আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের সূচনাকাল থেকে সাধারণভাবে বিষয়বস্তুর অন্বেষণে বাঙালী লেখকবৃন্দ ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের ওপরে নির্ভর করেছেন দেখা যায়। এ বিষয়ে পথিকৃৎ- এর সম্মান দাবি করতে পারেন কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ (১৮৫৮) কাব্যে টডের Annals and Antiquities of Rajasthan নামক গ্রন্থ থেকে দেশের স্বাধীনতা এবং আত্মমর্যাদার জন্য রাজপুতদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনী ব্যবহার করেন। ইংরেজি কাব্যসাহিত্যের প্রভাবে যে ভাববস্তু সেকালের লেখকদের মনে উন্মাদনা সৃষ্টি করত দেশপ্রেমের ভাব তার মধ্যে অন্যতম। বাস্তবে তখনও বিদেশি রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের অস্তিত্ব কোথাও ছিল না তথাপি সাহিত্যে দেশপ্রেমের উল্লাসপূর্ণ বর্ণনা সহজেই সমাদৃত হত। হয়তাে সমসাময়িক কালের কোন ঘটনা বা দেশপ্রেমিক কোন চরিত্রকে এই জাতীয় রচনার অবলম্বনরূপে পাওয়া সম্ভব ছিল না বলেই স্বাধীনচেতা রাজপুত জাতির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কাহিনীগুলােই আমাদের সাহিত্যে একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে। আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের প্রথম যুগের এই ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু ব্যবহারের ধারা উত্তরকালেও অনুবর্তিত হয়। যখন দেশের মধ্যে স্বাদেশিকতার চেতনা জাগ্রত হয়ে উঠল তখনও আমাদের ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকারেরা সুদূর কালের ঘটনাবলীর মধ্যে নিজেদের আবেগ অনুভূতি প্রক্ষিপ্ত করে দেখিয়েছেন।

বাঙলা নাটকে ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু ব্যবহারের প্রথম এবং সফল দৃষ্টান্ত মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১) নাটক। এই নাটকের বিষয় ঘরানা ভীমসিংহের কন্যা কৃষ্ণার আত্মহত্যার কাহিনী। মানসিংহ এবং জয়সিংহ উভয়েই কৃষ্ণার পাণিপ্রার্থী। কৃষ্ণাকে না পেয়ে উভয়েই ভীমসিংহের রাজ্য আক্রমণ করলেন। দেশের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব এবং কন্যার প্রতি-স্নেহ ভীমসিংহ চরিত্রে তীব্র দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। দেশকে বিপদ থেকে বাঁচাবার জন্য শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণা আত্মহত্যা করে এবং ভীমসিংহ শােকে উন্মাদ হয়ে যান। মধুসূদন নাট্য-কাহিনীর মধ্যে কৌশলে এইভাবে দেশপ্রীতিকেই জয়ী করেছেন এবং দেশের জন্য কৃষ্ণার আত্মােৎসর্গে একটা মহৎ আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘কৃষ্ণকুমারী’ মধুসূদনের নাটকগুলাের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রচনা এবং সমগ্র বাঙলা নাট্যসাহিত্যে একখানি সফল ট্র্যাজিডি। ঐতিহাসিক পটভূমির মধ্যে দেশাত্মবােধের আদর্শ প্রতিফলিত করবার যে দৃষ্টান্ত ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে মধুসূদন প্রতিষ্ঠিত করেন, পরবর্তীকালের ঐতিহাসিক নাটকগুলােতে অন্যান্য লেখকেরা সেই দৃষ্টান্ত অনুবর্তন করেছেন। মধুসূদনের পরেই দীনবন্ধুর নাম করতে হয়। কিন্তু দীনবন্ধু কোন নাটকেই ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু ব্যবহার করেন নি। মনােমােহন বসুও ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ-ব্যবহারে আগ্রহ বােধ করেন নি। উত্তরকালে নাটকে সুপরিকল্পিতভাবে ঐতিহাসিক পটভূমি ব্যবহারের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায়।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ বিষয়ে নিজেই লিখেছেন, “হিন্দুমেলার পর হইতে কেবলই আমার মনে হইত—কি উপায়ে দেশের প্রতি লােকের অনুরাগ ও স্বদেশপ্রীতি উদ্বোধিত হইতে পারে। শেষে স্থির করিলাম নাটকে ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা ও ভারতের গৌরব কাহিনী কীর্তন করিলে, হয়ত কতকটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইতে পারে।” এই প্রেরণা থেকেই তাঁর ‘পুরুবিক্রম’ (১৮৭৪), ‘সরােজিনী’ (১৮৭৫), ‘অশ্রুমতী’ (১৮৭৯) প্রভৃতি ইতিহাসাশ্রয়ী রােমান্টিক নাটকগুলাে রচিত হয়। ‘পুরুবিক্রম’-এ আলেকজাগুডারের সঙ্গে পুরুর সংঘর্ষ, সরােজিনী নাটকে আলাউদ্দিনের চিতোের আক্রমণ এবং ‘অশুমতী’তে প্রতাপসিংহের ও মানসিংহের বিরােধের কাহিনী ব্যবহৃত হয়েছে। তার ‘স্বপ্নময়ী’ (১৮৮২) নাটকে বাংলা দেশের শােভা সিং-এর বিদ্রোহ-কাহিনী বিষয়রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। হিন্দুমেলার যুগ থেকে জাতীয় মানসে স্বদেশের প্রতি ভালবাসার যে নতুন আবেগ উচ্ছুসিত হয়ে উঠেছিল, এসব নাটকে সেই আবেগ ও উদ্দীপনা প্রতিফলিত হওয়ায় স্বাদেশিকতাবােধ প্রসারের দিক থেকে নাটকগুলাের প্রভাব বিশেষ কার্যকর হয়েছিল।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাঙলা নাটক এবং বাঙ্গালীদের অভিনয়-চর্চা শখের থিয়েটারের গণ্ডির মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল। এর পরে গিরিশচন্দ্রের আবির্ভাবে সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রসার এবং বৃহত্তর জাতীয় জীবনে নাট্যশিল্প স্থায়িভাবে প্রতিষ্ঠিত করবার আয়ােজনের মাধ্যমে আমাদের নাটক ও থিয়েটারের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা হয়। সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার ফলে জনজীবনের ওপরে নাটকের প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জনজীবনে দেশাত্মবােধ জাগিয়ে তােলবার শক্তিশালী মাধ্যমরূপে নাটকের সম্ভাবনার কথা মনে রেখে ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেছিলেন। ঠিক একই উদ্দেশ্যের প্রেরণায় গিরিশচন্দ্রও ‘সিরাজউদ্দৌলা’ (১৯০৬), ‘মীরকাশেম’ (১৯০৬), ‘ছত্রপতি শিবাজী’ প্রভৃতি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেন। গিরিশচন্দ্র অবশ্য ঐতিহাসিক সত্যনিষ্ঠা এবং স্থান-কাল-পাত্রের কালানুক্রম বজায় রেখে কাহিনীগ্রন্থনের দায়িত্ব বােধ করেন নি। উদ্দেশ্য যত মহই হােক, শিল্পের বিচারে তাই রচনাগুলিকে সার্থক ঐতিহাসিক নাটক বলা যায় না। গিরিশচন্দ্রের অভিনয়গুণে নাটকগুলি ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও জনমানসে উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল—এটুকুই কৃতিত্বের কথা।

গিরিশচন্দ্রের পরে ঐতিহাসিক নাটকে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। ঐতিহাসিক নাটকে স্বদেশপ্রেমের বন্যা বইয়ে দেওয়াকেই দ্বিজেন্দ্রলাল একমাত্র লক্ষ্যরূপে বিবেচনা করেন নি। ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু ব্যবহারে দ্বিজেন্দ্রলালের কল্প উচ্চতর শিল্পাদর্শের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ইতিহাসের পটকে সমকালীন প্রেক্ষিতের সঙ্গে সমন্বিত করার মধ্যেই তার ইতিহাসবােধের উৎকর্ষ প্রমাণিত। ঐতিহাসিক চরিত্র-আশ্রয়ে তিনি মানসিক অনুভূতির বৈচিত্র্য এবং মানস-দ্বন্দ্বের জটিলতা সৃষ্টিতে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। অন্যান্য নাট্যকারদের তুলনায় দ্বিজেন্দ্রলালের ইতিহাসবােধ এবং ঐতিহাসিক সত্যনিষ্ঠাও অনেক উন্নত, বাঙলা ঐতিহাসিক নাটকের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘নূরজাহান’, মেবার পতন’ এবং ‘চন্দ্রগুপ্ত বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। “ইতিহাসের অস্ত্র ঝনঝনা ও নাট্য ষড়যন্ত্রের মধ্যে যে রােমাঞ্চ আছে, নাট্যকার এই সমস্ত নাটকে তাহার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করিয়াছেন। ‘সাজাহানে’ পিতৃহৃদয়ের সঙ্গে সম্রাট সত্তার দ্বন্দ্ব এবং ‘নূরজাহানে’ নারী-প্রকৃতির সঙ্গে ক্ষমতালিঙ্গার সংঘর্ষ চমৎকার ফুটিয়াছে।…জীবনের এমন বিপুল গতিবেগ, স্বদেশিকতার এমন এবং মহত্তর আদর্শের এরূপ বিচিত্র সমাবেশ বাঙলা নাটকে কদাচিৎ দেখা গিয়াছে” (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)।

ক্ষীরােদপ্রসাদ বিদ্যাবিনােদও এই ধারায় কয়েকটি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেছিলেন। সেই রচনার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ‘প্রতাপাদিত্য’ এবং ‘আলমগীর’। ক্ষীরােদপ্রসাদ ঐতিহাসিক সত্যনিষ্ঠার চেয়ে পূর্বকল্পিত আদর্শের রূপায়ণের দিকেই মনােযােগী। ফলে তার প্রতাপ চরিত্র ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং এক আদর্শ জাতীয় বীর। ‘আলমগীরে’ তিনি হিন্দু-মুসলমান মিলনের আদর্শকে জয়ী করতে গিয়ে স্পষ্টিতই ইতিহাসকে লঙ্ঘন করেছেন। অবশ্য এই নাটকে তিনি ঔরঙ্গজেব-চরিত্র-চিত্রণে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

পরিশেষে সাধারণভাবে বলা যায় যে কোথাও আংশিকভাবে শিল্পসিদ্ধি অর্জিত হলেও যথার্থ কোন নাট্যকারই ইতিহাস রসে সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক নাটক রচনায় সফলতা লাভ করেন নি। “এই সমস্ত নাটক আলােচনা করিয়া ইহাই প্রতীত হয় যে, যে দেশপ্রেম একটা সাময়িক বিক্ষোভ মাত্র এবং জাতীয় চরিত্রে অত্যাজ্য ভার সংস্কার রূপে পরিণতি লাভ করে নাই, যাহা অপরিস্ফুট মুক্তি কামনা হইতে স্থির অন্তর সাধনায় উন্নীত হয় নাই তাহা শ্রেষ্ঠ নাটকের প্রেরণা দিতে পারে না। স্বাধীনতার অদম্য আকাঙক্ষা জাতীয় জীবন হইতে নাটকে সংক্রামিত হয় নাই, বরং নাট্যকল্পনার বাস্তবাভিসারী মহনীয়তা অপ্রস্তুত জাতীয় জীবনে এক ক্ষণিক উন্মাদনার সঞ্চার করিয়াছে।” (শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)।