আধুনিক সাহিত্য সমালোচকদের কয়েকজন মধুসূদনের প্রহসন দুটি সম্পর্কে কিছু বিরুদ্ধ অভিমত পোষণ করেন। তবে দুটি প্রহসন সম্পর্কে শুধু বিরুদ্ধ অভিমত পোষণ নয়, প্রশংসা ও সুখ্যাতিও বিশেষভাবে উত্থাপিত হয়েছে। অবশ্য মধুসূদনের প্রদর্শিত বিষয়ের মধ্যে অশ্লীলতা বা রুচিদুষ্টতা আছে, কিংবা নাট্য দৃশ্যগুলি নিতান্তই অতিরঞ্জিত, এমন কথাও কেউ কেউ বলেছেন। রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয় বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক একটি তৎকাল প্রচলিত ইতিহাসে একেই কি বলে সভ্যতা, সম্পর্কে কোনো নিন্দাবাদ প্রকাশ না করলেও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন—“মাইকেল মধুসূদন দত্ত এমন সুসামাজিক লোক হইয়াও কি জন্য যে, এরূপ অসংগত ও জঘন্য বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন, তাহা আমরা বুঝিতে পারিলাম না। …এই পুস্তকখানি জমিদারদিগের না হইয়া গ্রন্থকারেরই কলঙ্ক স্বরূপ হইয়াছে।”

‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র ভক্তিপ্রসাদ, ন্যায়রত্ন মহাশয়ের মতে কল্পিত অতিরঞ্জিত অবাস্তব চরিত্র, কিন্তু ‘একেই কি বলে সভ্যতা তাঁর মতে সত্যনিষ্ঠ। অথচ যে মদ্যপ সমাজের চিত্র এই প্রহসনে আছে, দীনবন্ধুর ‘সধবার একাদশীতে তারই উপস্থাপনায় তিনি ক্ষিপ্তপ্রায় হয়েছিলেন, একথা ভাবলে বিস্ময় জাগে। এই প্রহসনটি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন—“সধবার একাদশী খালি মদের কথাতেই আবদ্ধ ও মাতালের কথাতেই পর্যবসিত। ইহাতে হাস্যোদ্দীপক অনেক বিষয় বর্ণিত আছে সত্য কিন্তু আদ্যোপান্ত অশ্লীল বখামী ও মাতলামীর কথাতেই পরিপূর্ণ।” ফলত এই একই অভিযোগে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ও অভিযুক্ত হতে পারত।

মধুসূদনের জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসু মধুসূদনের প্রহসনগুলির স্তুতিবাদ করেও সে দুটির অশ্লীলতার প্রতি কটাক্ষপাত করেছিলেন—“মধুসূদনের প্রহসন দ্বয়ের দোষ এই যে, তাহাদিগের অনেক স্থান অশ্লীলতার দোষে দূষিত।” তবে মানতেই হয়, বাংলা প্রহসনে মধুসূদন প্রথম প্রকাশ্য মঞে রূপোপজীবিনী দেহপসারিনীদের জীবনযাত্রা ও বৃত্তির বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। সুতরাং এইগুলি তথাকথিত সংস্কার পন্থীদের কাছে অশ্লীল বলে পরিগণিত হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

সবমিলিয়ে বলতে হয়, প্রহসনে যে জীবনচিত্র তিনি তুলে ধরেছেন তার বিকৃতি ঐতিহাসিক—সমকালীন নকশা জাতীয় গদ্যরচনা তার বিস্তারিত বিবরণ আছে। কিন্তু মধুসূদন অবাস্তববাদী নাট্যকারের মতো সেই বাস্তব জীবনকে তন্নিষ্ট যাথাযথ্যে বিবৃত করেননি। তিনি রিয়ালিস্ট নন, স্যাটায়ারিস্ট—সুতরাং অশ্লীলতা বিলাসী বস্তুধর্মী নাট্যকার বলে তাঁকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি না। তখনকার কালের যুবকদের মধ্য মদ্যপান ও বারাঙ্গনাসক্তি ছিল নির্লজ্জভাবে যথেষ্ট। প্রকাশ্যে তাই নিয়ে আলোচনা ও রসিকতা ছিল তীব্র। যে সমাজের শ্রোতাদের জন্য তিনি এই প্রহসন লিখেছিলেন তাদের অভিজ্ঞতার তুলনায় এই প্রহসনের বর্ণনা বরং সংযত ও পরিচ্ছন্নই। মধুসূদন নিজস্ব রুচি ও সংস্কারে কোথাও সংযম ও সতর্কতার সীমা ছাড়িয়ে যাননি।