সব মানুষই গৃহকোণে তার নীড় বাঁধে। কিন্তু গৃহকোণের লক্ষ্মণের গণ্ডীর মধ্যেই সে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চায় না। মাটির বুকে দাঁড়িয়েও তার মন উধাও হয় দিগন্তের মুখে, এক দিগন্তকে ছাড়িয়ে নতুন দিগন্তের অভিমুখে। ‘দেখব এবার জগৎটাকে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগাত্তরের ঘূর্ণীপাকে’ এ অভীপ্সা থাকলে কি হবে, সাধ্য তো সবার সমান নয়। তবু মানুষ বের হয়, কাছে-দূরে বেরিয়ে পড়ে। নিজের বাঁধা ধরা সং-এর বাইরে নতুন দৃষ্টি মেলে জগৎটাকে দেখতে চায়, চিনতে চায়। মানব সৃষ্টির যাত্রালগ্নের প্রথম থেকেই ‘চরৈবেতি’ মন্ত্রে দীপ্ত মানুষ যে ছিল যাযাবর। সেই যাযাবর বৃত্তি আজও মানুষকে স্থান থেকে স্থানান্তরে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

কিন্তু এ বিপুল বিশ্বের সব দেখা, সব জায়গায় যাওয়া কোন মানুষের পক্ষে কি সম্ভবপর? রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে কয়েকবার বিশ্ব-পরিক্রমায়, বিশ্ব-পথের যাত্রী হলেও সব না দেখার অতৃপ্তি তার মনে শেষ পর্যন্ত ছিল। তাঁর জীবনে সন্ধ্যালগ্নে কবি-মনের এই অতৃপ্তিই প্রকাশিত হয়েছে। কবি বলেছেন,

বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি। 

দেশে দেশে কত না নগর-রাজধানী

মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু, 

কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু 

রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন; 

মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ। 

সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আছে যাহে

অক্ষয় উৎসাহে

যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী

কুড়াইয়া আনি।

জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে 

পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে৷

শুধু দূরকে নিকটে আনার জন্যই, কবির এই আক্ষেপ প্রকাশিত হয়নি, একান্ত কাছের জগৎকেও পুরোপুরি দেখতে না পারার জন্য তাঁর আক্ষেপ ধ্বনিত হয়েছে। তিনি বলছেন,

দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

একটি ধানের শিসের ওপর একটি শিশির বিন্দু।

দূরে-কাছে, সুদূরে অদূরে সব কিছুকেই–সুউচ্চ গিরিচূড়া, নিঃসঙ্গ মরুপ্রান্তর, গর্জনমুখর সমুদ্র, গভীর অরণ্যানী এবং এই বিচিত্র প্রাণজগৎ সব কিছুরই খবর মানুষ পেতে চায়। যেখানে তার সাধ্যে কুলায় না, সেখানে অপরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় রচিত ভ্রমণ কাহিনি, কবির কথায় ‘ভিক্ষালব্ধ ধনে’ মানুষ তার আপন কৌতূহলের চরিতার্থতা করে থাকে। অপরের চোখেই সে অসীমের ব্যঞ্জনাকে ধরবার চেষ্টা করে। এই অসীম আকাশ বিশেষ ব্যঞ্জনা বহন করছে। তা হচ্ছে কল্পনার, চিত্তার, মননের। মানসিক উদারতা, বিশালতা ও বিস্তৃতি চাইলে সর্বপ্রথমেই প্রয়োজন স্থানিক পরিবর্তন।

ভ্রমণের মধ্যে এই স্থানিক পরিবর্তনের ইঙ্গিতটাই প্রধান কথা। এই যে ভ্রমণ, তা শুধু ভ্রমণের মধ্যেই পরিসমাপ্ত হয় না। ভ্রমণের আনন্দকে, তার বোধ ও উপলব্ধিকে ধরে রাখবার জন্য মানুষের একান্ত আগ্রহ জন্মে। এই ঐকান্তিক আগ্রহেরই ফল ভ্রমণ -কথা। ভ্রমণকে কেন্দ্র করে সাহিত্য গুণ সমৃদ্ধ যে রচনা তাকেই বলা যায় ভ্রমণ সাহিত্য। অর্থাৎ ভ্রমণ-কথা পরিবেশনে বাচ্যের অতিরিক্ত গুণ বা ব্যঞ্জনা ফুটে উঠতে হবে। এই অতিরিক্ত গুণকেই বলা যায় ধ্বনি বা আনন্দগুণ। লেখকের লেখার মধ্যে এই গুণই ভ্রমণ-কথাকে ভ্রমণ সাহিত্যে উত্তোরিত করে। ভ্রমণ সংক্রান্ত দিনপঞ্জী বা তথ্য তালিকাকে ভ্রমণ-সঙ্গী বা পরিচিতি বলা গেলেও তাকে ভ্রমণ-সাহিত্য বলা যায় না। আজকাল বাংলা সাহিত্যে ভ্রমণ-উপন্যাস নামে এক ধরনের তরল গ্রন্থের বেশ প্রচলন দেখা যায়। জনৈক সমালোচক এই সকল গ্রন্থকে ব্যঙ্গ করে ‘ভ্রমন্যাস’ (ভ্রমণ + উপন্যাস) অভিধায় অভিহিত করেছেন। এগুলিতে ভ্রমণের রোমাঞ্চ বা উপন্যাসের জীবন-চিত্র কিছুই নাই। অবশ্য কথিত স্থানের একটা প্রাথমিক পরিচয় এই জাতীয় গ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায়। আবার ‘গাইড’ শ্রেণির যে এক জাতীয় ভ্রমণমূলক গ্রন্থাদি দেখা যায়, তাকেও কিন্তু ভ্রমণ-সাহিত্যের পর্যায়ে ফেলা যায় না।

কৌতূহল নিবৃত্তিই ভ্রমণ-সাহিত্য রচয়িতার একমাত্র কাজ নয়। যিনি ভ্রমণ সাহিত্য রচনা করবেন, তাঁকে শিক্ষিত, মার্জিত ও নিরপেক্ষ হতে হবে এবং ভ্রমণ সাহিত্যের মধ্যেও সেই মার্জিত ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় প্রকাশিত হওয়াই কাঙ্ক্ষিত। অনেক সময় ভ্রমণ-সাহিত্যে লেখকের অতিরিক্ত ব্যক্তিক স্পর্শ পড়ে থাকে। ধরা যাক, লেখক কোন স্থানে ভ্রমণে গিয়েছেন এবং ভ্রমণাস্তে সেই স্থানের বিবরণ লিপিবদ্ধ করছেন, দেখা গেল সেই স্থানকে তিনি যেভাবে দেখেছেন তা তার একান্তই নিজস্ব। অন্যে যেভাবে দেখেছেন, তিনি সেভাবে দেখেননি, দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে বিস্তর প্রভেদ। অনেকে আবার লিখতে গিয়ে লিরিক কবির মতো মন্ময় (Subjective) হয়ে পড়েন। মাত্রাতিরিক্ত মন্ময়তা রচনাকে একদেশধর্মী করে তোলে। আবার যদ্দৃষ্টং তল্লিখিতম অর্থাৎ যা দেখেছেন ও যা শুনেছেন, তাই পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রকাশ করেন,–এর যে কোনো একটা দিক নয়, সবদিকের পরিমিত মিশ্রণেই রূপ পায় যথার্থ ভ্রমণ-সাহিত্য। এর সঙ্গে থাকা চাই লেখকের নির্মল ও গভীর রসবোধ, ব্যাপক সহানুভূতি এবং সূক্ষ্ম কৌতূহলী দৃষ্টি।

ভ্রমণের মধ্যে রয়েছে নতুনের প্রতি বিস্মিত আকর্ষণ ও রোমাঞ্চ। নানা দেশ, নানা জাতি, নানা ব্যবহার ও সেই নানা দেশ ও জাতির ধর্ম, সংস্কার, আচার, ঐতিহ্য ও ইতিহাস জানার যে কৌতূহল, সেই কৌতূহল নিয়েই মানুষ ঘর ছেড়ে বের হয়। তারপর যখন তাকে সাহিত্যে রূপ দিতে চায়, তখন সেই কৌতূহল রোমাঞ্চকে পাঠক মনে জাগরুক না রাখলে চলে না।

সুপ্রাচীনকালে কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে মেঘকে বহন করে কালিদাস দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তরের হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত মহাদেশ ভ্রমণের এক কাব্যময় ভৌগোলিক পরিচয় দিয়েছেন। মধ্যযুগে “চৈতন্যচরিতামৃতে’র মধ্যেও শ্রীচৈতন্যদেবের দাক্ষিণাত্য ও উত্তর ভারত ভ্রমণের ইতিবৃত্ত রয়েছে। কিন্তু তবু এই গ্রন্থগুলি ভ্রমণ-সাহিত্য নয়। মূল কাব্য বা চরিতগ্রন্থের অনুষঙ্গ মাত্র। ভ্রমণ-সাহিত্য আধুনিক কালের সংযোজন এবং এই ভ্রমণ-সাহিত্যের ভাষা গদ্য। তাই গদ্যের ইতিহাসের সঙ্গে ভ্রমণ-সাহিত্যের ইতিহাস জড়িত।

বাংলা ভ্রমণ-সাহিত্যের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই স্মরণ করা যায় সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং তার ‘পালামৌ’ এর কথা। ‘পালামৌ’ এক বিচিত্র ভ্রমণকাহিনি। সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সঞ্জীব বালকের ন্যায় সকল জিনিস সজীব কৌতূহলের সঙ্গে দেখতেন এবং প্রবীণ চিত্রকরের ন্যায় তাহার প্রধান অংশগুলি নির্বাচন করিয়া লইয়া তাঁহার চিত্রকে পরিস্ফুট করিয়া তুলিতেন এবং ভাবুকের ন্যায় সকলের মধ্যেই তাঁহার নিজের একটি হৃদয়াংশ যোগ করিয়া দিতেন।’ স্বামী বিবেকানন্দের ‘পরিব্রাজক’ একটি উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ সাহিত্য। গ্রন্থটিতে ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপ, গ্রিস, তুরস্ক, মিশর প্রভৃতি দেশ ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে সেইসব অঞ্চলের ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক পরিচয় সহ সেইসব দেশের জনজীবনের কথা আশ্চর্য সাবলীল ও বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে পরিবেশন করেছেন। সেইসঙ্গে তাঁর নিজের ভাবনাকে যুক্ত করে উনিশ শতকের দেশ-কালকে উপস্থাপিত করেছেন। গ্রন্থটি বাংলা ভ্রমণ-সাহিত্যে এক অনবদ্য সংযোজন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বরচিত জীবন চরিতটিতে অনেকখানি স্থান জুড়ে রয়েছে তাঁর হিমালয় ভ্রমণ কথা। হিমালয়কে কেন্দ্র করে আধ্যাত্মিক উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিচিত্র হিমালয় ভ্রমণ বৃত্তান্ত অতি অন্তরঙ্গ সুরে প্রকাশ করেছেন।

“বাংলা ভাষায় ভ্রমণ-সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের হাতে সার্থকতার রূপ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে দেশেই গেছেন সে দেশের সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির আদান-প্রদানের উদ্দেশ্যটাই বড়ো করে দেখেছেন। আবার এমন অনেক দেশে গেছেন যেখানে তিনি সেই দেশের আচার-ব্যবহার, লোকনীতি প্রভৃতি সংগ্রহ করবার ইচ্ছাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’, ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’ এই দ্বিতীয় শ্রেণির উদাহরণ।

বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে বিশ্ব পথিক রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য ও সংস্কৃতির দূত রূপে বারবার দেশ পরিক্রমায় বেরিয়েছেন এবং কোথাও বা ডায়ারির নামাঙ্কে তাঁর সেই ভ্রমণের ইতিবৃত্ত স্মরণীয় করে রেখেছেন। তাঁর ভ্রমণ-কাহিনির ঝুলিতে ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’ (১ম ও ২য়), ‘জাপান যাত্রী’, ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি’, ‘জাভা যাত্রীর পত্র’, ‘রাশিয়ার চিঠি’, ‘জাপানে পারস্যে’, ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’, ‘পথে ও পথের প্রান্তে মূল্যবান সংগ্রহ। রবীন্দ্রনাথ দেশ-বিদেশের জলে স্থলে কখনও ভেসে চলেছেন, কখনও ছুটে চলেছেন। কিন্তু এই ভাসা ও ছোটা উভয় ক্ষেত্রের কোথাও গন্তব্যস্থলটাই কবির কাছে সবচেয়ে বড়ো জিনিস হয়ে ওঠেনি। গন্তব্যস্থল সম্বন্ধে মোটের ওপর জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে একটা আকর্ষণ থাকলেও আশে-পাশে তাকাতে তাকাতে পথ-চলার সবটাকেই তিনি যতদূর সম্ভব উপভোগ করতে করতে চলেছেন। ভ্রমণ-কাহিনি লিখতে বসে তিনি হয়তো অনেক স্থলে ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন খুব কম, তার ভেতরে সাহিত্য সম্বন্ধে, সাধারণ শিল্প সম্বন্ধে, সমাজ-ধর্ম-শিক্ষা-রাজনীতি সম্বন্ধে নানা কথা, মতামতই প্রকাশ করেছেন বেশি–কিন্তু সব জিনিসটাই চলতি প্রসঙ্গে ভেসে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের কথায় ভেসে চলার মধ্য দিয়ে দেখার আর একটা গুণ হচ্ছে এই যে, তা মনোযোগকে জাগ্রত করে, কিন্তু মনোযোগকে রক্ষা করে না।’—দেখার ও ভাবনার এই চলিষ্ণুতাই ভ্রমণ-কাহিনির বৈশিষ্ট্য। তথ্য এখানে এসেছে, কিন্তু কবির ‘হৃদয়ের জারক রসে’ পরিপক্ক হয়ে যখন তা তাঁর ব্যক্তিপুরুষেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, তখনই তিনি তা প্রকাশ করেছেন। তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘প্রত্যক্ষটা একবার আমার মনের নেপথ্যে অপ্রত্যক্ষ হয়ে গিয়ে তারপরে যখন প্রকাশের মঞ্চে এসে দাঁড়ায় তখনই তার সঙ্গে আমার ব্যবহার’।—এই কারণেই বা এই গুণেই তাঁর সমস্ত ভ্রমণ-কাহিনি ও তার ভেতরকার সমস্ত আলোচনা কখনও ভ্রমণের নোট বা রিপোর্ট না হয়ে ভ্রমণ-সাহিত্য হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘তত্ত্বালোচনায় যে ব্যক্তি আলোচনা করে, সে প্রধান নয়, তত্ত্বটাই প্রধান। সাহিত্যে এই ব্যক্তিটাই প্রধান, তত্ত্বটা উপলক্ষ্য। এই যে সাদা মেঘের ছিটে-দেওয়া নীল আকাশের নীচে শ্যামল-ঐশ্বর্যময়ী আঙ্গিনার সামনে দিয়ে সন্ন্যাসী জলের স্রোেত উদাসী হয়ে চলেছে, তার মাঝখানে প্রধানত প্রকাশ পাচ্ছে দ্রষ্টা আমি। যদি ভূতত্ত্ব ভূবৃত্তান্ত প্রকাশ করতে হত, তাহলে এই আঙ্গিকে সরে দাঁড়াতে হত। কিন্তু এক-আখির পক্ষে আর এক-আখির অহেতুক প্রয়োজন আছে, সেইজন্য সময় পেলেই আমরা ভূতত্ত্বকে সরিয়ে রেখে সেই আখির সন্ধান করি।” রবীন্দ্রনাথের কোন লেখাই তাঁর এই আখিকে আড়াল বা আবৃত করে রাখতে পারেনি। আর তাই সমস্ত বিবরণ ও আলোচনা ভিতরে তিনি কি বলছেন সেদিকেই আমাদের মনের সমস্ত ঝোঁক পড়ে না, কে বলছেন এবং কিভাবে বলছেন সেদিকেও আমাদের অন্তহীন কৌতূহল জাগ্রত। সাহিত্যে এবং অ-সাহিত্যে এখানেই মৌলিক তফাৎ। আর এই গুণেই তাঁর ভ্রমণ-কথা ভ্রমণ-সাহিত্য।

বাংলা ভ্রমণ-সাহিত্যের একটা বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে হিমালয়। হিমালয়ের সন্ধানে বাঙালি চিত্ত বারবার ছুটে বাহির হয়েছে সেই রকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে সুদূর কাল থেকেই। সাহিত্যের আখরে সেই ভ্রমণ-কথার রূপদানের ক্ষেত্রে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম সর্বাগ্রে স্মরণ করার পর আমরা জলধর সেনের ‘হিমালয়’ ভ্রমণের উল্লেখ করতে পারি। আজকের আধুনিককালের গতির যুগে যে কেদার-বদ্রী সহজগম্য হয়ে উঠেছে। প্রাচীনকালের বিভিন্ন স্থান ও বিরামস্থল চটি গাড়ির চাকার তলায় হারিয়ে গেছে, সেই পুরানো পথে ঘাট ও সেকালের মানুষের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় সাধিত হয় জলধর সেনের মাধ্যমে। আমরা তীর্থ, তীর্থপতি ও তীর্থবাসীদের সঙ্গে একই সঙ্গে পরিচিত হই। জলধর সেন দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ প্রভৃতি নিয়েও গ্রন্থ রচনা করেছেন। হিমালয়ের অন্তরের রূপ উদ্ঘাটনে প্রবোধকুমার সান্যাল এক স্মরণীয় নাম। তাঁর ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, ‘দেবাতাত্মা হিমালয়’ গ্রন্থে হিমালয় ভ্রমণের বিবরণ সন্নিবদ্ধ। এইসব কাহিনিতে লেখকের সৌন্দর্যানুরাগী নিরাসক্ত, কৌতূহলী মনকে খুঁজে পাওয়া যায়। হিমালয়ের এমন নিখুঁত বিবরণ খুব একটা সুলভ নয়। হিমালয় সম্পর্কে যে একটা মহান আধ্যাত্মিক অনুভূতি বহু যুগ পূর্ব হতে বাঙালি তথা ভারতবাসীর মনে দানা বেঁধে উঠেছে প্রবোধকুমার সান্যাল ঐ আধ্যাত্মিক অনুভূতিকেই পাঠক চিত্তে রূপময় করে তুলতে পেরেছেন। এ ছাড়া হিমালয়ের যে একটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভীষণ গাম্ভীর্য রয়েছে তাও লেখক পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরেছেন। এই প্রসঙ্গে উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কৈলাস ও মানস সরোবর’ গ্রন্থটির উল্লেখ করা যায়। গ্রন্থটি বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন। অবশ্য এই গ্রন্থটি ছাড়া হিমালয় প্রেমিক, হিমালয় পূজারী উমাপ্রসাদের হিমালয়ের নানা অঞ্চলে বিবিধ ভ্রমণের কাহিনি নিয়ে আরও নানা বই আছে। অবশ্য প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর আঁকা ছবিসহ ‘হিমালয় পারে কৈলাস ও মানস সরোবর’ বইতে অনেক অক্ষম পাঠকের কাছে ঐ দুর্গম ভ্রমণের আনন্দ পৌঁছে দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন হিমালয়ের গহন অন্দরের প্রকৃতি ও মানুষজনের সঙ্গে। সৈয়দ মুজতবা আলির ‘দেশে-বিদেশে’ গ্রন্থটিও এই প্রসঙ্গে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

হিমালয় ভ্রমণমূলক রচনার মধ্যে অনেকখানি হচ্ছে অভিযানের কাহিনি। অভিযানের আগ্রহ বাঙালির রক্তে বর্তমানে উদ্দীপিত। সেই ভাগ্যগুণে অভিযাত্রীদের মধ্যে কেহ কেহ সাহিত্যসিদ্ধ লেখনীর অধিকারী। তাই অভিযানমূলক ভ্রমণ-সাহিত্যের একটা উপশাখা গড়ে উঠছে। এই অভিযানমূলক সাহিত্যে নিসর্গ চিত্রণ, স্থান ও কালবাচক বর্ণনা, মানুষ, আচার, রীতি ও প্রকৃতির কথা থাকলেও প্রকৃতিকে জয় করবার স্পর্ধাই তার প্রেরণা। এও এক ধরনের আত্মানুসন্ধান, তবু এখানে উদ্দেশ্য ধর্ম প্রবল। এই অভিযানমূলক সাহিত্যের মধ্যে উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘গঙ্গাবতরণ’, গৌরকিশোর ঘোষের ‘নন্দকান্ত নন্দাঘুন্টি, বীরেন্দ্রনাথ সরকারের ‘রহস্যময় রূপকুণ্ড’ প্রভৃতি স্মরণীয় সংযোজন। ভূ-পর্যটক বিমল দে তাঁর ‘মহাতীর্থের শেষ যাত্রী’ গ্রন্থে লাসা-কৈলাসনাথ-মানস সরোবরকে নিয়ে নিষিদ্ধ দেশ তিব্বতের পরিচয় তুলে ধরেছেন।

হিমালয় ভ্রমণের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে দেশে দেশে ঘর খোঁজার আনন্দ নিয়ে ভূ-পর্যটনের ক্ষেত্রে ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের আমেরিকা, ইংলণ্ড, আফ্রিকা, পশ্চিম ইউরোপ, লাল চীন, ভ্রমণ কথা নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ বিশ শতকের দ্বিতীয় পদে প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থগুলি দুষ্প্রাপ্য। রামনাথ বিশ্বাসের এই গ্রন্থসমূহে বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের পরিচয় বড়ো হয়ে ওঠেনি। বড়ো হয়েছে সেইসব দেশের মানুষের সুখ দুঃখের কথা, মানবিকতার কথা। ভূ-পর্যটক বিমল মুখার্জী তাঁর ‘দু চাকায় দুনিয়া’ ভ্রমণ গ্রন্থে সামান্য সম্বল করে সাইকেলে দশ বছরে ভূ-পর্যটনের বিপুল ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। ভূ-পর্যটক বিমল দেও সাইকেলে বিশ্ব পরিক্রমায় বের হন। বিমল মুখার্জীর মতোই অতি সামান্য সম্বল করে। সাইকেলে তাঁর সেই বিশ্ব-পরিক্রমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তিনি পরিবেশিত করেছেন তাঁর ‘সুদূরের পিয়াসী’ নামক অনবদ্য ভ্রমণ-কাহিনিতে।

এ ছাড়াও, ভ্রমণ সাহিত্যের সার্থক সংযোজন যাঁদের হাতে স্বচ্ছ হয়েছে, তাঁরা হচ্ছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ দাশ, মনোজ বসু, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায় প্রমুখ বরেণ্য সাহিত্যিকবৃন্দ।