বাস্তব চিত্রাঙ্কনে কবি মুকুন্দরামের কৃতিত্ব প্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেন বলেছেন— “লোক ব্যবহার, ছেলে ভুলানো, ছেলেখেলা, মেয়েলি ত্রিয়াকাণ্ড, ঘরকন্নার ব্যবস্থা, রাঁধা বাড়া ইত্যাদি বিভিন্ন অনপেক্ষিত সামাজিক ও সাংসারিক ব্যাপারেও তিনি বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।”

চণ্ডীমঙ্গল কাব্য কবি মুকুন্দের মৌলিক সৃষ্টি নয়, এমন কি কাব্যে বাস্তবতার জন্য কবির যে শীর্ষারোহন সে উপাদানও কবির নিজস্ব নয়। নানা উপকরণকে কাজে লাগিয়ে কাব্যকে রসোত্তীর্ণ করেছেন তাতেই কবির কৃতিত্ব। মুকুন্দরামের সমসাময়িক কালে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আর একজন কবি আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি হলেন দ্বিজমাধব। দ্বিজমাধবের কাব্যেও বাস্তব উপাদান সমাহৃত হয়েছে। এককথায় বাস্তব মানুষ ও বাস্তববোধে জাগ্রত সাংসারিক জীবন কথা এই সাহিত্যে পেল স্বর্ণসিংহাসন।

মুকুন্দরামের কাব্যে বাংলার কি নেই! বাংলার বিচিত্র গাছ-পালা, নদ-নদী, গ্রাম-শহর, বাঙালীর নিময়াবলী, মুসলমানদের কথা, সমাজের নানা ধরণের মানুষদের কথা, আধিদবিক ও আধিভৌতিক ক্রিয়াকাণ্ড, হরগৌরীর সংসার-চিত্র, কালকেতু ও ফুল্লরার গৃহ-পরিবেশ, পশুদের ক্রন্দন প্রভৃতি কাহিনির মধ্যে মুকুন্দরামের বাস্তব চিত্রাঙ্কনের মুনশিয়ানা লক্ষিত হয়েছে।

ব্যাধ-সন্তান কালকেতুর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ জীবনের বর্ণনার মধ্যে নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি বাস্তব ছবি ফুটে উঠেছে। পরে দেবী কর্তৃক প্রদত্ত ঐশ্বর্য লাভ এবং তা নিয়ে নগর স্থাপন করা কালকেতুর জীবনকে আদর্শায়িত করেছে। কালকেতুর জন্মের এক বৎসরের মধ্যে যে সব আচার অনুষ্ঠান প্রতিপালিত হয়েছে তা বাঙালীর জীবনেরই অনুরূপ—

“সঙ্গে শিশুগণ ফিরে   তাড়িয়া শশারু ধরে

দূরে গেলে ছুরায় কুকুরে। 

বিহঙ্গে বাঁটুলে বিন্ধে   লতাত্র সাজুড়ি বান্ধে

কান্ধে ভার বীর আইসে ঘরে।।”

কালকেতুর বিবাহ-প্রসঙ্গে ঘটক পাঠানো দেনা-পাওনার কথায় তাতে ব্যাধ জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে—

“পণের নির্ণয় কৈল দ্বাদশ কাহন। 

ঘটকালি পাবে ওঝা আর দশ পণ ৷৷

পাঁচ গা গওরাক দিব গুড় পাঁচসের। 

ইহা দিলে আর কিছু না করিবে ফের।।”

বিবাহের পর কালকেতু-পত্নী ফুল্লরা শাশুড়ীর নির্দেশে ব্যাধজীবনোচিত যে আচার-ব্যবহার বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে তা নবগৃহবধূর শাশুড়ী কর্তৃক শিক্ষা লাভের মত—

“মাংস বেচি লএ কড়ি চাউল চল্যাতি বড়ি 

তৈল লোন কিনয়ে বেসাতি।

শাক বাইগন কচু মূলা অধ্যা থোড় কাঁচকলা সুসজ্জে পুরিয়া লহে পাথি।।”

গ্রাম্য জীবনের বাস্তবরূপ এখানে ফুটে উঠেছে। এছাড়া কালকেতুর ভোজনের চিত্র একান্ত বাস্তব—

“শয়ন কুৎসিত বীরের ভোজন বিটকাল।

ছোট গ্রাস তোলে যেন তে আঁটিয়া তা’ল।”

কালকেতুর বীরত্বে পশুগণ পরাভূত হয়ে দেবী চণ্ডীর নিকট নালিশ জানিয়ে নিজেদের যে করুণ অবস্থার কথা বর্ণনা করেছে তাতে মনুষ্যসমাজের বাস্তব জীবনের ছবি প্রতিবিম্বিত হয়েছে। হর-গৌরীর কাহিনিতে দেবতার অন্তরালে যেমন বাঙালী জীবনের ঘরোয়া ছবি লুকিয়ে আছে, ঠিক তেমনই পশুদের ক্রন্দনে আর্ত মানব কণ্ঠের বেদনা ব্যক্ত হয়েছে। আবার ‘ফুল্লরার বারমাস্যাতে দেখা যায় সমসাময়িক নিম্নবিত্তের অভাব-জর্জরিত জীবনের এক অতি বাস্তব রূপ—

“ভাঙা কুড়্যা ঘর তালপাতার ছাওনি।।

ভেরেণ্ডার থাম ওই আছে মধ্য ঘরে।।

প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙে ঝড়ে।।”

ছদ্মবেশিনী দেবী চণ্ডিকাকে বিতাড়িত করার যে চেষ্টা, সতীনের সঙ্গে ঘর করার যে অসহনীয় কষ্ট, কালকেতুকে সন্দেহ করে তার চরিত্রে কালিমা লেপন করার যে প্রয়াস সে সবের মধ্য দিয়ে সমাজের বাস্তব দিকই ফুটে উঠেছে। আবার ফুল্লরার উক্তিতে—

“মাংসের পসরা লইয়া ফিরি দ্বারে দ্বারে

কিছু খুদ কুঁড়া পাই উদর না ভরে।।”

স্পষ্টতই দেখা যায় মধ্যযুগের নিম্নবিত্ত বাঙালীর জীবনের দ্রারিদ্রতা, ফুল্লরার বারমাসের দুঃখবর্ণনার সাথে একাকার হয়ে জীবন্তরূপ লাভ করেছে।

বাস্তবের সঙ্গে কৌতুকরসের আশ্চর্য সমন্বয় সাধন করে কবি মুকুন্দ অতি সাধারণ বিষয়গুলিকে উপভোগ্য করে তুলেছেন। যেমন ব্রাহ্মণদের লোলুপতা প্রসঙ্গে—

“মুর্খ বিপ্র বৈসে ঘরে   নগরে যাজন করে

শিখিয়া পূজার অনুষ্ঠান।

চন্দন তিলক পরে   দেবপূজা ঘরে ঘরে 

চাউলর কোচড়া কন্ধে টান।।”

উদ্ভটরস সৃষ্টিতেও মুকুন্দরামের বিশিষ্ট পরিচয় মেলে। খুল্লরা-লহনার নিত্য বিবাদ। লহনার সখী লীলাবতী কলহ নিবারণের ঔষধ দেয়—

“কচ্ছপের নখ আর কুম্ভীরের দাঁত

কোধরের পেঁচা আর গোধিকার আঁত 

বাদুড়ের পা আর সজারুর কাঁটা

তেমাথায় পোড়ায়ে ললাটে লিখ ফোঁটা।।”

পরিশেষে বলতে হয়, সামাজিক মানুষের সংঘাত, বিক্ষুদ্ধ জীবনের বাস্তবকাহিনি রূপায়ণে মুকুন্দরাম যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত চরিত্রগুলি অঙ্কন করেছেন তাতেই কবির প্রতিভা ঔপন্যাসিক প্রতিভার সহধর্মী হয়ে আধুনিক জীবন চেতনার দ্বারোদ্ঘাটন করেছে। বাস্তব নিষ্ঠার সঙ্গে যে দুর্লভ রসসৃষ্টির পরিচয় করি দিয়েছেন তাতেই তাঁর সদাজাগ্রত কবিমনকে চেনা গেছে। সীমাবদ্ধ যুগজীবনের মধ্যে চিরজীবনের আনন্দ লীলাকে কবি ছন্দোবদ্ধ রূপ দিতে সমর্থ হয়েছেন।