কোনো আখ্যায়িকা বা আখ্যান বস্তুকে অবলম্বন করে যখন কাব্য রচিত হয়। তখন তাকে আখ্যান কাব্য বলে।

এ ধরনের কাব্যের লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য : 

(১) একটি কাহিনির বর্ণনা করা হয়, আনুপুর্বিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে গল্প বা কাহিনি বিবৃত করা হয়।

(২) মহাকাব্যের মতো এগুলিতে কাহিনির সূচনা (Begining), মধ্যভাগ (Middle) এবং পরিণতি (End) থাকে এবং বিবিধ চরিত্রের পরিচয় প্রকাশিত হয় তবে, কাহিনি বা ঘটনাই এখানে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে—চরিত্র অনেকখানি গৌণ ভূমিকা নেয়।

(৩) কাহিনি বা আখ্যান যেন সংক্ষিপ্ত না হয় লেখক সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। 

(৪) আখ্যানের মধ্যে পারিপার্শিক বর্ণনা থাকতে পারে কিন্তু কোনো মতেই তা আখ্যানকে ছাড়িয়ে যাবে না।।

(৫) আখ্যান সহজ সরলভাবে প্রকাশিত হবে কোনোমতেই বিশ্লেষণ ধর্মী হবে না।

(৬) ছন্দ সম্পর্কে কোনো দৃঢ় পিনদ্ধ নিয়মের বন্ধন নেই—অলঙ্কার প্রকাশের বাহুল্য যেন না থাকে।

(৭) বিষয়ের একমুখিনতা আখ্যান কাব্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। 

(৮) দেশ জয়, প্রেম, রোমান্স, কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা, কোনো বীরের কার্যকলাপ, ধর্মানুভূতি প্রভৃতি বিষয়গুলি রচিত হতে পারে তবে অনেকগুলি বিষয় যেন একত্রে গ্রন্থিবদ্ধ না হয়ে পড়ে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন ৷

কবি চসারের Cantas Canterbury Tales and crisegde রোমান্সমূলক আখ্যান কাব্য।

কাহিনি কাব্য বা আখ্যান কবিতায় অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ কবি রবার্ট বার্নস এবং উনিশ শতকের কবি ওয়াল্টার স্কট বিশেষভাবে বিখ্যাত। কবি কোলরিজের The Rime of the Ancient Mariner একটি বিখ্যাত আখ্যান ধর্মী কাব্য। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী, কীটস, টেনিসন প্রভৃতি বিখ্যাত কবিগণ মুখ্যত গীতিকবি হলেও আখ্যানধর্মী কাব্য রচনায় বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে একপ্রকার আখ্যান কাব্যের প্রচলন ছিল। রাম-সীতা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি সম্পর্কিত পৌরাণিক কিংবা লৌকিক কাহিনি অবলম্বনে যে সমস্ত গান আখ্যায়িকা বর্ণনা করা হত, সেগুলিকে আখ্যান-গীতি বলা হত। এই আখ্যান গীতির আধারে নাথসিদ্ধাদের কাহিনি নিয়ে ‘গোরক্ষবিজয়’ কাব্য রচিত হয়েছিল। মঙ্গল কাব্যগুলি প্রকৃতিও যেন অনেকটা আখ্যান কাব্যের মতো।

মহাকবি কৃত্তিবাস রচিত ‘শ্রীরাম পাঁচালী’, কীর্তিমান কবি কাশীরাম দাস। রচিত ‘মহাভারত’ রঘুনন্দন গোস্বামী রচিত ‘রাম রামায়ণ’ প্রভৃতি আখ্যান কাব্যের আধারে রচিত।

বাংলা কাব্য ধারার আধুনিক যুগে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রথম আখ্যান কারের রচয়িতা হিসাবে উল্লেখ করা যায়। তাঁর ‘পদ্মিনী উপাখ্যানের’ বিষয়বস্তু ইতিহাস থেকে সংগ্রহ করেছেন তিনি। ইতিহাসের পটভূমিকায় কাহিনি বা আখ্যান বর্ণনার মধ্যদিয়ে এই কাব্যে জাতীয় জীবনে আধুনিকতার মাঙ্গলিকি গান রচনা করেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিদায় অভিশাপ’, ‘দেবতার গ্রাস’, ‘পূজারিণী অভিসার’, ‘পরিশোধ’, ‘বিসর্জন’, ‘হোরিখেলা’, ‘পণরক্ষা’, ‘নরকবাস গান্ধারির আবেদন’, ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ প্রভৃতি কাহিনি ভিত্তিককাব্য। এছাড়াও বাঁশি, ছেলেটা, সাধারণ মেয়ে প্রভৃতি কবিতার মধ্যেও আছে কাহিনির ঘনঘটা। রবীন্দ্র পরবর্তীকালে আখ্যান কাব্য লিখেছেন মোহিতলাল মজুমদার (কালা পাহাড়) জসীমউদ্দিন (কবর, নকসী কাঁথার মাঠ) ইত্যাদি।

আধুনিক বাংলা কবিতায় কাহিনি বর্জিত হওয়ার প্রবণতা বেশি। কাহিনি কেন্দ্রিক কবিতা খুবই কম। যদিও প্রতীকি, তবু নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কলকাতার যীশু এবং শঙ্খ ঘোষের বাবরের প্রার্থনা কাহিনি ভিত্তিক। বাবরের প্রার্থনায় ইতিহাস চেতনা ও কালচেতনার সমন্বয় ঘটেছে।

তবে একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে উপন্যাস রচনার ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আখ্যান কাব্যের প্রতি আকর্ষণ মন্দীভূত হতে লাগল। রসিক পাঠক আখ্যান পাঠে তৃপ্তিলাভের জন্য উপন্যাস ও বাংলা সাহিত্য পাঠ করতে চাইল; লেখকগণও আর আখ্যান কাব্য রচনায় আকর্ষণ অনুভব করলেন না।