মতাদর্শ সম্পর্কিত উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি

উদারনীতিক চিন্তাবিদ্রা ‘মতাদর্শ’ বলতে সকল রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝান না। তাঁরা বাছ-বিচার করে মতাদর্শ শব্দটি প্রয়োগ করার পক্ষপাতী। তাঁদের অভিমত অনুযায়ী বিশেষ ধরনের রাজনীতিক ধ্যান ধারণাই হল মতাদর্শ। মতাদর্শ হিসাবে পরিচিত রাজনীতিক ধারণাগুলি নিন্দিত ও সমালোচিত। মতাদর্শ বদ্ধমূল ধারণাগত, কিন্তু যুক্তিসহ নয়। মতাদর্শে কার্যকরীতার কথা উপেক্ষা করা হয় এবং কেবল যুক্তিবলে মতবাদ দাঁড় করানর চেষ্টা করা হয়। মতাদর্শ প্রাধান্যকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি বিশেষভাবে বিরূপ। মতাদর্শ একান্ত অনুরক্ত ব্যক্তিবর্গকে সংগঠিত করে রাজনীতিক দলে পরিণত করে। মতাদর্শ অসহিষ্ণুতা, দোষদর্শিতা ও রাজনীতিক পীড়নের জন্ম দেয়। এই কারণে অনেকে মতাদর্শকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ ধর্ম’ (secular religion) হিসাবে আখ্যায়িত করার পক্ষপাতী। মতাদর্শের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসাবে উদারনীতিবাদীরা মার্কসবাদ, ফ্যাসিবাদ এবং কয়েক ধরনের জাতীয়তাবাদের কথা বলেন। অ্যান্ড্রু হেউড (Andrew Heywood) তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Liberals, particularly during the Cold War period, have viewed ideology as an officially sanctioned belief system that claims a monopoly of truth, often through a spurious claim to be scientific. Ideology is therefore inherently repressive, even totalitarian; its prime examples are communism and fascism.”

উদারনীতিক অর্থে মতাদর্শের আলোচনা প্রধানত মার্কিন মুলুকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত পুঁথিপত্রে পরিলক্ষিত হয়। মার্কিন উদারনীতিবাদীদের আলোচনায় মতাদর্শ হল কিছু কেন্দ্রীয় মূল্যবোধকে ঘিরে সংগঠিত বিশ্বাসসমূহ। মতাদর্শ সম্পর্কিত উদারনীতিক ধারণার প্রবক্তাদের মধ্যে কার্ল পপার (Karl Popper) ও ড্যানিয়েল বেল (Daniel Bell)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পপার ও বেলের অভিমত অনুযায়ী মতাদর্শসমূহ হল রাজনীতিক চিন্তাধারার আবদ্ধ ব্যবস্থা। মতাদর্শ সত্যের উপর তার একাধিপত্য বা একচেটিয়া অধিকার দাবি করে। মতাদর্শে সবকিছুকেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু কোন রকম বিরোধী মতামত বা সমালোচনাকে সহ্য করা হয় না। পপার ও বেল সমেত অন্যান্য উদারনীতিক চিন্তাবিদরা মার্কসবাদ ও ফ্যাসীবাদকে মতাদর্শ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা আরও বলেছেন যে, মার্কসবাদ ও ফ্যাসীবাদ পীড়নমূলক ও সামগ্রিকতাবাদী ব্যবস্থা কায়েম করেছে।

উদারনীতিক রাষ্ট্রদার্শনিকদের অভিমত অনুযায়ী সকল রাজনীতিক ধারণাকে মতাদর্শ বলা যায় না। উদাহরণ হিসাবে উদারনীতিবাদের কথা বলা যায়। উদারনীতিবাদ হল উন্মুক্ত চিন্তাধারা বা ব্যবস্থা; মতাদর্শের মত আবদ্ধ ব্যবস্থা নয়। উদারনীতি সকল সত্যের উপর তার একাধিপত্য দাবি করে না। উদারনীতিবাদে বাক্য ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সংরক্ষণে অঙ্গীকারের কথা বলা হয়। রাজনীতিক মতামতের খোলাখুলি প্রকাশ ও প্রতিযোগিতাকে উদারনীতিবাদে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়।

মতাদর্শ সম্পর্কিত ম্যানহেইম-এর দৃষ্টিভঙ্গি

জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ কার্ল ম্যানহেইম (Karl Mannheim) মতাদর্শের অ-মার্কসবাদী ধারণার পরিচয় দিয়েছেন। এ বিষয়ে ম্যানহেইমের বক্তব্য বিস্তারিতভাবে জানা যায় তাঁর লেখা Ideology and Utopia শীর্ষক গ্রন্থ থেকে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সহমত পোষণ করে এই জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ বলেছেন যে, শাসক গোষ্ঠীর বিশ্বাস ও মূল্যবোধসমূহকে নিয়ে মতাদর্শের সৃষ্টি হয়। এই মতাদর্শ প্রকৃত অবস্থাকে আবছা করে দেয় এবং এইভাবে স্থায়িত্ব বিধান করে। তাঁর মতানুসারে মতাদর্শসমূহ হল বিভিন্ন চিন্তা-ব্যবস্থা। বিশেষ একটি সামাজিক বিন্যাস বা ব্যবস্থাকে বজায় রাখাই এর কাজ। মতাদর্শ শাসক গোষ্ঠীর বা প্রাধান্যকারী গোষ্ঠীর স্বার্থসমূহের অভিব্যক্তি ঘটায়। মতাদর্শের সৃষ্টির ক্ষেত্রে অর্থনীতিই হল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এই মার্কসবাদী বক্তব্যকে ম্যানহেইম স্বীকার বা সমর্থন করেননি, মার্কসবাদীদের এই অবস্থানের তিনি বিরোধিতা করেছেন। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এই বিষয়ে বলেছেন: “Like Marx, he acknowledged that people’s ideas are shaped by their social circumstances, but, in contrast to Marx, he strove to rid ideology of its negative implications.”

ম্যানহেইম মতাদর্শের “নির্দিষ্ট’ (particular) এবং ‘সম্পূর্ণ’ (total) ধারণাসমূহের মধ্যে পার্থক্যমূলক আলোচনা করেছেন। বিশেষ ব্যক্তিবর্গ, গোষ্ঠীসমূহ বা দলসমূহের বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা হল নির্দিষ্ট মতাদর্শ। অপরদিকে সম্পূর্ণ মতাদর্শ বলতে বোঝায় একটি সামাজিক শ্রেণী, সমাজ, এমন কি একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সমগ্র বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিকে। এই জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ এও বলেছেন যে, সকল মতাদর্শগত ব্যবস্থা বিকৃত। কারণ প্রতিটি মতাদর্শই সামাজিক ব্যবস্থার আংশিক সত্যকে প্রকাশ করে। মতাদর্শ হল সামাজিক বাস্তবতার আত্মস্বার্থ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি। হেউড বলেছেন: According to Mannheim objectivity is strictly the preserve of the ‘socially unattached intelligentsia’, a class of a intellectuals who alone can engage in disciplined and dispassionate enquiry because they have no economic interest of their own.”

মতাদর্শের রক্ষণশীল ধারণা

মতাদর্শ সম্পর্কিত রক্ষণশীল ধারণাও আলোচনা করা আবশ্যক। রক্ষণশীল চিন্তাবিদরা রাজনীতির মতাদর্শগত ধরনকে স্বীকার বা সমর্থন করেননি, বাতিল করে দিয়েছেন। মতাদর্শমূলক রাজনীতি বিমূর্ত কিছু নীতি বা পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত কিছু মতবাদের ভিত্তিতে এই বিশ্বসংসারকে পুনর্গঠিত করার পক্ষপাতী। রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মতাদর্শকে চিন্তাধারার বিমূর্ত ব্যবস্থা বা কতিপয় ধারণা হিসাবে দেখা হয়। এ সবের উদ্দেশ্য হল সামাজিক বাস্তবতার বিকৃতি সাধন বা সরলীকরণ। কারণ মতাদর্শসমূহ এমন সব বিষয়াদি ব্যাখ্যা করে বলে দাবি করে, যে সমস্ত বিষয় প্রকৃত প্রস্তাবে উপলব্ধির অসাধ্য বা বোধবুদ্ধির অগম্য। রক্ষণশীল চিন্তাবিদদের অভিমত অনুযায়ী এই বিশ্বসংসার অতিমাত্রায় জটিল। এই জটিলতা অপরিসীম। এই জটিলতার গভীরতা পরিমাপ করা মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির সামর্থ্যের কাছে অনেকাংশে অগম্য। মতাদর্শ সম্পর্কিত রক্ষণশীল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যুক্তিবাদ বা প্রগতি সম্পর্কে নাস্তিক্য বা সন্দেহবাদিতাপূর্ণ মনোভাবের সূত্রে। বিগত বিমূর্ত বিবিধ নীতি ও দর্শনসমূহের প্রতি সুদীর্ঘকালের রক্ষণশীল অবিশ্বাসের ভিত্তিতে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। রক্ষণশীল ধারণায় মতাদর্শকে অন্ধবিশ্বাসের সমগোত্রীয় করা হয়েছে। তদনুসারে মতাদর্শ হল অটল-নিশ্চল এবং বাস্তবতারহিত কিছু তাত্ত্বিক বিশ্বাস। বাস্তব পৃথিবীর জটিলতার সঙ্গে এ সবের কোন সম্পর্ক নেই। অ্যান্ড্রু হেউড (Andrew Heywood) তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Conservaties have traditionally regarded ideology as a manifestation of the arrogance of rationalism. Ideologies are elaborate systems of thought that are dangerous or unreliable because, being abstracted from reality, they establish principles and goals that lead to repression or are simply unachievable. In this light, socialism and liberalism are clearly ideological.”

মতাদর্শের রক্ষণশীল ধারণার আধুনিক প্রবক্তাদের মধ্যে মিখায়েল ওয়াকেস্ট (Michael Oakeshott) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ব্রিটিশ রাজনীতিক দার্শনিক তাঁর Rationalism in Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।