ ভালো উপন্যাস লেখকের রচনায় প্রত্যাশিত সে সব গুণ, সেকালের পক্ষে যথোচিত পরিমাণে, মুকুন্দের রচনাতেই পাই। বাঙ্গালাদেশের এবং বাঙ্গালী মানুষের এমন পরিপূর্ণ চিত্র বাঙ্গালা সাহিত্যের আর কোথাও মিলে কিনা সন্দেহ। কবি শুদ্ধাচারী বামুন পণ্ডিত ঘরের ছেলে আজন্ম দেববিগ্রহ সেবক। কিন্তু তাঁহার সহানুভূতি হইতে কেহই বঞ্চিত হয় নাই যাহাকে আমরা এখন বৈষ্ণব বলি মুকুন্দ হয়তো ঠিক তাহা ছিলেন না। তবে তাহার মনের ভাব পাকা বৈষ্ণবের মতোই এই বৈষ্ণব ভাব তাহার কাব্যে একটু বিশেষ রসের সঞ্চার করিয়াছে। সেই রস হইল স্নিগ্ধ কারণ্য, ভালোবাসা।”

(৩) ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’র ভূমিকায় অধ্যাপক বিজনবিহারী ভট্টাচার্য লিখেছেন: “প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুকুন্দরামের শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদিত মুকুন্দরামের পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল অসাধারণ। তিনি যাহা দেখিতেন তাহার সর্বাংশ ভাল করিয়া দেখিতেন। চর্মচক্ষে যাহা দেখা যায় না কল্পনার রসাঞ্জন স্পর্শে তাহাও তাহার দৃষ্টির সম্মুখে উদ্‌ঘাটিত হইয়া যাইত। সংস্কৃত সাহিত্যেও যে তাঁহার জ্ঞান ছিল চণ্ডীমঙ্গলে তাহার পরিচয় আছে। স্মৃতিশাস্ত্রে তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। পুরোহিত ব্রাহ্মণের পক্ষে কাব্যশাস্ত্র অপেক্ষা স্মৃতিশাস্ত্রের প্রয়োজন বেশি। বিবাহাদি ক্রিয়াক্রর্ম উপলক্ষ্যে স্মার্ত কবিকঙ্কণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। শুভাশুভ নির্ণয় প্রসঙ্গে কালাকাল-বিচারে উপলক্ষ্যে কবি যে সব শাস্ত্রবাক্য উল্লেখ করিয়াছেন তাহা হইতে জ্যোতিষশাস্ত্র বিষয়ে তাহার যে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল সে প্রমাণও পাওয়া যায়। লোকাচার সম্পর্কেও তার অভিজ্ঞতা ছিল অসামান্য। জনজীবনের সহিত তাহার যে গভীর যোগ ছিল তাহার ফলেই কবিকঙ্কণের বর্ণনা প্রথাসিদ্ধ গতানুগতিকতা অতিক্রম করিয়া জীবন রসে সঞ্জীবিত হইয়া উঠিয়াছে।”

(৪) ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য লিখেছেন : “মুকুন্দরাম বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গীর গুণে পৌরাণিক প্রভাব দ্বারা ভারাক্রান্ত হইয়াও লৌকিক চণ্ডীর কাহিনীটি বাংলার বিশিষ্ট জাতীয় একটি জীবন বাণী প্রচার করিয়াছে। প্রত্যক্ষ-দৃষ্ট সত্যকে তাহার কাব্যে তিনি স্বকীয় উপলব্ধি দ্বারা অনুভব করিয়া লইয়াছিলেন। আভিজাত্যের গৌরব-হীন সাধারণ বাঙালী জীবন হইতে উপকরণ সংগ্রহ করিয়া যে সাহিত্যিক চরিত্র সৃষ্টি সে যুগেও সম্ভব হইত, মুকুন্দরামের রচনা পাঠ করিলে তাহাই জানিতে পারা যায়।

“বিচ্ছিন্ন চরিত্র-সৃষ্টিতে মুকুন্দরাম যেমন কালকেতুর কাহিনীতে কৃতিত্ব প্রকাশ করিয়াছেন, তেমনই সামগ্রিকভাবে কাহিনীর বিন্যাসে ধনপতি সদাগরের কাহিনীতেও তিনি তেমনই কৃতিত্ব প্রকাশ করিয়াছেন। ইহার একটি প্রধান কারণ এই যে, ধনপতি সদাগরের কাহিনীটি মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর গৃহস্থজীবনের ভিত্তির ওপর রচিত হইয়াছে, ইহার চিত্র এবং চরিত্রগুলিকে মুকুন্দরামের যেমন প্রত্যক্ষ করিবার সুযোগ হইয়াছিল, কালকেতুর ব্যাধজীবনকে ততখানি নিকট হইতে তিনি প্রত্যক্ষ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন নাই।… কিন্তু ধনপতি সদাগরের কাহিনীর মধ্যে এই রূপটি দেখিতে পাওয়া যায় না। ইহার জীবন বাংলার সাধারণ সামাজিক জীবন, ইহার সঙ্গে মুকুন্দরামের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের কোনো দিক হইতেই বাধা ছিল না বলিয়া ইহার বস্তুধর্মিতা কোনো দিক হইতে ক্ষুণ্ণ হইতে পারে নাই।”

(৫) ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’র ভূমিকায় ডঃ ক্ষুদিরাম দাস লিখেছেন : “কবিকঙ্কণের কৃতিত্ব প্লট ও কাহিনীর সৃষ্টিতে নয়, কিছুটা সামঞ্জস্য বিধানে হতে পারে, কিন্তু তাঁর আশ্চর্য নৈপুণ্য হ’ল বৰ্ণনা শক্তিতে। কী সমাজ ও ব্যক্তি-সহ নিসর্গ, কী ঘটনা ও চরিত্রের বর্ণন, সর্বত্র তিনি অতিরেক ও সংক্ষিপ্ততার মধ্যবর্তী কয়েকটিমাত্র বিষয় করেকটি মাত্র বাক্যে তিনি এমনভাবে বর্ণনা করতে পারেন যাতে বাকি সব ব্যঞ্জনায় আপনা হাঁতেই ধরা দেয়, আর সেই সঙ্গে বর্ণিত বিষয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি ফুটে ওঠে; কবি প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাগ-বিকল্প-সৃজনে পরাভমুখ। ঐ সংক্ষিপ্ত রীতির আশ্রয়ে সৌন্দর্যসৃষ্টিতে তিনি এতই আস্থাবান্। গভীর অনুপ্রবেশ ও তার সঙ্গে হার্দিক ঐক্যানুভব তার বর্ণনাকে বাস্তব সত্য করে তুলেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু যে গুণে তিনি উত্তম সৌন্দর্যের স্রষ্টা হয়েছেন তা’ তার ঐ আশ্চর্য পরিমিতি বেধ। কবিকঙ্কণ লৌকিক ‘ভাষা’-বালার কবি, লৌকিক মৌখিক ইডিয়মগুলি যে কোনো অবকাশেই তার লেখনি মুখে বের হওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়। অথচ শব্দার্থগুদ্ধির ব্যতিক্রমও তিনি করেন না। একমাত্র চণ্ডী রূপ বর্ণন ছাড়া প্রাচীনধর্মী অলঙ্করণ পারিপাট্য বিস্তার করতে তিনি নিতাত্ত নারাজ; আবার তার বর্ণনারীতি নিতান্ত সরল, ভারতচন্দ্রের মত অবকাশ মাত্রেই তির্যক নয়। কবিকঙ্কণও রাজসভাসদ, সমাজ ও জীবন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতাও সুপ্রচুর, অথচ কবিস্বভাব-অনুসারেই তিনি উদার মানবিকতার পন্থী, আর এরই সঙ্গে তাঁর ভাষা ও বর্ণনারীতি অদ্ভুতভাবে সমন্বিত। মঙ্গলকাব্য শাখার অন্যান্য বিষয় ও ঘটনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, কবিবঙ্কণের কাছে বিষয়বস্তু ও ঘটনা উপলক্ষ্য মাত্র হয়েছে, ব্যক্তি ও সমাজের পরিস্ফুটনই তাঁর লক্ষ্য হয়েছে।”

“কবিকঙ্কণের সাহিত্যখ্যাতির সঙ্গে তার সুক্ষ্ম সমাজবোধ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। মধ্যযুগের সামস্ততান্ত্রিক সমাজের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় গ্রন্থনে কবিকঙ্কণের জুড়ি নেই। এদিক থেকে তিনি আধুনিক ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্ব-জিজ্ঞাসু পাঠককে আশাতীতভাবে পরিতৃপ্ত করেছেন। সমাজ পরিচয় বলতে আমরা যেন কেবল বিবাহ বন্ধন ও অলঙ্কার পরিধানের বিষয়ে আগ্রহ না বুঝি। রাষ্ট্রের প্রকৃতি, প্রশাসন ব্যবস্থা, উৎপাদন ও বণ্টন, কৃষি ও কৃষক, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কুটির শিল্প, কর নির্ধারণ ব্যবস্থা, জাতিবর্ণ-বিভাগ প্রভৃতিই বিশেষভাবে গণনা করি। কবিকঙ্কণ বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনার উপলক্ষ্যে এ সবই আভাসিত অথবা পরিস্ফুট করেছেন। তিনি হয়ত কৃতসংকল্প হয়ে রাষ্ট্রসমাজের পরিচয় দিতে লাগেননি, সমাজ-অনুগামী কবি-স্বভাব বলেই সমাজ-চিত্রাঙ্কন সিদ্ধ করেছেন। এজন্য তার বর্ণনা যেমন প্রাসঙ্গিক তেমনি অনায়াস হয়েছে।’

(৬) বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত—দ্বিতীয় খণ্ডে’ ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন : “মুকুন্দরামের প্রধান বৈশিষ্ট্য চরিত্র পরিকল্পনা। বস্তুত মধ্যযুগের বাস্তব জীবনচিত্রাঙ্কনে মুকুন্দরামের সমান প্রতিভাশালী কবি আর একজনও পাওয়া যাইবে না….মুকুন্দরামের রচনারীতিতে চারুত্ব ও বক্রতার অভাব আছে, কিন্তু বিচিত্র চরিত্রচিত্রে সে ত্রুটি ঢাকিয়া গিয়াছে। কাহিনী-কেন্দ্রিক চরিত্র প্রাধান্য আধুনিক সাহিত্যের লক্ষণ। প্রায় চারিশত বৎসর পূর্বে। আবির্ভূত এই কবির চরিত্র পরিকল্পনায় আধুনিকতার স্পর্শ পাওয়া যায়। তিনি দেবদেবীর চরিত্রগুলিকে যথাসম্ভব মনুষ্যধর্মের দ্বারা জীবস্ত করিয়াছেন, কিন্তু সেজন্য তাঁহার প্রশংসা নহে। তিনি মর্ত্যের মানব-চরিত্র অঙ্কনে যে সহানুভূতি বাস্তব জ্ঞান ও সূক্ষ্ম দর্শন শক্তির পরিচয় দিয়াছেন, তাহা মধ্যযুগের ভারতীয় সাহিত্যেই দুর্লভ।

“বাস্তবতা, সূক্ষ্ম দর্শন-শক্তি, অভিজ্ঞতা, সহানুভূতি— মুকুন্দরামের দৃষ্টিভঙ্গীতে এই বৈশিষ্ট্যগুলি বিরাজ করিত বলিয়াই কেহ কেহ তাহাকে ঔপন্যাসিক প্রতিভাধর বলিয়াছেন। ….বাস্তবতা, চরিত্র বিশ্লেষণ, মনস্তত্ত্ব (বিশেষত নারীমনস্তত্ত্ব), পরিহাস রসিকতা এবং ঔপন্যাসিক নিস্পৃহতা বিচার করিলে তাহার চণ্ডীমঙ্গলে উপনাস ও নাটকীয় গুণ পাওয়া যাইবে। এ যুগে জন্মাইলে তিনি কাব্য না লিখিয়া উপন্যাস লিখিতেন, এ অনুমান অসঙ্গত নহে।… ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার-সুলভ নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক চিত্তধর্ম তাঁহাকে অধিকতর সাহায্য করিয়াছে…… তাঁহার কাব্যে বাস্তবচিত্র থাকিলেও তিনি পুরাপুরি বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ হইতে কাব্যরচনা করেন নাই, সে যুগে বিশুদ্ধ বাস্তবতা কোনো কবির মধ্যেই ছিল না।….. মুকুন্দরাম প্রসন্ন মধুর দৃষ্টির সাহায্যে বাস্তবকে রমণীয় করিয়া তুলিয়াছেন এবং তুচ্ছ ক্ষণস্থায়ী বিবর্ণ ব্যাপারকেও রচনার গুণে সুখপাঠ্য করিয়াছেন। মূলত তিনি আদর্শবাদী এবং রোমান্টিক দৃষ্টির অধিকারী; কিন্তু উপাদানগুলি তদানীস্তন সমাজ হইতে গৃহীত বলিয়া তাহার কাব্যে বর্ণিত ঘটনা, দৃশ্য বা চরিত্রকে অত্যস্ত বাস্তব বলিয়া বোধ হয়।