মধ্যযুগের সাহিত্যভূমিতে মঙ্গলকাব্যগুলি যেন একরাশ সূর্যমুখী ফুল—তার জন্ম মাটিতে, পরিপুষ্টতা মাটির রসে ও মাটিঘেঁষা জীবনের স্বেদবিন্দু ছায়ায়, অথচ প্রতি মুহূর্তে দৈব কৃপালাভের জন্য ক্রমাগত তার ঊর্ধ্বমুখী প্রার্থনা। বস্তুত, পদাবলী, চরিতকাব্য বা অনুবাদ-শাখার মতো মঙ্গলকাব্যগুলিও বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট পর্যায়। এর আখ্যানের বহিরঙ্গে আছে দৈবলীলা বা দেব-দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার, অন্তরঙ্গে আছে সেই দেব-দেবী বা শাপভ্রষ্ট চরিত্রের মানবিক স্বভাবের রূপায়ণ। লোকসমাজে পূজা-প্রচার ও স্বর্গলোকে প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় এখানে দ্বন্দ্বই হয়েছে দেবতা ও মানব-চরিত্রের বিধিলিপি।
এইজন্য রবীন্দ্রনাথ ‘কালান্তর’ গ্রন্থে ‘বাতায়নিকের পত্রে’ ব্যাখ্যা করেছিলেন: “বাংলা মঙ্গলকাব্যের বিষয়টা হচ্ছে, এক দেবতাকে তার সিংহাসন থেকে খেদিয়ে দিয়ে আরেক দেবতার অভ্যুদয়। সহজেই এই কথাটা মনে হয়, দুই দেবতার মধ্যে যদি কিছু নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকে তাহলে সেটা ধর্মনীতিগত তারতম্য নিয়ে।” রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এই প্রতিযোগিতার বিষয়-রূপায়ণের অন্তরালে কোন ধর্মনীতিমূলক আদর্শ লক্ষ্য করেন নি, মানববুদ্ধির অগম অগোচর দৈবমাহাত্ম্য ঘোষণাই এর মৌল উপজীব্য বিষয় বলে ভেবেছিলেন। এই অনুমান সত্য, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য নয়।
মঙ্গলকাব্যগুলি ধর্মীয় বিচারে দেব-দেবীর মহিমা জ্ঞাপক কাহিনী। ইতিহাসের বিচারে, মধ্যযুগীয় মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতার পটভূমিতে আত্মরক্ষার পুরাণ। কারণ তুর্কী আক্রমণোত্তর বাংলাদেশে বিজাতীয় সংস্কৃতিবাহী বিধর্মী বা বিপরীতধর্মী রাষ্ট্রশক্তির অপ্রতিহত প্রতিষ্ঠায় ধন-প্রাণ-ধর্মরক্ষার চিন্তায় হিন্দু-মানস হয়ে উঠেছিল অস্থির। কিন্তু অস্থির হলেও বর্ণ-বৈষম্য ও ধর্ম-কলহের ফলে তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছিল ঐক্যহীন। উপরন্তু, সংসার ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন অনেকে। সেইসঙ্গে পার্থিব সুখ-সমৃদ্ধিলাভের বাসনায় বিপন্ন মানুষ খুঁজে চলেছিল শক্তিমান অথচ তার ঐহিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন কোন স্থানীয় দেবতা, পুরাণ বা উপপুরাণের উপাদানে যার দেবসত্তা স্বীকৃত। মঙ্গলকাব্যের আখ্যান অবশ্য মূলতঃ উপপুরাণ-নির্ভর। তার কারণ Winternitz এর মতে, উপপুরাণে আছে স্থানীয় ধর্ম সম্প্রদায়-জনিত বিচিত্র তথ্যসমূহ। তার নিজের ভাষায় : “As regards the Upapuranas, they do not in general differ essentially from the Puranas except in as much they are even more exclusively adapted to suit the purposes of local cult and the religious need of separate sects”
সম্ভবত, এই স্থানীয় বা আঞ্চলিক দেবচিন্তার প্রয়োজন অনুভব করেই কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম তার কাব্যে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন : “গ্রামের দেবতা বন্দি আসর ভিতর।” এই দেবতা একান্তভাবে মানুষের সামাজিক তথা সাংসারিক প্রয়োজন মেটাতেই মঙ্গলকাব্যে আবির্ভূত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, পৌরাণিক চরিত্রে মানবিকিকরণেও এই প্রয়োজনবোধে ঘটেছে। এই রূপাস্তর মঙ্গল কাব্যধারার প্রধান চরিত্র শিব-দুর্গার প্রসঙ্গ লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়।
সংস্কৃত সাহিত্যে ও হিন্দু পুরাণের প্রাণপুরুষ ‘শিব’ বা ‘মহেশ্বর’। কিন্তু শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মহেশ্বর-বন্দনায়, ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বা কালিদাসের শকুন্তলা নাটকের প্রস্তাবনায় যে ত্রিলোক-বিস্তারী মহাদেবের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, সৃজন হননের বিশ্বনৃত্যনট, সেই মহাদেবের সঙ্গে মঙ্গল কাব্যের শিবের সাদৃশ্য শুধু নামগত।
আবার এই মঙ্গলকাব্যেই মহাদেবকে তিরস্কার করে পার্বতী যখন বলেন—“ছিঁড়িয়া পড়ুক হাড়ের মালা, পড়িয়া ভাঙুক লাউ। কপালে দ্বিতীয়ার চন্দ্র তারে গিলুক রাউ” । (‘শিবের সন্ধানে চণ্ডী’ : বিজয় গুপ্ত) তখন শুধু তথাকথিত একটি নিম্নস্তরবর্তিনী মানবীয় চিত্র পাই না, রক্তমাংসের এক গৃহিণী নারীর দৃপ্ত মনোভঙ্গিরও পরিচয় পাই। এখানে দেবতা ও মানুষের মধ্যে কোন স্পষ্ট পার্থক্য নেই।
মঙ্গলকাব্যগুলি রচনার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল, দৈবিশক্তির মহিমা প্রচার : ‘That a God inspired his soul (Ency. Brit.) এই মহিমাপ্রচারের মর্ত্যে আবির্ভূত মঙ্গলকাব্যের নায়ক-নায়িকারা প্রায় সকলেই শাপভ্রষ্ট এবং মর্ত্য জীবনযাপনের পর সংশোধিত বলে কথিত। তবু মঙ্গলকাব্য শুধু দৈব মহিমাপ্রচারের নিদর্শন রূপে ধর্মায়ণ নয়, সাহিত্যায়নও বটে। তাই দৈবী-কাব্যের আধারে এখানে সুস্পষ্ট মানবিক সুখদুঃখের আলো-আধি, পার্থিবতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ।
আপাতদর্শনে সমস্ত মঙ্গলকাব্যেই আছে আখ্যানের দুটি বিভাগ দেবখণ্ড এবং মানবখণ্ড, যেন স্বর্গ ও মর্ত্য–দেবত্ব আর মানবত্ব। স্বর্গের অধিবাসী দেব-দেবী বা গন্ধর্বের কথায় পুরাণ-প্রসঙ্গ। তাদের রূপ-গুণ বর্ণনার পরিবর্তে বরং শাপগ্রস্ত হওয়ার দুঃখজনক সংবাদজ্ঞাপন প্রায় সব মঙ্গলকাব্যেই অল্প বিস্তর লক্ষ্য করা যায়।
আবার এখানেই স্থান পেয়েছে শিব-শিবানীর বিবাহ ও তারপরে তাঁদের সাংসারিক দুঃখ-ধান্দা, কলহ-প্রীতি ইত্যাদি যা একান্তভাবে বাঙালীর গার্হস্থ্যজীবনের প্রতিচিত্র, নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক বাঙালীর ভাবনা-বাসনার প্রতিফলন। এই অংশে দেবত্ব আর মানব আচরণে কোন সীমারেখা নেই, বোঝা যায় কবি নিজেই ‘দেবখণ্ড’ ও ‘মানবখণ্ডে’ পার্থক্যরক্ষায় আগ্রহী নন। কারণ, কি শিব-গৌরীর গৃহকথায়, কি ব্যাধ বা বেনের ভাগ্যলাভের আখ্যানকথায় মঙ্গলকাব্যের কবি অভিজাত ও লোকায়ত মানসকে যথাসম্ভব মেলাতে চেয়েছেন।
বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলির রচনাকাল খ্রীস্টীয় ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী। গবেষক ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে এই কাব্যধারার সংজ্ঞা নির্ণয়ে বলেছেনঃ “খ্রীস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী হইতে আরম্ভ করিয়া খ্রীস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে কবি ভারতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত বঙ্গসাহিত্যে যে বিশেষপ্রকার সাম্প্রদায়িক সাহিত্য প্রচলিত ছিল তাহাই মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত।”
তুর্কী শক্তির আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ:
ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে (১২০৩-১২০৫ খ্রীস্টাব্দ) তুর্কী শাসক বখতিয়ার খিলজীর নেতৃত্বে বঙ্গদেশে তুর্কী তাণ্ডবের যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে। পরিণামে বাংলাদেশে প্রচণ্ড শক্তিশালী সম্পূর্ণ বিপরীত বিজাতীয় ধর্মের (ইসলাম) এক রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু রাজশক্তির (সেন রাজগণ) ‘পতনের ফলে রাজকীয় আনুকূল্য-বঞ্চিত হিন্দুধর্ম আহত হয়। আবার জাত-পাত, অস্পৃশ্যতা, ইত্যাদি কারণে নিম্নবর্ণের মানুষজনের সহানুভূতি হারায়। নবাগত ইসলামধর্মের প্রতি আকর্ষণে তাদের অনেকে ধর্মান্তরিত হয়। উচ্চশ্রেণীর মধ্যে দেখা দেয় হতাশা ও ব্যর্থতার বেদনা। প্রথম পর্যায়ে ইসলামী শাসকবর্গের ধ্বংস, হত্যা, অত্যাচার ও লুণ্ঠনের নারকীয় আচরণে হিন্দু সমাজের সর্বস্তরে এক বিপন্ন মনোভাব দেখা দেয়। বস্তুত, তুর্কী আক্রমণোত্তর বাংলাদেশের স্তরে স্তরে জনজীবনে যে অস্থির-চিন্তার আলোড়ন দেখা দিয়েছিল, তারই মনোদর্পণ ‘মঙ্গলকাব্য’।
প্রাগার্য দেব-দেবী স্মরণ :
ইসলামী ধর্ম ও সংস্কৃতির আঘাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য এদেশের হিন্দু সংস্কৃতিমনা (Hindu intelligentsia) সম্প্রদায় আর্য দেবভাবনা ও আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রাগার্য দেব-দেবীর সমন্বয় সাধনের জন্য সচেষ্ট হন। সেই কারণে এতদিন ধরে উচ্চবর্ণের মানুষদের দ্বারা উপেক্ষিত চণ্ডী, মনসা, ধর্মঠাকুর প্রমুখ দেবদেবীরা রাষ্ট্রীয় অবিচার এবং আধি-ব্যাধি-সর্পভয় নিবারণে কবি-কল্পনায় দেখা দিয়েছিলেন। এইভাবে ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ওরাওঁ, সাঁওতাল, ব্যাধ বা শবর পূজিতা ‘চাণ্ডী’ বা ‘চুণ্ডী’ দেবী শিব-জায়া উমার সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠলেন, সর্পদেবী মনসা দ্রাবিড় পূজিতা ‘মঞ্চামা’ বা ‘মনোমাঞ্চী’র নামের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে বা বৌদ্ধ সর্পদেবী ‘জাঙ্গুলী’ তারার সঙ্গে জড়িত হয়ে লৌকিক দেবীরূপে আত্মপ্রকাশ করলেন। অনুরূপভাবে ধর্মঠাকুর অস্ট্রিক কূর্মবাচক ‘দরম’ বা অন্ত্যজ দেবতা ‘ডোমরায়’ কিম্বা বৌদ্ধদেবতা ‘নিরঞ্জন’ বা বৈদিক যম-ইন্দ্র-বরুণ প্রমুখ দেবতার ভাবকল্পনার সঙ্গে অভিন্ন চেতনায় ‘ধর্মমঙ্গলকাব্যে’ প্রকাশিত হলেন।
ব্রতকথা এবং পুরাণকথার মধ্যে সংযোগসাধন:
ব্রতকথা বা ‘ব্রতগীত পাঞ্চালী’ মঙ্গলকাব্যগুলির উৎস ছিল বলে ড. সুকুমার সেন, ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য, ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকেরা মন্তব্য করেছেন। এ কথা যথার্থ, মঙ্গলকাব্যের গঠনপ্রণালীর মধ্যে ব্রতকথার আভাস আছে। যেমন—
(ক) মেয়েলী ব্রতে দেবতার অনুগ্রহ ও নিগ্রহ বোঝানো হয় গল্পচ্ছলে। মঙ্গলকাব্যেও দেবতার বিজয় মহিমা সুস্পষ্টভাবে কোন কাহিনী আশ্রিত।
(খ) লোক সাহিত্যরূপে ব্রতকথায় অলৌকিকতা, কনিষ্ঠ পুত্র বা পুত্রবধূর কৃতিত্ব, সাপ-কাক-বিড়াল-শৃগাল-ভ্রমর প্রভৃতি ইতর প্রাণীর কৃতকার্য, মৃতের পুনর্জীবন, সতীত্বের পরীক্ষা, আগুন না দিয়ে লোহার মটর সিদ্ধ করা, লোহার গণ্ডার তালপাতার সাহায্যে কেটে ফেলা ইত্যাদি অলৌকিক বিষয় থাকে, যাকে পাশ্চাত্য লোকসাহিত্যবিদরা motiff নাম দিয়েছেন। বাংলা মঙ্গলকাব্যে এই ধরনের যথেষ্ট দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
(গ) স্বামী-পুত্রের কল্যাণকামনায় বঙ্গদেশের রমণীরা যে ব্রত-অনুষ্ঠান পালন করতেন, সেখানে ‘শুদ্ধাভক্তি’ তাদের লক্ষ্য ছিল না। মঙ্গলকাব্যেও দেখা যায়, দেবতারা ‘যোষিতামিষ্ট দেবতা’। তাঁদের কাছে ভক্তের প্রার্থনা—“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে” বা “ধনে পুত্রে মোর যেন বাড়ে ঠাকুরাল” ইত্যাদি। ব্রাহ্মণ্য উপাসনায়ও এই সব লোকাচারের বিরোধিতা করা হয় নি। রঘুনন্দন ও গোবিন্দানন্দ কুক্কুটী মর্কটী, সূতিকাষষ্ঠী, পিপিতকী প্রভৃতি অবৈদিক ব্রতানুষ্ঠান মেনে নিয়েছিলেন।
অন্যদিকে সংস্কৃত পুরাণ কাহিনীর বহু উল্লেখ মঙ্গলকাব্যগুলিতে প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়, যেমন–
(১) চণ্ডীমঙ্গল কাহিনীর ইঙ্গিত আছে বৃহদ্ধর্মপুরাণে।
(২) কালিদাসের কুমারসম্ভব অনুসরণে শিবের তপস্যা, মদনভস্ম, রতিবিলাপ, পার্বতীর তপস্যা প্রভৃতি প্রসঙ্গ মঙ্গলকাব্যে স্থান পেয়েছে।
(৩) ধর্মমঙ্গলে লাউসেন মহামদের বিরোধ কৃষ্ণ-কংসের বিরোধের অনুরূপ। এছাড়া লব-কুশের ছায়ায় লাউসেন-কর্পূরসেন, মায়াসীতার মতো লাউসেনের মায়ামুণ্ড কল্পনা ইত্যাদি স্মরণ করা যায়।
(৪) সংস্কৃত পুরাণ, পাশ্চাত্র Edda প্রভৃতির মতো সংগ্রামমুখর জীবনের চিত্র ‘ধর্মমঙ্গল’ ‘মনসামঙ্গল’ প্রভৃতি কাব্যে দেখা যায়।
(৫) পুরাণের সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বম্ভর ও চরিতাখ্যান প্রভৃতি পঞ্চ লক্ষণের অনেকগুলি পরিবর্তিতভাবে মঙ্গলকাব্যের আঙ্গিকে দেখা যায়।
(৬) ‘লোকত্রাণের’ সচেতন দায়িত্ব নিয়ে মঙ্গলকবিরা কাব্যরচনা করেছিলেন। তারা বিভিন্ন পুরাণকথা থেকে কাহিনী উপকরণ সংগ্রহ করে সামগ্রিকভাবে হিন্দু সমাজের চারপাশে যেন চীনের প্রাচীরে’র মতো এক দীর্ঘায়ত, শক্তিশালী ও দীপ্যমান এক ‘পৌরাণিক সংস্কৃতির দেওয়াল’ গড়ে তুলেছিলেন। সেই দেওয়ালের আড়ালে হিন্দুধর্ম ও জনজীবন রক্ষা পেয়েছিল। এ ঘটনা ঐতিহাসিক সত্য।
‘মঙ্গল’ নামের উদ্ভব ও সংজ্ঞা :
মঙ্গলকাব্যগুলির ‘মঙ্গল’ নামের কারণ ও উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলা হয়েছে। সেই তথ্যগুলিকে সূত্রাকারে এইভাবে সাজানো যেতে পারে :
(ক) ‘মঙ্গল’ কথাটি ‘গৃহকল্যাণ’ অর্থে ব্যবহার আছে ঋগ্বেদে (১০/৮৫), গার্হস্থ্য উৎসবানুষ্ঠান রূপে উল্লিখিত হয়েছে অশোকানুশাসন, নবম গিরিলিপিতে।
(খ) ‘মঙ্গল’ কথাটি ‘দেবলীলাগতি’ অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে ‘হরিবংশে”।
(গ) জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্যে “মঙ্গলম্ উজ্জ্বল গীতি” বলে গানের সূচনা হয়েছে। এছাড়া ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে ‘মঙ্গল’ নামে একটি পৃথক রাগের উল্লেখ আছে। তার মতে, একসময় মঙ্গলকাব্যগুলি এই রাগে পরিবেশিত হত।
(ঘ) ‘মঙ্গল’ কথাটি ‘বিবাহসঙ্গীত’ অর্থেও প্রচলিত ছিল বঙ্গদেশে এবং আসামে। মঙ্গলকাব্যে গৌরীর বিবাহ প্রসঙ্গে হাতে মঙ্গলসূত্রে বাঁধার অর্থেও এর প্রয়োগ আছে ঃ “মঙ্গলসূত্র বাঁধে করে ॥” (গৌরীর অধিবাস)। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায়, তামিল বা মাদ্রাজী নারীদের বিবাহের আভরণ হিসাবে ‘মঙ্গলসূত্র হার’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
(ঙ) প্রাচীন মঙ্গলকাব্যে বিবৃত মঙ্গলাসুর দৈত্য বধের কাহিনী থেকে কাব্যের এইরূপ নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়েছে।
(চ) ‘অষ্টমঙ্গলা’ অর্থাৎ মাসের এক মঙ্গলবার থেকে শুরু করে আর এক মঙ্গলবারের মধ্যে এই কাব্যপালা পাঠ সীমাবদ্ধ থাকে বলে এর ‘মঙ্গলকাব্য’ নামকরণ হতে পারে।
বলা চলে, অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন মঙ্গল-বিধায়ক দেবদেবীর বিজয় কাহিনী বর্ণনা করা যে কাব্যের লক্ষ্য, তারই নাম ‘মঙ্গলকাব্য’।
মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য :
(১) মঙ্গলকাব্যের সূচনায় কবি গণেশাদি অন্যান্য দেবদেবীর বন্দনা করে কাব্য শুরু করেন। এই বন্দনা অংশে হিন্দু দেব-দেবীর পাশাপাশি অনেক কবি অন্যান্য দেবতা এমন কি ইসলামী দেবতাকেও বন্দনা করতে কুণ্ঠিত হন নি। ‘বিবিধের মাঝে মহামিলনে’র আকাঙ্ক্ষা যেন এই অংশে আভাসিত হয়েছে। তাই এখানে হরি-হরে, বাঁশীতে-অসিতে, পীর-নারায়ণে বিশেষ দ্বন্দ্ব বাধেনি। চৈতন্য পরবর্তী মঙ্গলকাব্যগুলিতে চৈতন্য-বন্দনা স্থান পেয়েছিল এক অপরিহার্য অঙ্গ রূপে।
(২) প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যে গ্রন্থোৎপত্তির কারণ বর্ণনায় স্বপ্নাদেশ বা দৈবাদেশের উল্লেখ আছে। এই অংশে কবির ব্যক্তিজীবনের ঘনিষ্ঠ পরিচয় এমনকি সমকালীন ইতিহাসের আঞ্চলিক পরিচয় বিবৃত হয়েছে (যেমন মুকুন্দরামের কাব্যের অংশ)।
(৩) প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যের কাহিনী দেবখণ্ড এবং নরখণ্ড নামে দুটি পৃথক অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে দেবতার (প্রধানত হর-গৌরী-মনসা ইত্যাদি) জন্ম পরিচয় এবং মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয়াংশে কোন শাপভ্রষ্ট দেব-দেবী (যেমন ‘চণ্ডী মঙ্গলে’ নীলাম্বর-ছায়া, ‘মনসামঙ্গলে’ অনিরুদ্ধ-ঊষা) মর্ত্যে মানুষরূপে জন্ম নিয়ে দেবতা বা দেবীর পূজা প্রচারে উদ্যোগী হয়েছে।
(৪) মঙ্গলকাব্যের নায়ক-নায়িকাদের অনেকে বণিক বা অন্ত্যজ শ্রেণীভুক্ত, যেমন ধনপতি, চাঁদ সদাগর, শ্রীমস্ত সদাগর, ব্যাধ কালকেতু-ফুল্লরা ইত্যাদি। অনেক কাব্যে তাই সমুদ্রযাত্রার বিবরণ আছে।
(৫) সংসার জীবনের বর্ণনা সূত্রে রন্ধন-তালিকা, নারীগণের পতিনিন্দা, নায়িকার বারমাস্যা, চৌতিশা স্তব, ইত্যাদি প্রসঙ্গ বিবৃত হয়েছে।
(৬) জরতী বা বৃদ্ধার বেশে ভক্তকে ছলনা বা শত্রুপক্ষকে ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা দেখা যায়।
(৭) প্রবাদ, প্রহেলিকা, প্রবচন ইত্যাদির উল্লেখে সমকালীন সমাজজীবনের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। গোষ্ঠী বা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় কবিদের সামাজিক অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়। সাধভক্ষণ, অন্নপ্রাশন, দশবিধ ক্রিয়া-কর্মের নিপুণ বর্ণনাও দেখা যায়।
(৮) করুণরস এবং কৌতুকরসের আশ্রয়েই প্রধানতঃ মঙ্গলকাব্যগুলি লেখা হত। এর ফলে দুঃখের দারুণ দহন এবং কৌতুকের স্নিগ্ধ নির্বরে কাব্যগুলির কাহিনী সুশোভিত হয়ে উঠেছিল।
(৯) মঙ্গলকাব্যগুলিকে আশ্রয় করে পয়ার ছন্দের বিচিত্র রূপ যেমন দেখা দিয়েছিল, – তেমনি ভারতচন্দ্রের মতো কবির রচনায় বহু সংস্কৃত ছন্দের বাংলায় প্রকাশ ক ঘটেছিল।
(১০) মঙ্গলকাব্যগুলি প্রধানত দেব-মাহাত্ম্য বর্ণনার উদ্দেশ্যে রচিত। সেইজন্য এখানে মাঝে মাঝে অলৌকিক বা অপ্রাকৃত ঘটনা-সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়।
Leave a comment