ভূমিকা: বাল্যকালেই মধুসূদন মহাকাব্য রচনা করার স্বপ্ন দেখতেন এবং ছাত্রজীবনেই ইংরেজি কবিতা রচনায় হাত পাকিয়েছিলেন। বঙ্গভূমিতে তাঁর কর্মজীবন শুরু হওয়ার পূর্বেই মাদ্রাজ প্রবাসকালেই তিনি ইংরেজিতে আখ্যায়িকা কাব্যও রচনা করেছিলেন। অতএব ভবিষ্যতে কবি হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই তিনি তাঁর সাহিত্য সাধনা শুরু করেছিলেন এবং কার্যত তিনি বাংলাভাষার প্রথম আধুনিক কবি ও একমাত্র মহাকাব্য রচয়িতার মর্যাদায়ও ভূষিত হয়েছিলেন। এছাড়া বাংলাসাহিত্যে নতুন ছন্দ এবং বহু নতুন কাব্যরীতি বা বিষয়েরও প্রথম প্রবর্তন করে তিনি বাংলা কাব্যের প্রথম পথিকৃৎ এর দুর্লভ সম্মানও অর্জন করেছিলেন। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাসে, আকস্মিকভাবে এক প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখী হয়ে তাঁকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়, যে তিনিই বাংলা নাট্যসাহিত্যের দৈন্য মোচন করবেন। এবং তারই ফলোৎপত্তিরূপে তিনি বাংলাভাষায় তাঁর প্রথম রচনা প্রকাশ করেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকরূপে। এটি ছাড়া আরো কয়েকটি নাটক প্রহসন রচনার মধ্য দিয়ে মধুসূদন যে বাংলাভাষায় শিল্পসম্মত মৌলিক নাটক রচনার পথপ্রদর্শন করেন, এটিই অতঃপর বাংলাসাহিত্যে আদর্শরূপে গৃহীত হয়।

মধুসুদনের নাট্যগ্রন্থাবলি: মধুসূদন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সাহিত্যিক। সাহিত্যক্ষেত্রে রুচির পরিবর্তন তাঁর আগেই সূচিত হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু মৌলিক শিল্পবস্তু সৃষ্টির শক্তি তাঁর পূর্ববর্তী অন্য কোনো লেখকের ছিল না। মধুসূদন বিশেষভাবে কবিতা এবং নাটকের ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভার শক্তি প্রয়োগ করেন। মেঘনাদবধ কাব্যে যেমন তিনি আধুনিক কাব্যধারার সার্থক সূচনা করেছিলেন, নাটকের ক্ষেত্রেও তেমনি তাঁরই রচনায় বাংলা নাটকের উন্নত আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকাশের কালানুক্রমে তাঁর নাটকগুলোর নাম-‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯), ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০), ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০), ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০) এবং ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১)। জীবনের শেষ অধ্যায়ে অসুস্থ ও অর্থাভাবে পীড়িত মধুসূদন বেঙ্গল থিয়েটারের কর্তৃপক্ষের অনুরোধে দুটি নাটক রচনায় হাত দেন। ‘মায়াকানন’ তিনি সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন, অপর নাটক ‘বিষ না ধনুর্গুণ’ অসমাপ্ত থেকে যায়। ‘মায়াকানন’ কবির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে। এই রচনায় নাট্যকার মধুসূদনের শক্তির কোনো পরিচয়ই নেই। শ্রেণি বিচারে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ কে ঠিক নাটক বলা চলে না, এই দুটি প্রহসনজাতীয় রচনা। মাত্র তিন বছর মধুসূদন তিনখানি পূর্ণাঙ্গ নাটক এবং দু’খানি প্রহসন রচনা করেন।

নাটক রচনার প্রয়াস: মধুসূদনের পূর্বে খ্যাতিমান নাট্যকার ছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। রামনারায়ণের অধিকাংশ রচনাই সংস্কৃত থেকে অনুবাদ। ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নামের মৌলিক নাটকটির জন্যই তিনি প্রচুর জনসমাদর লাভ করেন। এই নাটক বা যোগেন গুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’ এবং তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ মধুসূদনের পূর্বে রচিত। এর যে কোনো একটি বিশ্লেষণ করলে প্রথমেই মনে হয় নাটকের গঠনশৈলী সম্পর্কে ওইসব লেখকদের কোন পরিচ্ছন্ন ধারণাই ছিল না। পূর্বাপর অসম্পৃক্তভাবে কতকগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং আকস্মিকভাবে আবির্ভূত কতকগুলো চরিত্রের সংলাপ সমষ্টিই তাঁরা রচনা করেছেন। মধুসূদন বাংলা নাটকের এই হীনদশা দেখে পীড়িত মন নিয়েই নাটক রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন। পাশ্চাত্য নাটকের উন্নত আদর্শ অনুসরণই যে বাংলা নাটকের উন্নতির একমাত্র উপায় এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ধারণা পোষণ করতেন। সমসাময়িক কালে বন্ধুবান্ধবদের কাছে লেখা চিঠিতে মধুসূদন বহু স্থানে বাংলা নাটকের সম্ভাব্য রূপ সম্পর্কে সম্পূর্ণ আলোচনা করেছেন। এসব তথ্য থেকে বুঝা যায় নাট্যশিল্প বিষয়ে প্রচুর অভিজ্ঞতা এবং স্পষ্ট ধারণা নিয়েই তিনি বাংলা ভাষায় নাটক রচনা করতে অগ্রসর হয়েছিলেন।

মধুসূদনের প্রথম নাটক: নাটক রচনার প্রধান সমস্যা বর্ণনীয় বিষয়কে প্রত্যক্ষবৎ করে তোলা। পরোক্ষ বিবৃতির পরিবর্তে নাট্যক্রিয়া নাট্যরসের প্রধান অবলম্বন। মধুসূদনেই প্রথম এই শিল্পকৌশল বিষয়ে সচেতনতা লক্ষ করা যায়। অবশ্য তিনি প্রথম নাটকেই পূর্ণসিদ্ধি অর্জন করতে পারেননি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথেই তাঁকে সাফল্যের দিকে
অগ্রসর হতে হয়েছে। মধুসূদনের প্রথম নাটক শর্মিষ্ঠাকে পরীক্ষামূলক রচনাই বলা যায়। ‘শর্মিষ্ঠা’য় মহাভারতের আদিপর্বের শর্মিষ্ঠা যযাতি দেবযানীর প্রেমের কাহিনি ব্যবহার করা হয়েছে। এই ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি ঈর্ষা ও. কামবৃত্তির বিরোধে নাট্যরসের প্রভূত সম্ভাবনা ছিল।

পদ্মাবতী : মধুসূদনের দ্বিতীয় নাটক পদ্মাবতী অপেক্ষাকৃত উন্নত রচনা। এই নাটকটির ভিত্তি গ্রিক পুরাণের একটি বিখ্যাত গল্প। সেই কাহিনিতে হেরা, আথেনে এবং আফ্রোদিতে-এই তিন দেবীর মধ্যে একটি সোনার আপেলের অধিকার নিয়ে বিরোধ এবং প্যারিসের মধ্যস্থতায় আফ্রোদিতের জয়লাভ ও পরবর্তী স্তরে তিন দেবীর মধ্যে ঈর্ষা ও দ্বন্দ্বের যে জটিলতা দেখা যায়, মধুসূদন কৌশলে সেই কাহিনি ভারতীয় পুরাণের দেবদেবী চরিত্র অবলম্বনে বিবৃত করেছেন। গ্রিক পুরাণের দেবীত্রয় মধুসূদনের রচনায় শচী, রতি ও মুরজার রূপ ধারণ করেছে। প্যারিস ও হেলেন হয়েছে ইন্দ্রনীল ও পদ্মাবর্তী। ‘পদ্মাবতী’ নাটকে ‘শর্মিষ্ঠা’র তুলনায় প্রত্যক্ষ ঘটনা এবং নাট্যক্রিয়া অনেক বেশি, অবশ্য সমস্ত ঘটনার গতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে নেপথ্যের দৈবশক্তি দ্বারা।

অনেক সমালোচকের মতে এর ফলে নাট্যকাহিনি স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। ‘শর্মিষ্ঠা’র তুলনায় ‘পদ্মাবতী’ গঠনের দিক থেকে অনেক শিথিলবদ্ধ এবং অবিন্যস্ত। কিন্তু এই নাটকে সংলাপের ভাষা অনেক স্বচ্ছন্দ এবং নাটকীয় গুণসম্পন্ন। এই নাটকেই মধুসূদন সর্বপ্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। চারিত্রিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টিই নাটকের প্রধানতম গুণ, এইদিক থেকে বহু ত্রুটি সত্ত্বেও ‘পদ্মাবতী’তে সতর্কভাবে উপস্থাপন করেছেন।

কৃষ্ণকুমারী: মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ নাটক কৃষ্ণকুমারী। কৃষ্ণকুমারী উদয়পুরের রাজা ভীমসিংহের কন্যা। অপরূপ সুন্দরী কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ে করার প্রস্তাব আসে জয়পুরের রাজা জগৎসিংহের কাছ থেকে। জগৎসিংহের রক্ষিতা বিলাসবতী এই বিয়ে বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়। বিলাসবতীর দূতী মদনিকার কৌশলে কৃষ্ণকুমারী মানসিংহের প্রতি ভালোবাসার অভিনয় করবেন, কিন্তু মানসিংহ কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ে করতে আগ্রহী জেনে তিনি মহাসঙ্কটে পড়লেন। উদয়পুরের শত্রু মহারাষ্ট্রপতি এবং মুঘল শক্তি মানসিংহের সমর্থক। জয়সিংহ এবং মানসিংহ উভয় প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীই স্থির করলেন কৃষ্ণকুমারীকে না পেলে উদয়পুর আক্রমণ করবেন। ভীমসিংহের মন্ত্রী কৃষ্ণকুমারীকে হত্যা করতে পরামর্শ দিলেন,

কৃষ্ণকুমারী মৃত্যুই এই সঙ্কট হতে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। দুঃসহ মানসিক দ্বন্দ্বে ভীমসিংহ উনন্মাদগ্রস্ত হলেন। ভীমসিংহের ভ্রাতা বলেন্দ্র কৃষ্ণকুমারীকে হত্যা করবেন স্থির করলেন, কিন্তু তার আগে কৃষ্ণকুমারী আত্মহত্যা করল। এই কাহিনি রাজস্থানের ইতিহাস থেকে সংগৃহীত। ইতিহাস অবলম্বনে এই প্রথম বাংলায় নাটক লেখা হলো। পৌরাণিক কাহিনির অলৌকিক, দৈবশাসিত বার্তাবরণের পরিবর্তে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে মধুসূদন দ্বন্দুময় বাস্তবতার উপর নির্ভর। করেছেন। ‘শর্মিষ্ঠা’ এবং পদ্মাবতী’র তুলনায় এ কাহিনি অনেক বলিষ্ঠ।

কৃষ্ণকুমারী, ভীমসিংহ এবং সমগ্র উদয়পুরের বাইরের দুটি প্রবল শক্তির আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে যে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে সমস্ত নাটকে এই অসহায়তাবোধ এবং বিপদের ছায়া প্রলম্বিত। স্বদেশের বিপদ দূর করার জন্য কৃষ্ণকুমারী আত্মহত্যার ঘটনায় নাটকটিতে ট্র্যাজেডি ঘনীভূত হয়। এই বিষাদান্ত পরিণাম কৃষ্ণার নিজের কোনো দুর্বলতার জন্য না ঘটায় হয়তো বা কিছুটা আকস্মিক এবং যুক্তিক্রম বিবর্জিত, তবুও দেশরক্ষার জন্য এই আত্মোৎসর্গে কৃষ্ণকুমারী যথার্থ ট্র্যাজেডির নায়িকার মর্যাদালাভ করে। ‘কৃষ্ণকুমারী’ই বাংলাসাহিত্যে প্রথম সার্থক ট্রাজেডি নাটক। ‘কৃষ্ণকুমারী’তে পরীক্ষা- নিরীক্ষার স্তর উত্তীর্ণ হয়ে যথার্থ নাটকীয় রসবস্তু সৃষ্টিতে প্রশ্নাতীত সাফল্য অর্জন করেছেন মধুসূদন।

মধুসূদনের প্রহসন: উনিশ শতকের বাংলা নাট্যসাহিত্যের একটি বিশিষ্ট শাখা প্রহসন। বাংলা প্রহসন বাংলাদেশের লেখকদের নিজস্ব সৃষ্টি, এই জাতীয় রচনা পাশ্চাত্যসাহিত্যে দেখা যায় না। নানাবিধ সামাজিক সমস্যা এবং প্রাচীনপন্থি ও নব্য সমাজের মানুষদের চারিত্রিক অসঙ্গতিই প্রহসনের বিষয়। উনিশ শতাব্দীর গদ্যসাহিত্যে যে ব্যঙ্গাত্মক নকশা জাতীয় রচনার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, মনে হয় নাটকের আঙ্গিকে সেই জাতীয় বিষয় উপস্থাপনের চেষ্টা থেকেই প্রহসনের জন্ম হয়। মধুসূদন রচিত দুটি প্রহসন হলো- (১) একেই কি বলে সভ্যতা এবং (২) বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ।

রচনা বৈশিষ্ট্য: মধুসূদনের নাট্যরচনার কাল নিতান্তই সংক্ষিপ্ত, কিন্তু মৌলিকপ্রতিভার শক্তি ছিল বলেই তিনি এই সামান্য দু’তিন বছরের মধ্যে বাংলা নাটক প্রহসনের ক্ষেত্রে একটি উচ্চ আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পৌরাণিক প্রসঙ্গের ব্যবহার বা. বাস্তব জীবন সমস্যা নির্ভরতা নাট্যকারের প্রবণতা যে রকমই হোক না কেন, রচনাশৈলী বিষয়ে উন্নততর শিল্পচেতনা না থাকলে কোনো বিষয়ই রসপরিণাম লাভ করতে পারে না। বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে উপযুক্ত রচনাশৈলী উদ্ভাবনই মধুসূদনের প্রধান কৃতিত্ব। বাংলা নাটক প্রহসনের পরবর্তী ধারা মধুসূদন নির্দেশিত পথে অগ্রসর হয়েই শিল্পগত সিদ্ধিতে পৌঁছেছে। পরবর্তীকালের সমস্ত প্রহসন এবং কোনো কোনো নাটক মধুসূদনের প্রহসন দুটির প্রভাব অতিক্রম করতে পারেনি।

“মধুসূদন স্বভাবত ছিলেন কবি প্রকৃতি, অতএব অতিসঙ্গত কারণেই নাটক রচনাকে তাঁর স্বভাবধর্মের অনুগামী বলে মনে করা চলে না। বাংলা নাটকের দুর্গতি লক্ষ করেই তাঁর আবেগপ্রবণ মন আকস্মিকভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে এবং তারই প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ায় তাঁর নাটক সৃষ্টি।”

পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বন্ধুরতাকে মসৃণতায় পরিণত করেছেন। মাত্র দুই বছর কাল নাটক রচনার মধ্যদিয়ে তার যে সাফল্য তা বিস্ময়কর তার হাতে বাংলা নাটক রচনার ভাষা, কাহিনি ও চরিত্র সৃষ্টির আদর্শ বিশিষ্ট রূপলাভ করে। তাই তাকে বাংলা নাটকের প্রথম শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।