মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিঃস্ব, হতদরিদ্র কৃষকদের ভূমিদাস বা সার্ফ’ বলা হত। নানাবিধ শােষণে জর্জরিত মধ্যযুগের ইউরােপের ভূমিদাসদের অবস্থা ছিল সীমাহীন দুর্দশায় পূর্ণ।

[1] সামন্ত-প্রভুর দাসত্ব: ভূমিদাসদের সঙ্গে সামন্তপ্রভুরা পশুসুলভ আচরণ করত এবং দিবারাত্র পরিশ্রমসাধ্য কাজগুলি তাদের দিয়ে করাত। ভূমিদাস পালানোর চেষ্টা করলে তার ভয়ংকর শাস্তি হত।

[2] পরাধীনতার গ্লানি: কোনাে ভূমিদাস বা তার পুত্রকন্যার সামন্ত-প্রভুর নিয়ন্ত্রণক্ষেত্রের বাইরে কোথাও বিবাহ, ভূমিদাসের ছেলের লেখাপড়া শেখা বা কিছু কাজ শিখতে শহরে যাওয়া প্রভৃতি প্রভুর অনুমতি ছাড়া সম্ভব ছিল না। ভূমিদাসরা বংশানুক্রমে এই পরাধীনতা ভােগ করত।

[3] বাধ্যতামূলক কাজ: ভূমিদাসকে তার প্রভুর জমিতে সপ্তাহের বেশিরভাগ সময় বিনা পারিশ্রমিকে বেগার খাটতে হত। তা ছাড়া নিজের জমি ফেলে রেখে তাকে আগে জমিদারের জমিতে হাল দেওয়া, বীজ বপন, ফসল তােলা প্রভৃতি কাজগুলি করতে হত। জমিদারের রাস্তা, খাল, সাঁকো প্রভৃতি নির্মাণে ভূমিদাসরা বাধ্য ছিল।

[4] করভার: জমিদার ও গির্জা বিভিন্ন উপলক্ষে ভূমিদাসদের কাছ থেকে নানা ধরনের কর আদায় করে তাকে নিঃস্ব করত। ভূমিকর, জলকর, বিবাহ কর, পশুচারণ কর, ধর্মকর (টাই) প্রভৃতি ছাড়া আরও নানা ধরনের কর তাদের দিতে হত। ভূমিদাসের পুত্র উত্তরাধিকারসূত্রে তার পিতার জমি লাভ করলেও প্রভুকে ‘হেরিয়ট’ নামে কর দিতে হত।

[5] অবর্ণনীয় অত্যাচার: প্রভুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামান্যতম কাজ করলে বা প্রভু অখুশি হলে অনেক সময়ই সাফ ও তার পরিবারের সদস্যদের দারুণ অত্যাচার সহ্য করতে হত। পলাতক সারফকে অনেক সময় মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হত।

মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামােয় সার্ফ বা ভূমিদাসদের জীবন ছিল নিদারুণ কষ্টের। তবে একাদশ শতকের পর থেকে নানা উপায়ে তারা মুক্তি লাভ করতে থাকে।

[1] সামন্তপ্রভুর উদারতা: কোনাে কোনাে উদার ও সদয় সামন্তপ্রভু স্বেচ্ছায় তার অধীনস্থ ভূমিদাসদের মুক্তি দিতেন৷

[2] ধর্মীয় ভূমিকা: কোনাে কোনাে ভূমিদাস গির্জায় ধর্মীয় কাজে নিযুক্ত হয়ে অথবা ক্রুসেড অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধে যােগদান করে তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সামন্তপ্রভুর ভূমিদাসত্ব থেকে মুক্তি পেত।

[3] পলায়ন: এ যুগে একদিকে যেমন নতুন বসতির প্রসার ঘটে তেমনি নতুন নতুন শহর গড়ে ওঠে। ম্যানর থেকে দূরবর্তী এসব স্থানে পালিয়ে এসে ভূমিদাসরা শিল্প বা বাণিজ্যের কাজে নিযুক্ত হত।

[4] অর্থমূল্যে মুক্তি: কোনাে কোনাে ভূমিদাস তার প্রভুকে নির্দিষ্ট অর্থমূল্য দিয়ে মুক্তি ক্রয় করতে পারত এবং মুক্তির পর সামান্য মজুরির বিনিময়ে প্রভুর জমিতেই শ্রম দিয়ে জীবিকা অর্জন করত।

উপসংহার: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভূমিদাসদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার ও নির্যাতনের ফলে সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে ক্রমশ বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। এই বিদ্রোহগুলি সামন্ততন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করে তার মৃত্যুর পথ প্রস্তুত করে দেয়। অর্থাৎ বলা যায়, বিদ্রোহ ভূমিদাসদের মুক্তির পথ সর্বাধিক প্রশস্ত করেছিল।