কমলকুমার মজুমদারের ‘মতিলাল পাদরী’ গল্পটির মধ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্র মতিলালের চরিত্রবিম্বনে ফুটে উঠেছে প্রকৃত ক্রিশ্চানের রূপ— যার মধ্যে প্রেম, ক্ষমা এবং সর্বজনের জন্যে কল্যাণ কামনাই একমাত্র লক্ষ্য। মতিলালের মধ্যে একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল সেই রকম সম্পূর্ণ ক্রিশ্চান হয়ে ওঠা। সেই জন্যে জীবনভ’র তিনি গির্জাটি পবিত্র করে রেখেছেন, জন কল্যাণে এক টিলা থেকে অন্য টিলায় প্রার্থনা করে বেরিয়েছেন। এ সমস্তর মধ্যে তাঁর নিঃস্বার্থ সেবা বা উপচিকীর্ষ প্রবণতা ধরা পড়েছে।

তাঁর ক্ষমাশীলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ভামরকে মাতা মেরীর মতো শ্রদ্ধার চোখে দেখার ভাব। অজ্ঞাতকুলশীল ভামর এক ঘোরতর বর্ষার রাত্রে গির্জাঘরে এসে সন্তান প্রসব করলে, সকলে ভামরের স্বভাব চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুললেও মতিলাল তাকে কখনো সন্দেহের চোখে দেখেননি। এমনকি, স্বামীর পরিচয় জিজ্ঞাসা করে তাকে বিড়ম্বিতও করেনি। আবার ভামর নিজে যখন তাঁর কাছে, তার কি হবে জানতে চেয়েছে, তখন মতিলাল বলেছেন, ‘তুমি নতুন জীবন পেয়েছে’, ‘তুমি নির্মল হও’। ভামরের প্রতি এই রকম নিঃসন্দিগ্ধ হওয়াকে অনেকে মতিলালের ঔদাসীন্য মনে করতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এ ঔদাসীন্য নয়— এ হল সবিশেষ শ্রদ্ধার নামান্তর। মতিলালের বিশ্বাস ছিল, বর্ষণ মুখর রাত্রে কোনো রকম আভাস ছাড়াই গির্জা ঘরে যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে সে ঈশ্বর প্রেরিত দূত ছাড়া আর কেউ নয়। কাজেই তার জননীর কোনো পাপ হতে পারে না। এই বিশ্বাসের মধ্যে কোনো ঔদাসীন্য বা সন্দিহান হবার স্থান ছিল না। শিশুপুত্রটিকে ঈশ্বর প্রেরিত দূত বলে ভাবা বা সেই তত্ত্বে বিশ্বাস করা ভ্রান্ত কী অভ্রান্ত মতিলালকে নিয়ে এ প্রশ্ন উঠতে পারে না। কারণ তিনি আজন্ম বাইবেলের যে শিক্ষায় লালিত সেখানে ঈশ্বরীয় দূতের আবির্ভাব কোনো বিস্ময় প্রতিপাদন করে না। বরঞ্চ শ্রদ্ধায় অভিভূত ও রোমাঞ্চিত করে তোলে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মতিলালের দৈবনিষ্ঠ অগাধ ও স্থির ভক্তি বিশ্বাসের প্রমাণ পাওয়া যায়।

অন্যদিকে তিনি সকলকে সুশিক্ষা দেবার চেষ্টা করতেন। সুশিক্ষা মানে সংগ্রন্থপাঠ নয়- নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে নিজেকে অসম্মান করা থেকে যাতে তারা বিরত থাকে সেই বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। অথচ, তাঁর সামনে কেউ চুটা (বিড়ি) খেলে তিনি ক্ষুব্ধ হতেন না। কেবল গির্জা ঘরে যখন বীণা দাই চুটা খেতে চেয়েছিল তখন তাতে আপত্তি করেছিলেন। আর যদু, বদন, পতাকীরা যখন তিতিরের মাংস সহযোগে মদ ও তীব্র মাদকের আসর বসিয়েছিল, তখন তাদের বলেছিলেন, “ছিঃ ছিঃ এখনও পাঁকে ডুবে থাকবি রে? কিন্তু পরক্ষণেই তিনি এই কঠিন কথা বলেছেন বলে ওই সব ‘নরকবাসী’দের কাছে ক্ষমা চাইতে গভীর রাত্রে ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়েছিলেন।

তারপর যখন যদুদের সেই আসরে ভামরকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখলেন, তখন নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। এক পলকের জন্যে পরমপিতাকে ভুলে গিয়ে নিজের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। এবং তারপর ভগ্ন আত্মবিশ্বাসী মতিলাল ভামরের শিশুটিকে নির্বাসনের অভিপ্রায়ে সেই রাত্রেই গভীর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। সেখানে এক জায়গায় ছেলেটিকে নামিয়ে রেখে, নিজে একটি গর্তের মধ্যে গিয়ে লুকালেন। কিন্তু শিশুর কান্না ও কচি কচি হাত পা থেকে কাঁকড়ে ছড়ে যাওয়ায় রক্ত ক্ষরিত হতে দেখে আর সহ্য করতে না পেরে, ছুটে এসে শিশুকে বুকে তুলে নিলেন। এত আঘাতের পরেও তিনি যে মানবতাকে বিসর্জন দিতে পারেননি, এই ঘটনা সেই সত্যকে তুলে ধরে। এবং শিশুপুত্রকে নিয়ে তিনি যখন কান্নায় ভেঙে পড়ে বলতে থাকেন, ‘আমি সত্যই ক্রিশ্চান নই গো বাপ’—তখন সেই অনুতপ্ত অশ্রুতে তাঁর সমস্ত মালিন্য মুছে গিয়ে ঈশ্বরাভিমুখী সাধকের রূপটি স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে।