ভূমি বন্দোবস্ত: সামন্ত প্রথা-সম্পর্কিত বিতর্ক :

‘অগ্রহার’ ভূমিদানব্যবস্থার ব্যাপকতার সাথে ভারতবর্ষে আদি-মধ্যযুগের সূচনা তথা সামন্ত ব্যবস্থার উদ্ভবের প্রসঙ্গটি গভীরভাবে সম্পর্কিত। ইউরোপের ইতিহাসে মধ্যযুগের আবির্ভাবের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে ভূমি-সম্পর্কের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এক বিশেষ ধরনের আর্থরাজনৈতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এক বিশেষ ধরনের উৎপাদন, নির্দিষ্টভাবে কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থাকে যুক্ত করে সামন্ত প্রথা ও মধ্যযুগের সূচনার বিষয়টি আলোচিত হয়। ভারতবর্ষে আদি-মধ্যযুগের সূচনাকাল নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ইউরোপীয় মডেলটি বিচার করা হয়। অগ্রহার দানব্যবস্থা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্রাহ্মণ শ্রেণিকে অতিক্রম করে ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হলে ভারতবর্ষেও সামন্ততান্ত্রিক উপাদানের আবির্ভাব ঘটে। বিশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক দার্শনিক কার্ল মার্কস সামন্তব্যবস্থাকে এক বিশেষ ধরনের উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। মার্কসবাদী পণ্ডিতদের মতে, সামন্ত-প্রথার মূল উপকরণ ভূমি। ভূসম্পদের ওপর ভূস্বামীদের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ এই ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। এখানে উৎপাদনের উপাদান ও উপকরণের ওপর ভূস্বামীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। বলা বাহুল্য, উৎপন্ন সামগ্রীর ওপরেও ভূস্বামীর একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত থাকে। এই ভূস্বামীরা নানা স্তরে বিভক্ত। সর্বনিম্ন স্তরে থাকে ভূমিদাসরা (serf)। এই ভূমিদাস শ্রেণি জমির সাথে আবদ্ধ। তবে জমির ওপর এদের কোনো মালিকানাস্বত্ব থাকে না। জমি হস্তান্তরিত বা বিক্রি হলে ওই জমির সাথে যুক্ত ভূমিদাসরাও হস্তান্তরিত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, সামন্তব্যবস্থায় রাজা সামন্তদের ওপর অর্থ ও সৈন্যবলের জন্য একান্তভাবে নির্ভরশীল থাকেন। স্বভাবতই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার শক্তিবৃদ্ধি ঘটলে অনিবার্যভাবেই রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। অর্থাৎ সামন্তব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় শক্তির অবনমন ঘটে এবং আঞ্চলিক শক্তির উত্থান অনিবার্য হয়।

ঐতিহাসিক কোশাম্বী (D. D. koshambi) তাঁর ‘অ্যান ইনট্রোডাকশন টু দি স্টাডি অফ্ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ গ্রন্থে বলেছেন যে, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের গোড়ার দিকে ভারতে একটি কৃষিপ্রধান গ্রামীণ অর্থনীতি বহাল ছিল। এই ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকারি কর্তৃপক্ষ কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করত। এর বাইরে প্রাথমিকভাবে তথাকথিত ভূস্বামী বা অধিস্বামী ছিল না। কিন্তু মাঝে মাঝে এই কর্মীগোষ্ঠী রাজনির্দেশের বাইরে গিয়ে কৃষকদের সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করে প্রচলিত ব্যবস্থার সরল কাঠামোটি বিপর্যস্ত করত। কোশাম্বী এই ব্যবস্থাকে ওপর থেকে সামন্ততন্ত্র’ নাম দিয়েছেন। চতুর্থ ও পঞ্চম শতক (গুপ্তদের আমল) এবং সপ্তম শতকে (হর্ষবর্ধনের আমল) এই কর্তৃত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। সপ্তম শতকের শেষদিকে গ্রামীণ সমাজের অভ্যন্তরেই একটি ভূস্বামী শ্রেণির অভ্যুদয় ঘটে। এই ভূস্বামীরা কৃষকের কাছ থেকে জোর করে উদ্বৃত্ত আদায় করত। এটিকে তিনি নিচু থেকে সামন্ততন্ত্র’ বলে চিহ্নিত করেছেন। ইরফান হাবিবের মতে, মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এইরূপ ‘ওপর থেকে সামন্ততন্ত্র’ ও ‘নিচু থেকে সামন্ততন্ত্র’ শব্দ প্রয়োগ গ্রহণযোগ্য নয়। অধ্যাপক শর্মাও ভারতীয় সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে এই ‘দ্বি-স্তর’ ভূমি-সম্পর্ক ব্যবস্থার অস্তিত্ব মানতে অস্বীকার করেছেন। তিনি যাজ্ঞবন্ধ্যের একটি বিবৃতি (পঞ্চাশ শতক) উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে, ক্ষেত্রস্বামী (ভূস্বামী) কৃষকের ওপরেই দায়িত্বভার ন্যস্ত করে। দ্বিতীয় শতকের গোড়ায় শক-রাজপুত্র উসবদত্তের একটি দানপত্র থেকেও জমির উৎপন্নের ওপর অ-কৃষকের ব্যক্তিগত অধিকারের স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। ইউ. এন. ঘোষাল তাঁর ‘কনট্রিবিউশানস্ টু দি হিস্ট্রি অফ্ দি হিন্দু রেভেনিউ সিস্টেম’ গ্রন্থে চিনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাঙ-এর মন্তব্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন যে, সপ্তম শতকে ভারতে ‘রাজস্ব-প্রদানকারী ব্যক্তিগত ভূমি-কর্ষকের’ অস্তিত্ব ছিল।

কার্ল মার্কস কথিত এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির সাথে ভারতে সামন্ততন্ত্রের উপাদানের বিকাশের সম্পর্ক বিষয়ে ঐতিহাসিকদের দ্বিমত আছে। এশীয় রীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে তিনি জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অভাব, জমির ওপর উপজাতীয় গোষ্ঠীমালিকানা, স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের অস্তিত্ব ও বদ্ধ অর্থনীতির বিকাশ, নগরের অভাব ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন। মার্কসীয় বোধের ভিত্তিতে এই উৎপাদন ব্যবস্থার দুটি উপাদান সক্রিয়—গ্রামীণ গোষ্ঠী এবং প্রাচ্য ঈশ্বরতন্ত্র। ইরফান হাবিবের মতে, প্রথম উপাদানটি বেশি প্রামাণিক। এতে শ্রম-রীতির কাঠামোর সংজ্ঞা আছে। তা হল, একটি নির্দিষ্ট পেশার সাহায্যে ব্যক্তিগত দাসত্ব ছাড়াই একটি স্বাবলম্বী খুচরো উৎপাদন এবং রাষ্ট্রের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত আদায়ের ব্যবস্থা। এই স্বাভাবিক-অর্থনীতি গ্রামের বাইরে পণ্য-সঞ্চালনের মাধ্যমে উদ্বৃত্তের সদ্ব্যবহারের পথ সুগম করেছিল, এমনটা অসম্ভব নয়। অর্থাৎ প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভারতীয় সমাজ হল উবৃত্তের ভোগদখলকারী একটি শাসকশ্রেণি ও গ্রাম্যগোষ্ঠীর বাইরে বিনিময়ের ভিত্তিতে শ্রম বিভাজনবিশিষ্ট একটি শ্রেণি-সমাজ। এই উৎপাদন পদ্ধতি সামাজিক-অচলতা ও রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচার সৃষ্টির সহায়ক। অধ্যাপক কোশাম্বী, শৰ্মা প্রমুখ প্রাচীন ভারতীয় সমাজের এই স্থাণুত্বের অস্তিত্ব মানতে অস্বীকার করেছেন। তাঁদের মতে, এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির ধারণা ভারতীয় সমাজের সাথে খাপ খায় না। প্রাচীন ভারতে জমির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল এবং রাজাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শাসকশ্রেণি জনসাধারণের উৎপাদনের উদ্বৃত্ত আদায় করত। আদি-মধ্যকালীন ভারতে নগরের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। ইরফান হাবিব দেখিয়েছেন যে, স্বয়ং মার্কস কোভালস্কি রচিত (১৮৭৯ খ্রিঃ) গোষ্ঠীগত জমি-অধিকার-সম্পর্কিত প্রতিবেদনে ভারতীয় গ্রাম্যগোষ্ঠীর অভ্যন্তরেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির উত্থানকে চিহ্নিত করেছেন। এর ফলে গোষ্ঠীর অভ্যন্তরেই দ্বন্দ্বের উৎপত্তি হয়েছিল। ড. হাবিব লিখেছেন, অতএব ভারতীয় গোষ্ঠী তার গভীর অন্তর্দেশ অবধি সম্পূর্ণরূপে (একটি) অচলায়তন — এ ধারণা দীর্ঘকাল আঁকড়ে ধরে রাখা আর সম্ভব নয়।

খ্রিস্টীয় ৬৫০ – ১২০০ অব্দে ভারতে সামন্তব্যবস্থার বিকাশ এবং পশ্চিম ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে অনেক ক্ষেত্রেই উভয়ের সাদৃশ্য লক্ষণীয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের (৫৫০ বা ৫৭০ খ্রিঃ) পর তদর্থে ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় শক্তি ছিল না। পরবর্তী প্রায় ৬০০ বছর ভারতের রাজনীতিতে আঞ্চলিক শক্তির অবস্থান ছিল অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই কালপর্বে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে গুর্জর প্রতিহার, পূর্ব ভারতে পাল ও সেন বংশ, দাক্ষিণাত্যে রাষ্ট্রকুটগণ এবং সুদূর দক্ষিণে চোল রাজ্য শক্তিশালী আঞ্চলিক শাসনের প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই সকল রাজ্য ক্ষমতা ও সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামে লিপ্ত থাকলেও, পরিণামে কোনো কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতে সামন্ততন্ত্রের বিকাশ সহজ হয়। বলা যায়, শক্তিশালী কেন্দ্রের অভাব সামন্ততান্ত্রিক উপাদানগুলিকে সমৃদ্ধ করে এবং সামন্ততান্ত্রিক উপাদানগুলির দৃঢ়ভিত্তি আঞ্চলিকতাবাদকে পুষ্ট করে। তবে পশ্চিম ইউরোপের ‘ভূমিদাস’-ব্যবস্থার প্রতিরূপ ভারতে দেখা যায় না। ভারতের সামন্তব্যবস্থার সর্বনিম্নস্তরে ছিল ভূমিহীন কৃষক। তবে তারা কেউই জমির সাথে আবদ্ধ ছিল না, জমি বিক্রয় বা হস্তান্তরের সাথে সাথে কৃষকদের হস্তান্তরিত করা হত না। অবশ্য ইউরোপের ভূমিদাসদের থেকে এদের আর্থিক অবস্থা খুব বেশি উন্নত ছিল না। শোষণ-নিপীড়নের মাত্রাও ছিল যথেষ্ট।

ড. রামশরণ শর্মা, বি. এন. এস. যাদব, ডি. এন. ঝাপ্রমুখ মনে করেন যে, তাম্রশাসন জারি করে নিষ্কর ভূসম্পদ দানব্যবস্থা সপ্তম শতকে ভারতে সামন্তব্যবস্থার বীজ বপন করে। পরবর্তীকালে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ভূমিস্বত্ব ও রাজস্ব হস্তান্তরের ঘটনা বৃদ্ধি পেলে সামন্তব্যবস্থার ভিত সবল হয়। ড. শর্মা সামন্ত প্রথার উদ্ভব ও বিকাশের ঘটনাকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। তাঁর মতে, ৩০০ ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কালে সামন্তব্যবস্থার উন্মেষ ঘটে। ৬০০-৯০০ খ্রিস্টাব্দে সামন্তব্যবস্থা ব্যাপকতা পায়। এবং ৯০০-১২০০ অব্দে একদিকে এর চূড়ান্ত কর্তৃত্ব জারি হয়, আবার অবক্ষয়েরও সূচনা হয়। ড. শর্মা পুরাণ গ্রন্থে ‘কলিযুগ’-সংক্রান্ত বিবরণীটিকে তাঁর মতের সমর্থনে গ্রহণ করেছেন। পুরাণ কথিত চারটি যুগের (সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগ) মধ্যে কলিযুগ’কে অস্থির, অনিশ্চিত, বিশৃঙ্খলা ও দুর্যোগের কাল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। খ্রিস্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে রচিত পুরাণ গ্রন্থে কলিযুগকে যেভাবে আর্থিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের ও অস্থিরতার কাল বলা হয়েছে, তাতে সামন্তব্যবস্থার আগমনবার্তা শোনা যায় বলে শর্মা মনে করেন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, অগ্রহারব্যবস্থা প্রবর্তনের সূত্রে প্রাপ্ত ভূখণ্ড বা গ্রামের ওপর দানগ্রহীতার এক ধরনের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। বস্তুত, তারা ভূস্বামীতে পরিণত হন। প্রাপ্ত ভূখণ্ডের রাজস্ব আদায় ও ভোগের সঙ্গে সঙ্গে লিখিত বা অলিখিতভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রশাসনিক দায়িত্বও দানগ্রহীতা গ্রহণ করেন। ড. শর্মা কলিযুগের বর্ণনার ভিত্তিতে মনে করেন যে, শাসকদের পক্ষে রাজস্ব আদায় তখন সম্ভব হত না বলেই, সম্ভবত ভূস্বামীদের হাতে স্থানীয় প্রশাসনিক দায়িত্ব ভাগ করে দেবার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে এই ব্যবস্থা যে রাজার সার্বভৌম কর্তৃত্বের পরিপন্থী ছিল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। গুপ্ত ও বকাটক রাজাদের আমলে ‘অগ্রহার’ দানব্যবস্থার সৃষ্টি হলেও, ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ভূমিদানের রীতি বহুল বৃদ্ধি পায়। পালদের তাম্রশাসন থেকে জানা যায় বৌদ্ধবিহার, শৈবমন্দির, নালন্দা মহাবিহার প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগতভাবে ব্রাহ্মণ পুরোহিত, বৌদ্ধভিক্ষু প্রমুখ বহু জমি অগ্রহার দান হিসেবে ভোগদখল করতেন। সেনবংশ ও প্রতিহারবংশীয় রাজাদের আমলেও এই রীতি বহাল ছিল। দাক্ষিণাত্যে রাষ্ট্রকুট রাজাদের তাম্রশাসন থেকেও ‘ব্রহ্মদেয়’ দান, ‘দেবদান’ ইত্যাদির কথা জানা যায়। ড. রণবীর চক্রবর্তী লিখেছেন যে, একাদশ-দ্বাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতের বিশাল মন্দিরগুলি এতটাই ভূসম্পদশালী হয়ে ওঠে যে, সেগুলি রাজ্যের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপকেও নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।

অধ্যাপক শর্মা আসরাফপুর তাম্রশাসনের (৬৭৫ খ্রিঃ) ভিত্তিতে দেখিয়েছেন যে, ভূমিদাস-সংক্রান্ত আদেশনামায় মালিকানা ছাড়াও ভোগাধিকারী (ভুজ্যমানক) ও কৃষক (কৃষ্যমানক)-এর উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ মালিকানার বাইরে জমি ভোগাধিকারের ধারণা ছিল, যা মালিকানা থেকে স্বতন্ত্র। আবার মালিক ও ভোগাধিকারীর বাইরে কৃষকের অস্তিত্বও ছিল। রাজস্থান, মালবদেশ প্রভৃতি স্থানে আবিষ্কৃত তাম্রশাসনে দানগ্রহীতাকে বলা হয়েছে যে, তিনি নিজে চাষ করতে পারেন, কিংবা কাউকে দিয়ে চাষ করিয়ে নিতে পারেন (কৃষত কৰ্ষাপয়ত) ; নিজে ভোগ করতে পারেন বা কাউকে দিয়ে ভোগ করাতে পারেন (ভুঞ্জতো ভোজাপয়ত) অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তীর মতে, এই ব্যবস্থা কৃষি-অর্থনীতিতে স্তরীকরণের গতি বৃদ্ধি করে। এইরূপ স্তরবিন্যাস সামন্ততন্ত্রের চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

পাল-প্রতিহারদের তাম্রশাসনগুলিতে ভূমিদান করলেও ভূখণ্ডের চতুঃসীমা যথাযথভাবে নির্দিষ্ট করা হত না। এই সুযোগে দানগ্রহীতা জমির চৌহদ্ধি বৃদ্ধি করতে পারতেন। এই অতিরিক্ত রাজস্ব ভূস্বামীর আর্থিক শক্তিবৃদ্ধির সহায়ক হত। দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিমালিকানার প্রসার ঘটেছিল। নোবুরু কারাশিমা ভারতে সামন্তব্যবস্থার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, চোলযুগে (নবম-দশম শতক) অ-ব্রহ্মদের গ্রামগুলি ‘ঊর’ নামক গ্রামসভার সমষ্টিগত অধিকারে ছিল। হস্তান্তর-সংক্রান্ত লেখগুলিতে দানকর্তা হিসেবে ‘ঊর’-এর নামোল্লেখ আছে। কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন যে, ব্রহ্মদের গ্রামগুলিতে ব্রাহ্মণ ভূস্বামীদের অস্তিত্ব ছিল। চোলসম্রাট তৃতীয় রাজরাজের আমলে ব্যক্তিগতভাবে ভূমিদানের প্রমাণ পাওয়া যায়। নিম্ন-কাবেরী উপত্যকার এই সকল জমি ক্রয়বিক্রয়ের দলিলে ‘ঊর’-এর নাম নেই। অর্থাৎ ব্যক্তিবিশেষ কর্তৃক জমি হস্তান্তরের ঘটনা থেকে দক্ষিণ ভারতেও ব্যক্তিগত মালিকানার অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়।

অষ্টম শতক ও পরবর্তীকালে ভূমিদান ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাবল্য প্রসঙ্গে ড. শর্মা ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিদান বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছেন। ব্রাহ্মণ ও ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলিকে ‘অগ্রহার’ দানব্যবস্থার মাধ্যমে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার সূচনা হয়; কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসক ও সেনাকর্মচারীদের রাজস্ব ভোগদখলের অধিকার দেওয়া হলে সামন্ততান্ত্রিক কর্তৃত্ব জোরালো রূপ পায়। অধ্যাপক শর্মার মতে, অষ্টম-দশম শতকে বাণিজ্যের সংকোচ ঘটলে মুদ্রাব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সরকারি সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের নগদ বেতনের পরিবর্তে ভূমিরাজস্ব ভোগের অধিকার দেওয়া হয়। এই সকল এলাকার উদ্বৃত্ত রাজস্ব সম্ভবত রাজকোষে জমা দেওয়া হত। এবং রাজার প্রাপ্য রাজস্ব যথাযথ জমা দিতে পারলে এরা নিজ নিজ এলাকায় ইচ্ছামতো কর সংগ্রহ করতে পারতেন। ড. রণবীর চক্রবর্তীর মতে, “সামন্তদের মধ্যে এক-একটি এলাকা বরাদ্দ করে দেবার মধ্যে মধ্যযুগের জায়গির ব্যবস্থার কিছু সাদৃশ্য আছে।” গুর্জর-প্রতিহারদের রাজ্যে ‘বংশ পোতক ভোগ’ অধিকার অর্থাৎ বংশানুক্রমিকভাবে জমি ভোগদখলের অধিকার স্বীকৃত ছিল। এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একটি বিশেষ বংশের ধারাবাহিক কর্তৃত্ব বজায় থাকত। এই প্রবণতা সামন্ততান্ত্রিক উপাদানকে শক্তিশালী করেছিল। ড. শর্মা পালরাজা রামপালের আমলে ‘কৈবর্ত” বিদ্রোহের ঘটনাকে সামন্ততন্ত্রের প্রেক্ষাপট বর্ণনার কাজে ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে, ‘কৈবর্ত’ বিদ্রোহ ছিল মূলত একটি কৃষক বিদ্রোহ। সম্ভবত সামন্তদের শোষণ ও দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল এই অভ্যুত্থান। দেখা যায়, পালরাজা সামন্তদের সহায়তা নিয়ে এই বিদ্রোহ দমনে তৎপর হয়েছিলেন। এ থেকে দুটি সিদ্ধান্ত করা যায়—(১) রাজা তাঁর অস্তিত্বের জন্য সামন্তদের ওপর বিশেষ নির্ভরশীল ছিলেন এবং (২) কৈবর্ত কৃষক-বিদ্রোহের বিরুদ্ধে সামন্তদের প্রতিরোধ এই ভূস্বামী শ্রেণির শোষণমূলক চরিত্রের প্রমাণ দেয়।

সপ্তম থেকে দশম শতকে ভারতে বাণিজ্যের অধোগতি ও নগরায়ণের অবক্ষয়ের ঘটনাকে ড. শর্মা সামন্তব্যবস্থার উদ্ভবের অন্যতম প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। তাঁর মতে, এই সময়ে কৃষির ওপর এতটাই প্রাধান্য ও নির্ভরতা বেড়েছিল, যার পূর্বদৃষ্টান্ত নেই। এর মূলে ছিল বাণিজ্যের ক্রমিক অবনতি। এই মতের সমর্থনে তিনি পুরাণের বিবরণ ও মুদ্রা-অর্থনীতির ভাঙনের উল্লেখ করেছেন। ‘বিষ্ণুপুরাণ’ ও ‘স্কন্দপুরাণ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, কলিযুগে বৈশ্যদের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অবনতি ঘটবে এবং তারা বাণিজ্য ত্যাগ করে কারিগরের হীন বৃত্তি গ্রহণ করবে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের পরবর্তীকালে ভারত-রোম বাণিজ্যের অবসান ঘটলে ভারতের অর্থনীতির ওপরেও তার প্রভাব পড়ে। জমির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা বৃদ্ধির সূত্রে স্বয়ম্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে ওঠে। উদ্বৃত্ত উৎপাদনে অনীহা তীব্রতর হয়। স্বভাবতই বাণিজ্যের গতি মন্থর হয়। আলোচ্যকালে মুদ্রা-অর্থনীতিও রক্তাল্পতার শিকার হয়। বকাটকদের আমলেই মুদ্রার ব্যবহার সংকুচিত হয়। পাল ও সেন রাজারা কোনো মুদ্রা প্রচলন করেননি। রাষ্ট্রকুটদেরও কোনো মুদ্রা ছিল না। গুর্জর-প্রতিহারদের কিছু মুদ্রার সন্ধান পাওয়া যায়। তবে সেগুলির আন্তর্জাতিক বিনিময় মূল্য ছিল না। তাই বাণিজ্যের কাজে সম্ভবত ব্যবহার করা হত না। ড. শর্মার মতে, কার্যত ৬০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালে মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতির বিলোপ চূড়ান্ত হয়েছিল। একই সময়ে নগর-অবক্ষয়ের ঘটনাও সামন্ততন্ত্রের উত্থানতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে। অধ্যাপক বি. এন. এস. যাদব জিন প্রভঙ্গুরী’র ‘বিবিধার্থকল্প’-এর একটি উদ্ধৃতির ভিত্তিতে মন্তব্য করেছেন যে, আদি-মধ্যযুগে নগরগুলি ভেঙে প্রায় গ্রামে রূপান্তরিত হয়েছিল। ড. শর্মা হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণের ভিত্তিতে মনে করেন যে, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের পরবর্তীকালে গাঙ্গেয় উপত্যকার কিছু সমৃদ্ধ নগর, যেমন—শ্রাবন্তী, বৈশালী, কৌশাম্বী, কপিলাবস্তু, কুশীনগর ইত্যাদি অবক্ষয়ের কবলে পড়েছিল। হিউয়েন সাঙ কয়েকটি নগরকে ‘প্রায় প্রাণহীন, রিক্ত ও গ্রামীণ চরিত্রবিশিষ্ট’ বলে উল্লেখ করেছেন। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে গড়ে ওঠা নগরগুলির পুরাতাত্ত্বিক অবশেষ বিশ্লেষণ করে ড. শর্মা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, আদি-মধ্যযুগে শহরগুলি ক্রমে হতদরিদ্র রূপ নেয় এবং ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে পড়ে। নগরের এই অবক্ষয়কে শর্মা সামন্তব্যবস্থার অন্যতম লক্ষণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।

আদি-মধ্যযুগে ভারতে সামন্তব্যবস্থার সূচনা ও বিকাশ সম্পর্কে ড. শর্মা, যাদব প্রমুখের সিদ্ধান্ত সকলে মেনে নেননি। ভারতে আদি-মধ্যযুগের অর্থনৈতিক ছক সম্পর্কে শর্মা প্রমুখের মতের বিরোধিতা করেছেন ড. দীনেশ চন্দ্র সরকার, হরবস মুখিয়া প্রমুখ। অধ্যাপক সরকারের মতে, আদি-মধ্যযুগের তাম্রশাসনগুলিতে এমন কোনো কথা উল্লেখ নেই, যা থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ভূমিদানের ফলে রাজকোষের আয় হ্রাস পেয়েছিল। তাঁর মতে, দানগ্রহীতা জমির রাজস্ব ভোগ করতেন, কিন্তু কর সংগ্রহের অধিকার বা ক্ষমতা ছিল একমাত্র রাজার। তা ছাড়া ‘করশাসন’ নামক সরকারি আদেশনামার ভিত্তিতে তিনি দেখিয়েছেন যে, এই সকল আদেশনামা দ্বারা রাজা ‘অগ্রহার’ এলাকা থেকেও প্রয়োজনে কর সংগ্রহ করতে পারতেন। তাঁর মতে, সামন্তব্যবস্থার ফলে রাজা বা ভূস্বামীদের তেমনভাবে আর্থিক ক্ষতি ঘটেনি। এই ব্যবস্থায় প্রকৃতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সাধারণ কৃষকশ্রেণি। ড. রণবীর চক্রবর্তী মনে করেন, অধ্যাপক সরকারের মতামত খুব স্পষ্ট নয়। কারণ তিনি সামন্ত রাজাদের ‘ফিউডেটরী চিফ’ (Feudatory chiefs) এবং অভিজাতদের প্রাপ্ত ভূখণ্ড (ইনাম)-কে ‘ফিফ’ (Fief) বলে নানা সময় উল্লেখ করেছেন।

অধ্যাপক হরবস মুখিয়া পশ্চিম ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলির সাথে ড. শর্মা কথিত ভারতীয় সামন্তব্যবস্থার ধারার তুলনা করে ভারতে সামন্তব্যবস্থার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, সামন্ততন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি বৈশিষ্ট্য হল – (১) উৎপাদনের উপকরণের ওপর সামন্তপ্রভুর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং (২) চুক্তি (Contract)। আদি-মধ্যযুগের ভারতে এ দুটি উপাদানের অস্তিত্ব ছিল না। ভারতে উৎপাদনের উপকরণগুলি কৃষকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং ভূমিদাতা ও ভূমিগ্রহীতার মধ্যে কোনোরূপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হত না। এমনকি, কৃষক কোনোভাবেই জমির সাথে আবদ্ধ ছিল না। অধ্যাপক শর্মা ভারতে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বাণিজ্যের অধোগতি ও নগরের ক্রমিক অবক্ষয়ের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘Markets and Merchants in Early Medieval Rajastan’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য যথেষ্ট উন্নত ছিল। তিনি লেখমালার ভিত্তিতে বহু ব্যস্ত বাণিজ্যকেন্দ্রের নাম উল্লেখ করেছেন। কীর্তিনারায়ণ চৌধুরী ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠার ফলে ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যের নতুন ধারার ওপর গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, অষ্টম শতকের আগে পশ্চিম এশিয়ার জাহাজগুলি চিনের ক্যান্টন বন্দর পর্যন্ত চলাচল করত। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারতের পশ্চিম-উপকূলে পৌঁছানো সহজ হয়। অষ্টম শতকে চিনা জাহাজগুলি দক্ষিণ ভারতের ‘কালিকট’ ও ‘কুইলন’ বন্দরে আসত। এখানেই আসত আরব জাহাজগুলিও। এখান থেকে চিনাপণ্য আরব জাহাজে তোলা হয়। এইভাবে ভারতীয় বন্দরগুলি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। অর্থাৎ বাণিজ্য হ্রাস, নগরের অবক্ষয় ইত্যাদি তত্ত্ব দ্বারা সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব সম্পর্কে ড. শর্মার যুক্তি সর্বজনগ্রাহ্য নয়।

সপ্তম শতকের পরবর্তীকালে ভারতে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে বিতর্ক চলছে। সামন্ততন্ত্রের কালগত কাঠামো এবং আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি ছাড়া এই বিতর্কের সমাধান সম্ভব নয়। তবে সপ্তম শতকে ভারতে ভূমিদান ব্যবস্থা ব্যাপকতা পাওয়ার ফলে জমির ওপর যেভাবে ব্যক্তিগত মালিকানার সৃষ্টি হয়, তাতে সামন্ততান্ত্রিক উপাদানগুলির পোষণ ঘটা সহজ হয়। আক্ষরিক অর্থে আদি-মধ্যযুগের ভারতে সামন্তব্যবস্থা হয়তো গড়ে ওঠেনি; তবে সেকালে ভূমিব্যবস্থার পরিবর্তনের পথ ধরে সামন্ততান্ত্রিক উপাদানগুলির যে আবির্ভাব ঘটেছিল, তা বলা সম্ভবত অযৌক্তিক হবে না।