বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কমলকুমার মজুমদার একাধারে তিনি ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, মিনিয়েচার চিত্র শিল্পী, নাট্যকার এবং নাট্য পরিচালক। ফলত রকমারি ভাবে শিল্পের মধ্যে জীবন বিশ্বন তুলে ধরতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাই যুগের বিবর্তনে ছবির বিবর্তিত ধারাতেই যেন তিনি সাহিত্যকে শিল্পিত করতে চেয়েছিলেন। অন্তত আলোচ্য মতিলাল পাদরী গল্পের প্রেক্ষিতে এই কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক। গল্পের মধ্যে মঠ মন্দির লোকশিক্ষার বাতাবরণের মধ্যে দিয়ে একটি চিত্র সামনে তুলে ধরে তিনি পাঠকদের মনোরঞ্জন করলেও তারই একশো আশি ডিগ্রিতে অপেক্ষমান থেকেছে মূল কাহিনি চিত্র। অনেকটা পয়েন্টিলিস্টিক ছবির মতো সোজাসুজি ও পার্শ্ব দৃষ্টিতে একই চিত্রের দুটি রূপ ফুটিয়ে তোলার মতো ফুটিয়ে তুলেছেন একটি কাহিনির মধ্যে দুটি চিত্ররূপ। তাই ‘মতিলাল পাদরী’ গল্পটি ছোটগল্প হিসেবে সার্থক হয়েছে কি না সে বিচার করতে গেলে কমলকুমারের চিত্রশিল্পকুশলী প্রতিভার দিকটাও স্বীকার করতে হয়। আলোচ্য গল্পে তাই মতিলাল পাদরীর পাশাপাশি ভামরের জীবন বৃত্তান্তের প্রতিও পাঠকের কৌতূহল সমধিক লক্ষ করা যায়। এখানে ছোটগল্পের যে পাঠক চিত্তকে একটি মাত্র লক্ষের প্রতি কৌতূহলী করে তোলার প্রবণতা থাকার কথা তা এক অর্থে ব্যাহত হয়েছে। কারণ এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে পাঠক তার কৌতূহলের বিষয়টি যথাযথ ভাবে সনাক্ত করতে অসমর্থ হয়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে নতুন যুগের নতুন গল্পের মধ্যে দিয়েই উঠে আসে নতুন অলঙ্কারিক মত। সেই অর্থে ছোটগল্পের মধ্যে পয়েন্টিলিস্টিক চিত্রকল্পকে তুলে ধরার কৌশলটিকে অস্বীকার করার উপায় থাকে না।

অজ্ঞাতকুলশীলা ভামর কোনো রকম পূর্বাপর প্রস্তুতি ছাড়া গির্জা ঘরে এসে যখন সন্তান প্রসব করলো, তখন স্বাভাবিক ভাবেই ফুলল, যদু, বদনের মতো পাঠকও ভামর সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। যে শিশুপুত্র ঈশ্বর প্রেরিত দূত হিসেবে মতিলাল কর্তৃক প্রচারিত, তার মা ভামর কতটা শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ এই দিকটির প্রতি পাঠকের প্রকৃত কৌতূহলকে অস্বীকার করা যায় না। এবং শেষে যখন ভামরকে ক্রমে চুটার নেশাসক্ত ও যদুদের মদের আসরে বিবস্ত্রা অবস্থায় দেখা যায়, তখন আশ্চর্য রকম ভাবে পাঠক কোনো ভাবেই বিস্মিত হতে পারে না। এই পর্যায়ে এসে দেখা যায় পাঠকের কৌতূহলী দৃষ্টি পড়ে আছে মতিলালের দিকে। তারপরেই কৌতূহল নাশী ক্লাইমেক্স গড়ে ওঠে মতিলালের আচরণকে কেন্দ্র করে। এই পর্যায়ে এসে আর ভামর বা তার শিশুপুত্র নয়, প্রধান হয়ে ওঠে মতিলাল পাদরী ও তার ক্রিশ্চান হয়ে ওঠার সাধনা। মঠ মিশনের আদর্শ, লোকশিক্ষা সমস্তই তুচ্ছ হয়ে যায় মতিলালের অন্তরের অনুতাপে। হৃদয়বৃত্তিতে উন্নীত হয়ে উঠে মতিলাল তখন নিজেকে চিনতে পারেন যে প্রকৃত ক্রিশ্চান এতদিন তিনি হতে পারেননি—তাঁর প্রেম এতদিনে আত্মাভিমান ছেড়ে মানবতায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। এখানেই সার্থক হয়ে ওঠে তাঁর সাধন জীবন।

মতিলাল পাদরী গল্পের মধ্যে প্রাথমিক ভাবে পাঠকের কৌতূহল দ্বিধাবিভক্ত হয়ে দুটি পথকে অনুসরণ করলেও শেষ পর্যায়ে একটি মাত্র কৌতূহলকে আশ্রয় করে একমুখী গতিতে ছুটে গেছে গল্পের পরিণতির দিকে। গল্পের মধ্যে কোথাও কোনো অবাস্তবতা লক্ষ করা যায় না। ভামরের শিশুপুত্রকে দেবদূত কল্পনা করাও কোনো অবাস্তব ঘটনা নয়। ইতিপূর্বে তারাশঙ্করের ‘দেবী’ গল্পের মধ্যেও দেখা গেছে পুত্রবধূকে দেবী কল্পনা করে পূজা করার কাহিনি। কিন্তু সে ছিল এক মানসিক বিকারের কাহিনি। কিন্তু এ এক বিশ্বাস। বাইবেলের সুসমাচার ভিত্তিক দৃঢ় বিশ্বাসের প্রকাশ। এ বিশ্বাস ভ্রান্ত কী অভ্রান্ত সে কথা এখানে বিচার্য নয়। কেন না, মতিলালের সেই বিশ্বাসের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে সমগ্র গল্পের বুনিয়াদ। এবং একটি মাত্র ক্লাইমেক্সে উন্নীত হয়ে নিরসিত হয়েছে সেই কৌতূহল। তাই সব মিলিয়ে ‘মতিলাল পাদরী’ গল্পটি যে ছোটগল্প রূপে সার্থকতা লাভ করেছে এ বিষয়ে দ্বিমতের কোনো অবকাশ থাকে না।