সূচনা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও ব্রিটিশ সভ্যতা-সংস্কৃতির অনুরাগী একটি ভারতীয় জনগােষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। এঁরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত হয়।

পলাশির যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মােটামুটি সচ্ছল আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যে শ্রেণির উদ্ভব ঘটে তাকে সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলা হয়। অর্থাৎ উচ্চবিত্ত ও কায়িক শ্রমজীবী মানুষের মধ্যবিত্ত স্তরে অবস্থিত সামাজিক গােষ্ঠীকে মধ্যবিত্ত বলা হয়। অধ্যাপক নরেন্দ্রকৃয় সিংহ ‘মধ্যবিত্ত’ প্রবন্ধে লিখেছেন বাংলায় নবাবি আমলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। ইকতিদার আমল খাঁ তাঁর ‘দ্য মিডল ক্লাসেস ইন দ্য মােগল এম্পায়ার’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন। যে, মােগল আমলে সরকারি কর্মচারী, উকিল, শিক্ষক, হাকিম, বৈদ্য এদের নিয়েই মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। বি বি মিশ্র ব্রিটিশশাসিত ভারতে সরকারি চাকুরিজীবী, বণিক, এজেন্ট, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক প্রভৃতি পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

[1] পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত: ব্রিটিশ শাসনকালে বিভিন্ন উদ্যোগে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ ঘটে। নবােথিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই পাশ্চাত্য শিক্ষাকে সাদরে গ্রহণ করে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এই শ্রেণি আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুরাগী ছিল। ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের ফলে তারা ভারতীয় সমাজে সর্বাধিক প্রগতিশীল শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা মনে করত যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসন ভারতীয়দের পক্ষে আশীর্বাদস্বরূপ কারণ ব্রিটিশদের ভারতে আগমনের ফলেই এদেশে আধুনিকতার জোয়ার আসে।

[2] উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রাধান্য: ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ছত্রছায়ায় যে উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল তাতে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যধিক প্রাধান্য ছিল। সরকারি চাকরির বেশিরভাগটাই তাদের করায়ত্ত ছিল। উচ্চশিক্ষা লাভ ও সরকারি চাকরিতে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল সামান্য।

[3] সংখ্যাল্পতা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বৃহত্তর জনগােষ্ঠী ছিল দরিদ্র এবং আধুনিক শিক্ষাবিমুখ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল মধ্যবিত্তদের সংখ্যা ছিল দেশের সমগ্র জনসংখ্যার অনুপাতে খুবই কম। বিংশ শতকের প্রথম দশকে ইংরেজি জানা ভারতীয়দের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১ শতাংশ।

[4] অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি: ব্রিটিশ শাসনকালে আবির্ভূত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট ভালাে ছিল। আর্থিক সচ্ছলতার ফলে সাধারণ ভারতীয়দের সঙ্গে তাদের ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছিল। মধ্যবিত্তদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ভূস্বামী, জমিদার, মহাজন, প্রচুর সম্পত্তির মালিক, পুঁজিপতি, ব্যবসায়ী প্রমুখ। মধ্যবিত্তদের মধ্যে সংখ্যায় সর্বাধিক ছিলেন মাঝারি আর্থিক সংগতিসম্পন্ন। তারা বিভিন্ন সরকারি অফিস আদালতে চাকরি করতেন। অবস্থাসম্পন্নরা নিম্ন মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচিত হত। মধ্যবিত্তদের মধ্যে যাদের আয় কম ছিল তারাও দরিদ্র ভারতীয়দের চেয়ে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনধারণ করতেন।

[5] বেকারত্ব: মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করতেন। পরবর্তীকালে ভারতের উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটলে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়দের সংখ্যাও যথেষ্ট বেড়ে যায়। কিন্তু সেই তুলনায় সরকারি অফিস-আদালতে চাকরির পদ বাড়েনি। ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বহু মানুষ পরবর্তীকালে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়ে বেকার হয়ে পড়ে। তা ছাড়া সরকারি উচ্চপদগুলি ব্রিটিশদের জন্য সুরক্ষিত থাকায় উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চ যােগ্যতাসম্পন্ন ভারতীয়রা তাদের যােগ্যতার চেয়ে অনেক নীচু পদে নিযুক্ত হতে বাধ্য হয়।

[6] শহরকেন্দ্রিকতা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালতগুলি প্রধানত বিভিন্ন শহরে গড়ে উঠেছিল। ফলে প্রধানত শহরগুলিতেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটেছিল। শহরগুলিকে কেন্দ্র করেই তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত। বহু ক্ষেত্রেই তারা গ্রাম ও গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।

[7] সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব: ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেদের সাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পর্কে সর্বদা সজাগ থাকতেন। তারা সর্বদা নিজ সম্প্রদায় ও তাদের মানুষজনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালাতেন।

[8] জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংখ্যার বিচারে খুব সামান্য হলেও তারাই পরবর্তীকালে ভারতে ব্রিটিশবিরােধী জাতীয় আন্দোলনের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য এ. আর. দেশাই ভারতের মধ্যবিত্তদের ‘আধুনিক ভারতের স্রষ্টা’ বলে অভিহিত করেছেন। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের ফলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত হয় এবং ব্রিটিশদের অপশাসনের বিরুদ্ধ তাদের জ্ঞানের চোখ খুলে যায়। মূলত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয় এবং নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে তােলে।

উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে, তারা প্রথম পর্বে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও সভ্যতার একনিষ্ঠ অনুরাগীতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ভারতে সর্বপ্রথম ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে সরব হয়ে প্রতিরােধের ডাক দেয় এবং গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে।