“বাঙলা মঙ্গলকাব্যে শুধু দেবতার মহিমাই কীৰ্তিত হয়নি, মানুষের মহিমারও কীর্তন নাম করা হয়েছে।” বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যের কাহিনী অনুসরণ করে এই মন্তব্যের যৌক্তিকতা প্রমাণ কর।

মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব ও সৃষ্টির কারণ

আদি মধ্য যুগ থেকে আরম্ভ করে প্রাগাধুনিক কাল পর্যন্ত বিস্তৃত বাঙলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারায় মূলতঃ কিছু কিছু অনার্য দেবদেবীর এবং পরে কোন কোন পৌরাণিক দেব-দেবীর, এমন কি দেবােপম মানুষেরও গুণকীর্তন ও মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়েছিল—এই ধারাটির সাধারণ প্রচলিত নাম ‘মঙ্গলকাব্য সাহিত্য। এই ধারাটির উদ্ভব ঘটেছিল সম্ভবতঃ ক্রান্তিকালেই অর্থাৎ তুর্কী আক্রমণ-যুগেই। তুর্কী আক্রমণের আকস্মিকতা ও প্রচণ্ডতাকে প্রতিরােধ ক্ষমতা না থাকায় তৎকালীন বাঙালী আত্মরক্ষার তাগিদে প্রথম দিকটায় কূর্মবৃত্তি অবলম্বন করেছিল। এরই মধ্যে তারা অনুভব করেছিল যে, তাদের প্রতিবেশী যে সকল অনার্য আদিবাসীকে তারা দূরে সরিয়ে রেখেছিল, তাদের সহযােগিতা ছাড়া আত্মরক্ষা সম্ভবপর নয়। এই কারণেই ধীরে ধীরে তারা আদিবাসীদের সঙ্গে সহযােগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন করায় অনার্য আদিবাসীদের একটা বড় অংশ হিন্দুসমাজের অঙ্গীভূত হয়। কিন্তু এরা নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে হিন্দুত্বকে গ্রহণ করেনি—তারা তাদের সঙ্গে করে নিয়ে এলাে তাদের অনার্য জীবনের বিভিন্ন দেবদেবী, আচার-আচরণ, ধর্মবিশ্বাস আদি হিন্দুসমাজে প্রচলিত পৌরাণিক ধ্যান-ধারণা ও ভাবনার সঙ্গে এই নবাগত অনার্য ধ্যান-ধারণা আদির একটা সমন্বয় সাধন এবং সামঞ্জস্য বিধান করা হয়েছিল। এই নবাগত দেবদেবীদের মহাত্ম-প্রচারের উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছিল বাঙলা ভাষায় নব-পুরাণ এই মঙ্গলকাব্যগুলি।

অতি প্রাচীনকালে আর্য-অনার্য সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের যুগে যে সামাজিক পরিবেশে সংস্কৃত ভাষায় বহুতর পুরাণ রচিত হয়েছিল, অনুরূপ অবস্থা ও পরিবেশেই বাঙলাদেশও পরবর্তীকালে পুরাণেরই নব সংস্করণ বাঙলা মঙ্গলকাব্যগুলি রচিত হয়েছিল। বৈদিক যুগের অন্তে আর্য-অনার্য-সমন্বয়ের ফলে প্রভূত পরিমাণ অনার্য দেব-দেবী ও ধর্মভাবনা আর্যসমাজে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল। নবাগত দেবদেবী ও ধর্মভাবনাকে আর্যগণ আত্মস্থ করে নিয়ে তাকে যথােপযুক্তভাবে সামাজিক স্বীকৃতি দেবার জন্যই তারা প্রচুর পুরাণ-উপপুরাণ রচনা করেছিলেন। কালে এই পুরাণগুলির বিভিন্ন লক্ষণও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। অলঙ্কারশাস্ত্রে বলা হয়েছে— ‘সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর ও চরিত’ এগুলিই পুরাণের প্রধান লক্ষণ, যদিও প্রায় কোন পুরাণেই এ সমস্ত লক্ষণ উপস্থিত নেই। প্রাচীনকালে আর্য-অনার্য সমন্বয়ের মতই মধ্যযুগেও বাঙলাদেশে তুর্কী আক্রমণ-কালে আবার আর্য-অনার্য সমীকরণ ঘটেছিল। এখানেও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলো। অতএব অনার্য সমাজ থেকে নবাগত দেব দেবীদের মাহাত্ম্য প্রচারের জন্যই পুরাণ জাতীয় গ্রন্থের প্রয়োজন দেখা দিল। কিন্তু যুগের পরিবর্তন ঘটায় সংস্কৃত ভাষার উপযােগিতা হ্রাস পেয়েছিল। তাছাড়া এই নবজাত সাহিত্যের জনপদবাসী জনসাধারণের পংক্তিভােজে উপস্থিত রসভােক্তাদের সংস্কৃত ভাষায় রসাস্বাদনের ক্ষমতা না থাকায় এ জাতীয় গ্রন্থ রচিত হয়েছিল বাঙলা ভাষায়। আবার এ জাতীয় গ্রন্থের নায়ক-নায়িকারা কেউ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদি উচ্চবর্ণের ধীরােদাত্ত প্রভৃতি গুণসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন না, এরা এসেছেন সমাজের একেবারে নিম্নস্তর থেকে, বড় জোর এরা ছিলেন বণিক জাতীয়। কাজেই সংস্কৃত ভাষায় এদের কাহিনী রচনা করলে বাস্তবের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য থাকতাে না। এই কারণেই পুরাণ-জাতীয় হওয়া সত্ত্বেও নবপুরাণ মঙ্গলকাব্যগুলি বাঙলা ভাষায় রচিত হয়েছিল।

ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে (১২০৩-১২০৫ খ্ৰীঃ) তুর্কী শাসক বখতিয়ার খিলজীর নেতৃত্বে বঙ্গদেশে তুর্কী তাণ্ডবের যুগান্তরকারী ঘটনা ঘটে। পরিণামে বাংলাদেশে প্রচণ্ড শক্তিশালী সম্পূর্ণ বিপরীত বিজাতীয় ইসলাম ধর্মের এক রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধে হিন্দু রাজশক্তি সেন বংশের পতনের ফলে রাজকীয় আনুকূল্য থেকে হিন্দু ধর্ম বঞ্চিত হয়। আবার জাত পাত অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি কারণে হিন্দু ধর্ম নিম্ন বর্ণের মানুষ জনের সহানুভূতি হারায়। নবাগত ইসলামধর্মের প্রতি আকর্ষণে অনেকে ধর্মান্তরিতও হয়। উচ্চ শ্রেণির মধ্যে দেখা দেয় হাতাশা ও ব্যর্থতার বেদনা। প্রথম পর্যায়ে ইসলামী শাসকবর্গের ধ্বংস, হত্যা, অত্যাচার ও লুণ্ঠনের নারকীয় আচরণে হিন্দু সমাজের সর্বস্তরে এক বিপন্ন মনোভাব দেখা দেয়। বস্তুত তুর্কী আক্রমনোত্তর বাংলাদেশের জনজীবনে যে অস্থির চিন্তার আলোড়ন দেখা দিয়েছিল তারই মনোদর্পণ ‘মঙ্গলকাব্য’ ইসলামী ধর্ম ও সংস্কৃতির আঘাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য এদেশের হিন্দু সংস্কৃতিমনা সম্প্রদায় আর্য দেবভাবনা ও আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রাগার্য দেবদেবীর সমন্বয় সাধনের জন্য সচেষ্ট হন। ফলে, এত দিন ধরে উচ্চবর্ণের মানুষদের দ্বারা উপেক্ষিত চন্ডী-মনসা-ধর্ম ঠাকুর দেবদেবীরা, রাষ্ট্রীয় অবিচার এবং আধি ব্যাধি সর্পভয় নিবারণে কবিকল্পনায় দেখা দিয়েছিল।

মঙ্গল কাব্যগুলির রচনার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ‘That a god inspired his soul’ অর্থাৎ দৈব শক্তির মহিমা প্রচার। এই মহিমা প্রচারের জন্য মর্তে আবির্ভূত মঙ্গলকাব্যের নায়ক-নায়িকারা সকলেই শাপভ্রষ্ট দেবতা এবং মর্ত্য জীবন যাপনের পর তাদের স্বর্গলোকে প্রত্যাবর্তণ। কথিত। তবু মঙ্গলকাব্য শুধু দৈব মহিমা প্রচারের নিদর্শন রূপে নয়, দৈবী কাব্যের আধারে এখানে সুস্পষ্ট মানবিক সুখ দুঃখের, স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। আপাত দর্শনে সমস্ত মঙ্গলকাব্যেই আখ্যানের দুটি বিভাগ – দেব ও মানব খণ্ড। স্বর্গের অধিবাসী দেবদেবী বা গন্ধবের্র কথায় পুরাণ প্রসঙ্গ, তাদের রূপ গুণ বর্ণনার পরিবর্তে বরং শাপগ্রস্ত হওয়ার দুঃখজনক সংবাদ জ্ঞাপন প্রায় সব মঙ্গলকাব্যেই অল্প বিস্তর লক্ষ্য করা যায়। আবার এখানেই স্থান পেয়েছে শিব-শিবানীর বিবাহ ও পরে তাঁদের সাংসারিক দুঃখ, কলহপ্রীতি ইত্যাদি যা একান্তভাবে বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের প্রতিচিত্র এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক সমাজের ভাবনা-বাসনার প্রতিফলন। এক কথায়, মঙ্গলকাব্যের কবি অভিজাত ও লোকায়ত মানসকে যথাসম্ভব মেলাতে চেয়েছেন।

মঙ্গলকাব্যের নামকরণ ও সংজ্ঞা

মঙ্গলকাব্যের ‘মঙ্গল’ শব্দটি অতিশয় ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ বিষয়ে অধ্যাপক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন : “মঙ্গলকাব্যগুলি গান করিয়া দেবতার মাহাত্ম্য ও পূজা প্রচার করা হইত। সেই গান একটি বিশেষ রকম সুরে হইত এবং সেই সুরকেও মঙ্গল বলিত। বাঙলা যাত্রা’ মানে যেমন গান ও গমন উভয়ই, হিন্দিতে তেমনি মঙ্গল মানে মেলা, যাত্রা বা গমন। ….যে গান শুনিলে মঙ্গল হয়, যে গানে দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারিত, যে গান মেলায় গীত এবং যে গান একদিন যাত্রা করিয়া অর্থাৎ আরম্ভ হইয়া আট দিন ব্যাপিয়া চলে তাহাকেই মঙ্গলগান বলে।” এ বিষয়ে ডঃ আশুতােষ ভট্টাচার্যও বলেন- “ব্যক্তিগত কল্যাণ কামনায় দেবতার আশীর্বাদ প্রার্থনা করিয়া যে। গান রচিত হয় তাহাকেই মঙ্গল’ বা ‘মঙ্গলগান’ বলে।” মধ্যযুগে প্রতিকূল রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের বাস্তব উপায় না থাকায় হিংশ্রস্বভাব দেবীর কাছেই মঙ্গলকামনায় বঙ্গসমাজ আত্মসমর্পণ করেছিল। সাহিত্যে মঙ্গল’ শব্দের খুব প্রাচীন প্রয়ােগ পাওয়া যায় জয়দেবের রচনায়। তিনি তার ‘গীতগােবিন্দ’ কাব্যকে ‘উজ্জ্বলমঙ্গলগীতি’ বলে অভিহিত করেছে। এখানে ‘মঙ্গল’ শব্দের অর্থ কাহিনীপ্রধান রচনা’ বলেই অনুমিত হয়। ‘মঙ্গল’ শব্দটি যুক্ত থাকার জন্যই সম্ভবতঃ এক মঙ্গলবারে আরম্ভ হয়ে পরবর্তী মঙ্গলবারে আটদিনে ষােল পালায় এর পাঠ সমাপ্ত হতাে।

“দেব মাহাত্ম্য বাচক বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য যে আখ্যান কাব্য রচিত হইয়াছিল, সাধারণ কথায় তাহাকে মঙ্গলকাব্য বলা যায়।”—অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে : “খ্রীষ্টীয় এয়োদশ শতাব্দী হইতে আরম্ভ করিয়া খ্ৰীষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে কবি ভারতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত বঙ্গ সাহিত্যে যে বিশেষ প্রকার সাম্প্রদায়িক সাহিত্য প্রচলিত ছিল তাহাই মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত।”

মঙ্গল কাব্যগুলির নামের সংজ্ঞা সম্পর্কে সমালোচকদের দ্বারা বিভিন্ন বিপরীত মতামত নির্দেশিত হয়েছে। সে সমস্ত তথ্যগুলি সূত্রাকারে সাজানো যেতে পারে

১। মঙ্গল কথাটি ‘গৃহকল্যাণ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ঋগ্বেদে, গার্হস্থ্য উৎসবানুষ্ঠান রূপে উল্লিখিত হয়েছে অশোকের অনুশাসন লিপিতে, এবং নবম গিরিলিপিতে।

২। মঙ্গল কথাটি ‘দেবলীলাগতি’ অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে—‘হরিবংশে’।

৩। জয়দেবের গীতিগোবিন্দম কাব্যে “মঙ্গলম্ উজ্জ্বলগীতি” বলে গানের সূচনা হয়েছে। এছাড়া ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে ‘মঙ্গল’ নামে একটি পৃথক রাগের উল্লেখ আছে। তাঁর মতে, এক সময় মঙ্গলকাব্যগুলি এই রাগে পরিবেশিত হোত।

৪। মঙ্গল কথাটি বিবাহ সঙ্গীত অর্থেও প্রকাশিত ছিল বঙ্গদেশে এবং আসামে। মঙ্গলকাব্যের গৌরীর বিবাহ প্রসঙ্গে হাতে মঙ্গল সূত্র বাঁধার অর্থেও এর প্রয়োগ আছেঃ “মঙ্গল সূত্র বাঁধে করে” (গৌরীর অধিবাস)। প্রসঙ্গতঃ স্মরণ করা যায়, তামিল বা মাদ্রাজী নারীদের বিবাহের আভরণ হিসাবে ‘মঙ্গলসূত্র হার’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

৫। প্রাচীন মঙ্গলকাব্যে বিবৃত মঙ্গলাসুর দৈত্য বধের কাহিনী থেকে কাব্যের এইরূপ নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।

৬। ‘অষ্টমঙ্গলা’ অর্থাৎ মাসের এক মঙ্গলবার থেকে শুরু করে আর এক মঙ্গল বারের মধ্যে কাব্য পালার পাঠ সীমাবদ্ধ থাকে বলে এর মঙ্গলকাব্য নামকরণ হতে পারে।

এককথায় বলা চলে অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন মঙ্গল বিধায়ক দেবদেবীর বিজয় কাহিনি বর্ণনা করা যে কাব্যের লক্ষ্য, তাকে মঙ্গল কাব্য বলা হয়।

মঙ্গলকাব্যের বৈচিত্র্য বা রূপ

মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব ঘটেছিল সম্ভবতঃ তুর্কী আক্রমণ- কালে তথা ক্রান্তিকালে। তখন তার আকার বা রূপ কেমন ছিল, তা জানা না থাকলেও অনুমান করা হয় যে, তখন মঙ্গলকাব্যের কাহিনীগুলি সংক্ষিপ্ত পাঁচালীর আকারেই বর্তমান ছিল। তারপর আদিমধ্যযুগেই আমরা প্রচলিত আকারে পাচ্ছি অন্ততঃ মঙ্গলকাব্যের একটি ধারা— ‘মনসামঙ্গল’ বা ‘পদ্মপুরাণ’কে। অন্ত্যমধ্যযুগে সবচেয়ে উৎকৃষ্টরূপে আত্মপ্রকাশ করে চণ্ডীমঙ্গল বা অভয়ামঙ্গল। মঙ্গলকাব্য শাখার তৃতীয় প্রধান শাখা ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের উদ্ভব অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে। মঙ্গলকাব্যের প্রধান চারটি ধারার অপরটি শিবমঙ্গল’, যেটি সাধারণতঃ শিবায়ন’ নামেই অধিকতর পরিচিত। মঙ্গল’-নামে অভিহিত হলেও শিবায়ন প্রকৃতপক্ষে মঙ্গলকাব্য নয়। এরূপ একটি ধারা ‘কৃষ্ণমঙ্গল’—এটি বস্তুতঃ ভাগবতের অনুবাদ। পরে আরাে অনেক অনার্য সমাজ থেকে আগত দেব-দেবী-বিষয়ক পৌরাণিক কাহিনী এবং কাব্যও ‘মঙ্গলকাব্যের পরিচয় লাভ করেছে, এমন কি দেবােপম নর-নারীর কাহিনীর নামেও ‘মঙ্গল’ শব্দ যুক্ত হয়েছে।

প্রাচীনত্ব, সংখ্যা ও উৎকর্যের বিচারে মঙ্গলকাব্যগুলিকে প্রধান দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা চলে। 

প্রধান মঙ্গলকাব্য:

প্রধান মঙ্গলকাব্যসমূহের মধ্যে পড়ে ‘মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ও শিবায়ন’। আপাতত যে সমস্ত মঙ্গলকাব্যের পুথি আমাদের হস্তগত হয়েছে, তার বিচার-বিশ্লেষণ থেকে অনুমিত হয় যে মনসামঙ্গল’ বা ‘পদ্মাপুরাণ’-ই প্রাচীনতম। এর অন্ততঃ তিনজন গ্রন্থকারকে চৈতন্য-পূর্ব কালে স্থাপন করা হয়; এরানারায়ণদেব, বিজয়গুপ্ত ও বিপ্রদাস পিপলাই। মনসামঙ্গল কাব্যের এ ছাড়াও অর্ধশতাধিক কবির নাম পাওয়া গেলেও এঁদের মধ্যে দ্বিজ বংশীদাস এবং কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের নামই বিশেষ উল্লেখযােগ্য। বণি-প্রধান চাঁদসদাগর বা সাধু চন্দ্রধরের পূজা লাভের জন্য দেবী মনসার নিষ্ঠুরতার কাহিনীই এর প্রধান উপজীব্য।

চণ্ডীমঙ্গল ও প্রাচীন কাব্য, তবে চৈতন্য-পূর্বযুগের কোন কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায় না; এই ধারার কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী সমগ্র মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করে থাকেন। অপর কবি দ্বিজ মাধব। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে দু’টি পরস্পর-নিরপেক্ষ কাহিনী একটি ব্যাধসন্তান কালকেতু ও ফুল্লরার কাহিনী, অপরটি বণিক ধনপতি সদাগরের কাহিনী। এই কাব্যে দেবী চণ্ডীর মধ্যে নিষ্ঠুরতার পরিচয় নেই।

‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের উদ্ভব ও বিস্তৃতি রাঢ় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। এর প্রধান কাহিনী লাউসেনকে অবলম্বন করে গড়ে উঠলেও পার্শ্বকাহিনী রয়েছে অনেকগুলি। এতে কিছু কিছু পৌরাণিক কাহিনীও যুক্ত হয়েছে। এই ধারার কবিদের মধ্যে ঘনরাম চক্রবর্তী প্রভৃতির নাম উল্লেখযােগ্য। ‘শিবায়ন’ কাব্যের প্রধান দেবতা পৌরাণিক শিব—অতএব পূর্বোক্ত মঙ্গলকাব্যগুলির সঙ্গে এর একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। অবশ্য শিবায়ন কাব্যে পৌরাণিক কাহিনীর পাশাপাশি লৌকিক কাহিনীও যুক্ত রয়েছে। এই ধারার কবিদের মধ্যে রামেশ্বর চক্রবর্তী, কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী প্রভৃতির নাম উল্লেখযােগ্য।

অপ্রধান মঙ্গলকাব্য:

অপ্রধান মঙ্গলকাব্যের অনেকগুলিই পৌরাণিক দেবদেবীদের মাহাত্ম্য প্রচার-উপলক্ষ্যে রচিত। অতএব এদিক থেকে এগুলিকে মূল ধারার বহির্গত বলাই উচিত। এই অপ্রধান মঙ্গলকাব্যধারায় কোন উল্লেখযােগ্য কবির পরিচয় পাওয়া যায় না-রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র এবং তার কাব্য ‘অন্নদামঙ্গল’ই এর ব্যতিক্রম। অপ্রধান ধারায় রয়েছে গঙ্গামঙ্গলএই ধারার কবিদের মধ্যে আছেন মাধব, দ্বিজ গৌরাঙ্গ, দ্বিজ কমলাকান্ত, দুর্গাপ্রসাদ। গৌরীমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা পাকুড়ের ভূস্বামী পৃথ্বীরাজ। ‘শীতলামঙ্গল’ কাব্যের কবিদের মধ্যে আছেন নিত্যানন্দ ও বল্লভ। ‘দুর্গামঙ্গল’ কাব্যের কাহিনীকার ভবানীপ্রসাদ, রূপনারায়ণ ও রামচন্দ্র। ‘বাসুলীমঙ্গল’ কাব্যকারদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য কবিচন্দ্র মুকুন্দ। ‘ষষ্ঠীমঙ্গল’ কাব্যের কবি কৃষ্ণরাম, রুদ্ররায় ও শঙ্কর। ‘রায়মঙ্গল’ বা বিদ্যাসুন্দরের অনেক কবিদের মধ্যে আছেন,ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, কবি কঙ্ক, সাবিরিদ খাঁ। এগুলি ছাড়াও রয়েছে- ‘সূর্যমঙ্গল’, ‘কপিলামঙ্গল’, ‘গােসানীমঙ্গল’, ‘ভবানীমঙ্গল’, ‘সারদামঙ্গল’, ‘লক্ষ্মীমঙ্গল’, ‘তীর্থমঙ্গল’ প্রভৃতি।

এ ছাড়া চৈতন্যমঙ্গল’, অদ্বৈতমঙ্গল আদি গ্রন্থের সঙ্গে মঙ্গল’ শব্দ যুক্ত থাকলেও এগুলি বস্তুতঃ জীবনীগ্রন্থ—নাম ছাড়া মঙ্গলকাব্যের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই।

মঙ্গলকাব্যের লক্ষণ বা রূপগত বৈশিষ্ট্য

পুরাণগুলির কিছু আঙ্গিক লক্ষণ আলঙ্কারিকগণ নির্দেশ করলেও মঙ্গলকাব্যের এরূপ রূপগত বৈশিষ্ট্য-বিষয়ে আলঙ্কারিকগণ কিছু বলেন নি। অবশ্য পুরাণগুলিতে আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য বিষয়ে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ পুরাণকার তা মান্য করেন নি। বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের মধ্যে আমরা যে সকল সাধারণ লক্ষণ খুঁজে পাই, সেগুলিকেই রূপগত বৈশিষ্ট্য বা আঙ্গিক লক্ষণরূপে নির্দেশ করা হয়। প্রতি মঙ্গল কাব্যের সাধারণত দুটি ভাগ থাকে- 

  • একটিতে দেবখণ্ড—এখানে গ্রন্থের উদ্দিষ্ট দেবতাকে সাধারণতঃ মহাদেবের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়। 

  • অপরটি নরখণ্ড—এখানে মর্ত্যলােকে দেবতা স্বীয় মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য যে মানব-মানবীকে অনুগ্রহ বা নিগ্রহ করে থাকেন তারই কাহিনী বর্ণিত হয়। 

মঙ্গলকাব্যের প্রথমেই বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রশক্তি বন্দনা ও গ্রাম-দেবতাদের বন্দনা। এরপর থাকে ‘গ্রন্থাৎপত্তি’র কারণ। সাধারণতঃ কারণ হিসেবে দৈবাদেশ বা স্বপ্নাদেশের কথাই বর্ণিত হয়। কোথাও কোথাও কবির পৃষ্ঠপােষক ভূস্বামীর নামও উল্লেখ করা হয়। এরপরই দেবখণ্ড। এতে সৃষ্টিপত্তন, দক্ষযজ্ঞ, সতীর দেহত্যাগ ও উমারূপে নবজন্ম লাভ এবং হরগৌরীর সংসার প্রভৃতি বর্ণিত হয়ে থাকে। এখানেই কোন দেবতা বা গন্ধর্বকে শাপ দিয়ে মর্তলােকে পাঠানাে হয়-উদ্দেশ্য, এর সাহায্যে উদ্দিষ্ট দেবতার মাহাত্ম্য-প্রচার। দেবখণ্ড ও নরখণ্ডের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটি এর দ্বারাই সম্পর্কিত হয়ে থাকে। এর পর নরখণ্ড শাপভ্রষ্ট নররূপী দেবতার কার্যকলাপ-অস্তে আবার স্বর্গারােহণ—তার জীবনযাত্রার কাহিনীই এখানে বর্ণিত হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে সমসাময়িক জীবনযাত্রা ও সমাজব্যবস্থার অতি বাস্তব রূপায়ণ অধিকাংশ গ্রন্থে পাওয়া যায়। এতে বিশ্বকর্মা কর্তৃক কাঁচুলি, দেউল ও নগর-নির্মাণ, বারমাস্যা নারীদের পতিনিন্দা, বাঙলার রন্ধনপ্রণালী ও ভােজ্যতালিকা, বাঙলা ফল-ফুল-গাছ, পশু-পাখির নাম উল্লেখ, চৌতিশা স্তব, লােক-ঠকানাে ধাঁধা ও তার উত্তর প্রভৃতি প্রায় সব মঙ্গলকাব্যেই আঙ্গিক লক্ষণরূপে গৃহীত হয়ে থাকে।

সমগ্র মঙ্গল সাহিত্য জুড়ে নানান বৈচিত্রের সুসংহত রূপ পরিদৃষ্ট হয়। ভিন্ন ধর্মের মঙ্গলকাব্য থাকলেও মূলে কিন্তু তাদের স্বভাব ও লক্ষণ এক। যে স্বভাবগুলি পরস্পরের মধ্যে মিল বা সাদৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছে, সেগুলিকে এমনভাবে সূত্রাকারে সাজানো যেতে পারে—

১। মঙ্গলকাব্যের সূচনায় কবি গণেশাদি অন্যান্য দেবদেবীর বন্দনা করে কাব্য শুরু করেন, এই বন্দনা অংশে হিন্দু দেব দেবীর পাশাপাশি অনেক কবি অন্যান্য দেবতা এমন কি ইসলামী দেবতাকেও বন্দনা করতে কুণ্ঠিত হননি। বিবিধের মাঝে মিলনে’র আকাঙ্ক্ষা যেন এই অংশে আভাসিত হয়েছে। চৈতন্য পরবর্তী মঙ্গলকাব্যগুলিতে চৈতন্য-বন্দনা স্থান পেয়েছিল এক অপরিহার্য অঙ্গরূপে।

২। প্রত্যেক মঙ্গল কাব্যে গ্রন্থোৎপত্তির কারণ বর্ণনায় স্বপ্নাদেশ বা দৈবাদেশের উল্লেখ আছে। এই অংশ কবির ব্যক্তি জীবনের ঘনিষ্ট পরিচয় এমনকি সমকালীন ইতিহাসের আঞ্চলিক পরিচয় বিবৃত হয়েছে, যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে মুকুন্দ রামের কাব্যের অংশবিশেষ।

৩। প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যের কাহিনি দেব খণ্ড ও নরখণ্ড নামে দুটি পৃথক অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে দেবতার জন্ম পরিচয় এবং মাহাত্ম্য বর্ণনা বিশেষ করে হরগৌরী মনসার কাহিনী বিবৃত হয়েছে। দ্বিতীয়াংশে কোন শাপভ্রষ্ট দেব দেবী মর্তে মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করে দেবতা ও দেবীর পূজা প্রচারে উদ্যোগী হয়েছে। যেমন—চণ্ডীমঙ্গলে নীলাম্বর-ছায়া, মনসা মঙ্গলে অনিরুদ্ধ-ছায়া ইত্যাদি। দ্বিতীয়াংশ মূলতঃ দেবতার পূজা প্রচারের নিমিত্ত রচিত।

৪। মঙ্গলকাব্যের নায়কনায়িকাদের অনেকে বণিক বা অস্ত্যজ শ্রেণিভুক্ত, যেমন ধনপতি, চাঁদ সদাগর, শ্রীমন্ত সদাগর, ব্যাধ কালকেতু, ফুল্লরা ইত্যাদি। অনেক কাব্যে তাই সমুদ্রযাত্রার বিবরণ আছে। এই সমুদ্র পথেই বণিক শ্রেণীর মানুষেরা জলযানে বিদেশে পাড়ি দিত ব্যবসা সূত্রে।

৫। সংসার জীবনের বর্ণনা সূত্রে বন্ধন তালিকা, নারীগণের পতিনিন্দা, নায়িকার বারমাস্যা, চৌতিশা স্তর, ইত্যাদি প্রসঙ্গ বিবৃত হয়েছে।

৬। জরতী বা বৃদ্ধার বেশে ভক্তকে ছলনা বা শত্রুপক্ষকে ভয়দেখানো প্রচেষ্টা মঙ্গল কাব্যের দেবদেবীদের মধ্যে দেখা যায়।

৭। প্রবাদ, প্রহেলিকা, প্রবচন ইত্যাদির উল্লেখে সমকালীন সমাজ জীবনের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। গোষ্ঠী বা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় কবিদের সামাজিক অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়। সাধভক্ষণ, অন্নপ্রাশন, দশবিধ ক্রিয়া কর্মের নিপুণ বর্ণনাও দেখা যায়।

৮। করুণ রস ও কৌতুক রসের আশ্রয়েই প্রধানত মঙ্গলকাব্যগুলি লেখা হোত। এর ফলে দুঃখের দারুণ দহন এবং কৌতুকের স্নিগ্ধ নির্ঝরে কাব্যগুলির কাহিনী সুশোভিত হয়ে উঠেছিল।

৯। মঙ্গলকাব্য গুলিকে আশ্রয় করে পয়ার ছন্দের বিচিত্র রূপ যেমন দেখা দিয়েছিল। তেমনিই ভারতচন্দ্রের মতো কবির রচনায় বহু সংস্কৃত ছন্দের বাংলায় প্রকাশ ঘটেছিল।

১০। মঙ্গল কাব্যগুলি প্রধানতঃ দেবমাহাত্ম্য বর্ণনার উদ্দেশে রচিত, সেইজন্য এখানে মাঝে মাঝে অলৌকিক বা অপ্রাকৃত ঘটনা-সমাবেশ লক্ষ করা যায়।

মঙ্গলকাব্যের বিবর্তন

মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব ঘটেছিল সম্ভবতঃ তুর্কী আক্রমণ কালের ক্রান্তিলগ্নে, অন্ততঃ পরবর্তীকালের কবিদের সাক্ষ্য থেকেই এই অনুমানটিকে যথার্থ বলে বিবেচনা করাই সঙ্গত। পঞ্চদশ শতকের কবি বিজয় গুপ্ত উল্লেখ করেছেন-

প্রথমে রচিল গীত কানা হরিদত্ত।

যােড়শ শতকের কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী বলেছেন-

‘মাণিক দত্তেরে বন্দো করিয়া বিনয়।

যাহা হৈতে হৈল গীত পথ-পরিচয়।

অষ্টাদশ শতকের কবি ঘনরাম চক্রবর্তী বলেন—’আকন্দপুরাণ মতে ময়ূরভট্টের পথে’ তিনি গীত রচনা করেন। এই কানা হরিদত্ত মাণিক দত্ত কিংবা ময়ূরভট্টের কোন প্রামাণিক পুথি পাওয়া যায় না। এই তিনজনকে তিন মঙ্গলকাব্যের পূর্বসূরীরূপে পরবর্তীকালের তিন শ্রেষ্ঠ কাব্যকার নির্দেশ করে গেছেন। অনুমান করা হয় ওঁরা ওই ক্রান্তিকালে বর্তমান থেকে যে কাব্য রচনা করেছিলেন, হয়তাে বা রাষ্ট্রনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে এরা কালের হাত এড়িয়ে একাল পর্যন্ত এসে পৌঁছুতে পারেননি। অনেকে অনুমান করেন, এঁরা সম্ভবতঃ পাঁচালী-আকারে কাহিনীর কাঠামােটুকুই গড়ে তুলেছিলেন, পরবর্তীকালের শক্তিমান কবিরা ওই দেহে রক্ত-মাংসাদি যােজনা করে ওদের প্রচলিত মঙ্গল কাব্যের রূপ দান করেছেন।

প্রকৃত মঙ্গলকাব্যকে আমরা প্রথম পাচ্ছি আদি-মধ্যযুগে, তখন একমাত্র মনসামঙ্গল কাব্যধারারই সৃষ্টি হয়েছিল বলে এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। মনসামঙ্গল কাব্যের দেবী মনসা সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের জন চাদসদাগরকে আশ্রয় করতে চান—কিন্তু শিব-ভক্ত চাদসদাগর কিছুতেই মনসার পূজা করতে স্বীকৃত হচ্ছেন না। তিনি বলেন:-

যেই হাতে পূজি আমি দেব শূলপাণি। 

সেই হাতে না পূজিব চ্যাংমুড়ি কানি।।

মঙ্গলকাব্যে মনসামঙ্গলের বৈশিষ্ট্য

ফলে সমগ্র মনসামঙ্গল কাব্য জুড়ে মনসা ও চাদসদাগরের দ্বন্দ্ব চলছে। দেবতা-মানুষের এই অসম যুদ্ধেও চাদসদাগর কিন্তু প্রবল প্রতাপে মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়েছিলেন। মনসার নিগ্রহ ও নিষ্ঠুরতাও চাঁদসদাগরকে টলাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চাঁদসদাগর মনসার পূজা করলেন, কিন্তু ভয়ে ভক্তিতে নয়—পুত্রবধু বেহুলার প্রতি স্নেহের আতিশয্যই চাদকে মাথা নােয়াতে বাধ্য করেছিল। এখানে দেখা যাচ্ছে, সমাজে তখন বণিকসম্প্রদায়েরই প্রাধান্য। তাই বণিক সমাজে পূজা প্রচারের জন্যই দেবী মনসার আগ্রহাতিশয্য; সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য মনসাকে প্রচুর ছলনা, বঞ্চনা ও নিষ্ঠুরতার সাহায্য নিতে হয়েছিল। শুধু মনসামঙ্গল কাহিনীতেই নয়, সমস্ত মঙ্গলকাব্যগুলিতেই মানুষের উপর নবাগত দেব-দেবীর আধিপত্য বিস্তারের কাহিনী বর্ণিত।

চৈতন্যোত্তর যুগে মঙ্গলকাব্যে সমাজে সহনশীলতা

পরবর্তী মনসামঙ্গলকাব্যগুলি সবই রচিত হয়েছিল চৈতন্যোত্তর যুগে। ফলে চৈতন্য-পূর্ব মনসামঙ্গল কাব্যের সঙ্গে এদের গুণগত পার্থক্যও যথেষ্ট দেখা দিয়েছিল। চৈতন্যের আবির্ভাবে যে সমাজ-পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল সাহিত্যেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। সমাজব্যবস্থার পূর্বতন গোঁড়ামি ছিল অনুপস্থিত, বর্ণাশ্রম প্রথাও অনেকটা শিথিল হয়ে পড়ে, আর এই অবসরে ব্রাহ্মণেতর শ্রেণীও মঙ্গলকাব্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। তাই চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে অনার্য ব্যাধসন্তান কালকেতু কাব্যের নায়কত্ব লাভ করে। অনার্য দেব-দেবীরাও সমাজে অনেকটা স্থান করেছিলেন বলেই চণ্ডীকে মনসার মত নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করতে হয়নি। বস্তুতঃ দেবী চণ্ডীর মধ্যে মমত্তবােধই বেশী ফুটে উঠেছে। আর্য-অনার্য সমীকরণ-প্রক্রিয়াটি যে এইযুগে অনেকটা ত্বরান্বিত হয়েছিল তা সহজেই উপলব্ধি করা চলে। তার ফলে সমাজে যে একটি সহনশীলতার সৃষ্টি হয়েছিল, তাও বােঝা যায় যখন দেখি সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য চণ্ডীকে আর মনসার মতাে নিষ্ঠুর হতে হয়নি।

মঙ্গলকাব্যে শিব-প্রাধান্য

সকল মঙ্গলকাব্যেই শিবের একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে প্রসঙ্গক্রমেই মাত্র, শিবায়ন বা শিবমঙ্গল কাব্যে কিন্তু শিবই প্রধান দেবতা। এর একভাগে অপরাপর মঙ্গলকাব্যের মতই পৌরাণিক শিবের কাহিনী, অপর অংশে আছে লৌকিক শিবের কাহিনী, শিব কোচপট্টিতে ঘুরে বেড়ান এবং কৃষিকার্যে ব্যক্ত থাকেন। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়ােজন, শিবও আসলে বর্ণেতর কৃষিজীবী মানুষেরই অধিদেবতা। তবে পৌরাণিক যুগেই এই মৃত্তিকালগ্ন দেবতাটি আর্যসমাজে উন্নীত হয়েছিলেন। বিবর্তনের মধ্য দিয়ে শিবায়ণকাব্যে কাব্যের অধিদেবতা শিব নিজেই নায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। মর্ত্যলােকে মাহাত্ম্য প্রচার করবার জন্য তিনি কোন মানব সন্তানকে আশ্রয় করেন নি, তিনি স্বয়ংই যেন মানব-রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন।

মঙ্গলকাব্যে দেব কাহিনীতে মানবিকতা

প্রথমে দেবতাদের কথা নিয়েই আরম্ভ করা যায়। বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যের আদিতে যে হরগৌরীর কাহিনী রয়েছে সেখানে এবং শিবায়ন কাব্যে শিবের কাহিনীতে কোন দেবত্ব নেই, দোষ-গুণে সেখানে শিব-পার্বতীর মানব-মহিমাতেই সমুন্নীত। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দেবী চণ্ডী মােটেই চণ্ডমূর্তিধারিণী নন, তিনিও একান্তই মানবিক গুণসম্পন্না। সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের বিচারেও মঙ্গলকাব্যগুলি তৎকালীন যুগ ও জীবনেরই ঐতিহাসিক দলিল। মঙ্গলদেবীগণও বস্তুত সে যুগের প্রশাসনিক চণ্ডনীতিরই প্রতিচ্ছায়া। অর্থাৎ মঙ্গলকাব্য আসলে তৎকালীন মানবজীবনেরই বিশ্বস্ত দৰ্পণ।

মঙ্গলকাব্যে মানব চরিত্রের মহত্ত্ব

মানবচরিত্রগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় মনসামঙ্গল কাব্যের চাদ-সদাগরের কথা। সমগ্র মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে এ জাতীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, আত্মমর্যাদার প্রতিষ্ঠা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ব্যক্তির কোন দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নেই। তিনি স্বীয় মতের বিরুদ্ধেও যে মনসার পূজা করেছিলেন, তার পিছনে রয়েছে, একান্ত মানবিক মহিমা—স্নেহের প্রতি বশ্যতা। বেহুলার পতিপ্রেম এবং স্বীয় প্রতিজ্ঞা-পূরণে চরম আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মানব-মহিমার অপূর্ব বিকাশ ঘটেছে। কালকেতুর কাহিনীতেও অত্যাচারিত প্রজাদের প্রতি সহানুভূতির যে অপূর্ব মানবিক প্রকাশ ঘটেছে কালকেতুর চরিত্রে, তা-ও বিশেষভাবেই উল্লেখযােগ্য। এই মঙ্গলকাব্যে দেবতার ভূমিকা খুবই সঙ্কীর্ণ, সমাজের নানাশ্রেণীর মানুষ যেন এখানে মিছিলের মতাে দেখা দিয়েছে। কালকেতু- ফুল্লরার প্রথম জীবনপর্বে ব্যাধের জীবন, তারপর দৈবধন-প্রাপ্তির পর কালকেতুর পরিবর্তন, মুরারিশীল-ভঁড়ুদত্তের চরিত্রে চিরন্তন গ্রাম্যজীবনের চরিত্র, অন্যত্র রাজকীয়তা, ধনপতি-কাহিনীতে মানবজীবনের চিত্র প্রভৃতির মধ্য দিয়েও বস্তুতঃ মানব মহিমাই প্রকাশিত হয়েছে। ধর্মমঙ্গল কাব্যে কিছুটা অলৌকিকতার পরিচয় পাওয়া গেলেও প্রধান কাহিনী মানুষে-মানুষে ক্ষমতার লড়াই নিয়ে। শিবায়নে তাে স্বয়ং মহাদেবই নর-মুর্তিতে একেবারে চাষী-কৈবর্তের সমভূমিতে নেমে এসেছেন। কাজেই মঙ্গলকাব্যগুলির বিভিন্ন মানব চরিত্রেও মানব-মহিমার যথাযােগ্য প্রকাশ লক্ষিত হয়।

মঙ্গলকাব্যে সমাজ জীবনের চিত্র

সদ্যোগত যুগের অনেক বিদগ্ধ বাঙালী মনীষীই দুঃখ করে বলেছেন যে বাঙালীর কোন ইতিহাস নেই। সেকালে সাধারণতঃ রাজা-রাজড়াদের কাহিনীর পরস্পরাই প্রধানতঃ ইতিহাসের মর্যাদা পেতাে। কিন্তু একালে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন সাধারণ মানুষের কথা, সমাজের চিত্রই ইতিহাসের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এই বিচারে, প্রাচীন মধ্যযুগের বাঙালীর ইতিহাস নেই—এমন কথা বলা চলে না। সেকালের সাহিত্য, বিশেষতঃ মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলিকে ইতিহাসের খনি বললেও অত্যুক্তি হয় না।

মধ্যযুগের সাহিত্যিকদের সামনে কোন মহৎ আদর্শ না থাকায় এবং তাদের কল্পনাশক্তিও সুদূর-সঞ্চারী না হবার ফলে তারা সমকালে যে সকল কাব্য রচনা করেছেন, তাতে তাদের প্রত্যক্ষদৃষ্ট এবং অভিজ্ঞতালব্ধ সমাজ-জীবনের চিত্রই মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাই দেখি দেবাদিদেব মহাদেব ঘরজামাই হয়ে শ্বশুরের অন্ন ধ্বংস করেন, আর শাশুড়ী পর্বতরাজ-পত্নী মেনকা, জামাইয়ের জন্য রাধতে বাড়তে গিয়ে বলেন, ‘কাকালে হলাে বাত’। বস্তুতঃ নামে হরগৌরীর জীবনযাত্রা হলেও তা’ নাম ভাড়িয়ে একালের একটি অনুপম-বাস্তবধর্মী ছােটগল্প হতে পারে। কবিকঙ্কণের কাব্যে সমাজ-বাস্তবতা ও চরিত্র-চিত্রণ দেখে একালের অনেক মনীষীই মনে করেন যে মুকুন্দ চক্রবর্তী একালে জন্মালে কবি না হয়ে একজন প্রথম শ্রেণীর ঔপন্যাসিক হতেন। কবিরা চরিত্র-চিত্রণে এ জাতীয় ক্ষমতার পরিচয় দিতে না পারলেও সমাজের চিত্র-অঙ্কনে যথার্থ যােগ্যতার নিদর্শন রেখে গেছেন।

কালকেতু কাহিনীতে প্রথমে ব্যাধ সমাজের চিত্র এবং তারও আগে গ্রন্থেৎপত্তির বিবরণে ডিহিদার মামুদ শরীফের অত্যাচারে প্রজাদের দুরবস্থা, কালকেতুর নগরপত্তনে স্বয়ম্ভর নগরজীবনে, ধনপতি সদাগর-কাহিনীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের চিত্র, সামাজিক রীতিনীতি, কঠোরতা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে এবং চাঁদসদাগর-কাহিনীতেও দৈনন্দিন জীবনের অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্যের অপূর্ব চিত্র বিশ্বাস্যতার সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। সর্বোপরি বলতে হয়, কবি কাব্যে কাঞ্চনকৌলীন্য কীভাবে সমাজে আপনার পথ করে নিল, দৈবধনের অধিকারী ব্যাধসন্তান কালকেতু প্রায় আপােষের পথেই সমাজে রাজসম্মান অর্জন করে নিল; তাকে কৈবর্ত ভীমের মতাে প্রকৃত সমগ্রামের মুখােমুখী হ’তেও হয়নি। সমাজের এমন চিত্র আর কোথায় পাওয়া যাবে।

সর্বোপরি, ড. অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়ের বক্তব্য বিশেষ স্মর্তব্য“যে মানুষ জগৎকে ইন্দ্রিয় দিয়া উপলব্ধি করে, যাহারা জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য আত্মশক্তি ও বুদ্ধিতে অবিশ্বাসী, তাহাদিগকে আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক উৎপাত হইতে আত্মরক্ষার জন্য এক একটি উৎপাতের দেবতা সৃষ্টি করিতে হয়। তাই তো সর্পের ভয়ে বাঙালি মনসা দেবীকে স্মরণ করেন। চন্ডীকে উপাসনার দ্বারা সংসারের সমস্ত বিপদ আপদ থেকে উদ্ধার পান। দক্ষিণ কালু রায়ের পূজা দিয়ে বাঘ কুমীরের হাত থেকে প্রাণ বাঁচান। তাইতো বলতে হয় বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে আত্মশক্তি ফিরে পেতে নির্বিঘ্নে জীবন যাপন প্রয়াসী হতে মঙ্গল কাব্যের সকল দেবীদের স্মরণ করা হয়েছে।