ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে ভ্রমণ সাহিত্যে রূপান্তরিত করার জন্য নিম্নলিখিত কলা-কৌশল এবং ভ্রমণের লক্ষণ হিসাবে ধরা হয়।
-
(i) লেখকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি, উপলব্ধি, আবেগ মনন হবে রচনার ভিত্তিমূল।
-
(ii) মানব জীবন লোকাচার, লোক সংস্কৃতি ইত্যাদির সামগ্রিক বিশ্বাসযোগ্য চিত্র ভ্রমণ বৃত্তান্তের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকবে।
-
(iii) বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশে থাকবে গল্প কাহিনির রমণীয়তার আস্বাদ ফুটে উঠবে জীবন বোধ, গভীর ও চিরন্তন রহস্যময়তা।
-
(iv) শিল্পিত, সৃজনশীল, কাব্যময় ভাষা ভ্রমণ সাহিত্যের এক অপরিহার্য শর্ত।
-
(v) সাধারণত উত্তম পুরুষে বিবরণ দাতার বয়ানে লেখা হলেও কোথাও ডায়েরি দিনলিপি, কোথাও রোমান্স বা রম্যরচনার আর্থিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে ভ্রমণ সাহিত্যে।
-
(vi) পরস্পর বিরুদ্ধ না ঘটনা এ সাহিত্যে প্রথিত হয় লেখকের সূত্রে।
-
(vii) ভ্রমণ সাহিত্যে লেখক অবস্থান করেন নিরাসক্ত দার্শনিকের ভূমিকায়। তবে তাঁর ভালো লাগা মন্দ লাগার কথা ব্যক্ত হবার কোনো বিধি-নিষেধ নেই।
বাংলা সাহিত্যে ভ্রমণ কাহিনি রচয়িতা হিসাবে অন্নদাশংকর রায়ের কথা স্মরণ করা যায়। তাঁর লেখা ‘পথে প্রবাসে’ গ্রন্থটি বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যের একটি অনন্য নজির। গ্রন্থটিতে ১৯২৬-১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের সমসাময়িক ইউরোপের কথা ভ্রমণের অনুষঙ্গে বিধৃত হয়েছে।
‘পূর্ব কথা’ সহ মোট ২২টি পর্বের (সাধারণ ভাবে ২১টি) বিভক্ত অন্নদাশংকরের ‘পথে প্রবাসে’ গ্রন্থটি। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর ইউরোপই তাঁর বর্ণনার বিষয় পর্যবেক্ষণের বিষয়। ভারতবর্ষীয় প্রসঙ্গও তুলনামূলক প্রক্রিয়ায় ফুটে উঠেছে। বর্ণনীয় বিষয়কে ক্ষণে ক্ষণেই লেখক দার্শনিক সম্বন্ধে সাহিত্যিক ব্যঞ্জনার সমৃদ্ধ করেছেন। উদাহরণ হিসাবে জাহাজে উঠবার মুহূর্তটিকে স্মরণ করা যায়।
“ভারতবর্ষের মাটির উপর থেকে শেষবারের মতো পা তুলে নিলুম আর সদ্যোজাত শিশুর মতো মায়ের সঙ্গে আমার যোগসূত্র এক মুহূর্তে ছিন্ন হয়ে গেল।”
ইউরোপ পৌঁছতে অন্নদাশংকরকে জাহাজে যেতে হয়েছে, আরবসাগর, লোহিত এবং সুয়েজ ক্যানেল হয়ে পৌট সৈয়দ, তারপর ফ্রান্সের দ্বিতীয় শহর মার্সেলসে। মার্সেলস থেকে রেলপথে প্যারিস হয়ে ক্যালে হয়ে ডোভার, ডোভার থেকে লন্ডন। ভ্রমণ পথের দীর্ঘমেয়াদী অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চকর বর্ণনার অনুষঙ্গে সঞ্জীবিত। লন্ডনের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের পর্ব লিপিবদ্ধ হয়েছে রসময়তার সঙ্গেই— “লন্ডনের সঙ্গে আমার শুভদৃষ্টি হল গোধূলিলগ্ন হতে না হতেই সে চক্ষু নত করে আঁধারের ঘোমটা টেনে দিলে। প্রথম পরিচয়ের বিস্ময় ব্যাহত হয়ে যখন অধীর হয়ে উঠল তখন মনকে বোঝালাম, এখন এতো আমারই। আবরণ-এর দিনে খুলবো।”
নিসর্গ বর্ণনাও নিতান্ত সাদা-সিধে ভাবে নয়—দৈনন্দিন জীবনচর্যার সংমিশ্রণে এ গ্রন্থে প্রস্ফুটিত— “গাছেরা নতুন দিনের নতুন ফ্যাশান অনুযায়ী সাজ বদলে ফেলেছে, তাদের এই কাঁচা সবুজ রঙের ফ্রকটিকে তারা নানা হলে দেখাচ্ছে, ঘুরে ফিরে দেখাচ্ছে, অর্ধেক খুলে দিচ্ছে।”
ভ্রমণকথা যে উচ্চাঙ্গের সাহিত্য বস্তু হয়ে উঠতে হয় এ বর্ণনা তার প্রমাণ দেয়। বস্তুত ‘পথে ও প্রবাসে’ গ্রন্থটি ভ্রমণ সাহিত্যের এক আদর্শ নিদর্শন। এর ভূমিকা অংশে অন্নদাশংকর জানিয়েছেন— “এ ভ্রমণ বৃত্তান্ত যে একখানি যথার্থ সাহিত্য গ্রন্থ এ বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই এবং আমার বিশ্বাস সাহিত্য রসের রসিক মাত্রেই আমার সঙ্গে এ বিষয়ে একমত।”
আর ভ্রমণে গিয়ে নিজের মনের অবরুদ্ধ আনন্দকে লেখক এভাবেই ব্যক্ত করেছেন— “যে আনন্দ আমি পাচ্ছি সে আনন্দ আর দশজন পাচ্ছে না। যাতে পায় সেই জন্যেই আমি কলম তুলি ধরি। আর সে কলম আপনি আপনাকে চালিয়ে নিয়ে যায় ভ্রমণ কাহিনি আর এমনি করে আমি সৃষ্টির সুখ পাই।”
ভ্রমণ কাহিনি নিয়ে অন্নদাশংকর রায় তেমন করে ভাবেননি। কীভাবে তা রচনা করতে হয় এবং কেমন তার রচনা কৌশল হওয়া আবশ্যক, তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি— “যেমনটি দেখেছি, তেমনটি দেখাতে কৌশল নয়। সকলে সব জিনিস দেখেনা। সকলের চোখে সব জিনিস ধরা পড়ে না। বিশেষ একজনের চোখে বিশেষ বিশেষ একটা দৃশ্য ঘোমটা খুলে মুখ দেখায়। সেইজন্য একই জিনিস একশোজন দেখে থাকলেও একের দেখা অপরের দেখা নয়। এই দর্শন ছাড়া আর কোনো কৌশল আমি তো জানিনে।”
সর্বোপরি এইসব উদ্ধৃতি ভ্রমণ সাহিত্যের রচয়িতা হিসাবে অন্নদাশংকরকে স্বর্ণ শিখরে বসিয়ে রেখেছে।
Leave a comment