যে কোনো সাহিত্য কর্মের নামকরণ তখনই সার্থক হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায়, গল্পের মর্মকথা কিংবা প্রধান চরিত্র কিংবা উদ্দেশ্য বিশেষ ভাবে প্রতীয়মান হয়, কিংবা শিরোনামে তার আভাস বা বিশ্বন ঘটে। সাহিত্যস্রষ্টারাও সেই নামকরণের বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হয়ে থাকেন। আমাদের আলোচ্য কমলকুমার মজুমদারের ‘মতিলাল পাদরী’ গল্পটি সম্বন্ধেও এই একই কথা বলা যায়।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কমলকুমার মজুমদারের যে সমস্ত রচনার মধ্যে মঠ, মন্দির ও লোকশিক্ষা বিষয়ক সবিশেষ আগ্রহ লক্ষ করা যায়, তাদের মধ্যে অন্যতম হল ‘মতিলাল পাদরী’ নামক ছোটগল্পটি। আলোচ্য গল্পের মধ্যে মতিলাল নামক একজন পাদরীর জীবন-অভিজ্ঞতার কথা বর্ণিত হয়েছে। মতিলাল চেয়েছিলেন সম্পূর্ণ ক্রিশ্চান হতে। কিন্তু বহু বছর ধরে বহু মানুষের উপকার করে, জনকল্যাণের বার্তা টিলা থেকে টিলায় বয়ে নিয়ে গিয়ে, জন সেবা করে, প্রভুর কাছে দিবারাত্র প্রার্থনা করেও সম্পূর্ণ ক্রিশ্চান হতে পারেননি। মনের মধ্যে কখনো কখনো অক্রিশ্চানীয় ভাব উত্থিত হয়েছে। পরে নিজেই সে কথা বুঝে, সে কাজ থেকে বিরত থেকেছেন। তবে এত দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যেও তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল একদিন প্রভু নিজে অবতীর্ণ হবেন মানবের কল্যাণে। সেদিনের আর বেশি দেরি নেই।

এর পরে এক বর্ষণ মুখর রাত্রে কুলপরিচয়হীন ভামর গির্জা ঘরে এসে সন্তান প্রসব করায়, পাদরীর বিশ্বাস হলো যে নিশ্চয়ই সদ্যোজাত শিশু রূপে প্রভু এসেছেন উদ্ধার করতে। সেই বার্তা তিনি আশে পাশের অঞ্চলে জানিয়েও দিলেন। সেই শিশুটিকে সামনে রেখেই তিনি প্রার্থনা শুরু করলেন। আশে পাশের অধিবাসীরা মতিলালের কথায় শিশুটিকে ‘দূত ঠাকুর’ বলে মেনে নিলেও তার মা ভামরের স্বভাব চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করতে লাগল। তারা পাদরীর কাছে সে কথা জানালে পাদরী তাদের কথায় আমল দিলেন না। অবশেষে একদিন মতিলালের বিশ্বাসে আঘাত লাগল। তিনি দেখলেন, যদু পতাকী বদনদের মদের আড্ডার মধ্যে বিবস্ত্র ভামরীকে। সেই দৃশ্য দেখে দুঃখে হতাশায় অভিভূত মতিলাল নিজের সমস্ত বিশ্বাস হারাতে বসলেন। এক পলকের মধ্যে পরমপিতাকে ভুলে গিয়ে সাধারণ মানুষের মতো পাশবিক অন্ধকার তাঁর মন কে আচ্ছন্ন করে ফেললো। তিনি ভামরের শিশুটিকে নির্বাসন দেবার জন্যে গভীর জঙ্গলে নিয়ে গেলেন। কোল থেকে শিশুটিকে নামিয়ে দিয়ে নিজে লুকালেন একটা গর্তের মধ্যে। কিন্তু সেখানে শিশুটির কান্না শুনে মতিলাল আর থাকতে পারলেন না। ছুটে এসে শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে অনুতাপের অশ্রু ধারায় শিশুর দু পা ধোয়াতে লাগলেন।

আলোচ্য গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মতিলাল পাদরী নামক চরিত্রটি। যদিও পাঠকের বিপুল কৌতূহল ভামরের পরিণতি দর্শনের জন্যে উৎসুক ছিল, এবং ভামরের বৃত্তান্ত জানতে আগ্রহী হয়ে উঠছিল, তবু মতিলালের দিকেই বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। লেখকও কাহিনিতে তারই মন বিবর্তনের কাহিনি বিশেষ করে তুলে ধরেছেন। কেন না, লেখকের মল, উদ্দেশ্য ভামরের বৃত্তান্ত ছিল না, ছিল মতিলালের সম্পূর্ণ ক্রিশ্চান হয়ে ওঠার সাধনা। কাহিনির শেষে দেখা যায় মতিলাল অনুতাপের মধ্যে দিয়ে নিজের সমস্ত অভিমান বা অহংকার ছেড়ে বিশুদ্ধ প্রেমময়তায় উন্নীত হয়ে প্রকৃত ক্রিশ্চান হয়ে উঠেছেন। এখানেই সার্থক হয়েছে তাঁর জীবন এবং সেই সঙ্গে সার্থক হয়েছে তাঁরই নামাশ্রয়ে গল্পের নামকরণও।