ভূদেব মুখােপাধ্যায় (১৮২৭-৯৪)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখেছিলেন, “ভূদেব-চরিত্রের মূলসূত্র তাঁহার মৌলিকতা। তিনি ইউরােপীয় সাহিত্য ও সভ্যতার পূর্ণ দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন, কিন্তু কখনও আত্মবিসর্জন করিয়া পাশ্চাত্ত্য পথের পথিক হন নাই। স্বদেশের ধর্মে, শাস্ত্রে, সমাজে, সংস্কারে, সাহিত্যে তাহার প্রভূত আস্থা, অত্যন্ত অনুরাগ ছিল। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস কখনও তাহাকে আয়ত্ত করিতে পারে নাই। একদিকে বিলাতী শিক্ষার নয়নান্ধকারী উজ্জ্বল চাকচিক্য, অন্যদিকে স্বদেশীর ধর্মশাস্ত্রের নির্বাণােন্মুখ বিকৃত বহিরালােক, ভূদেব উভয়ের একটিকেও নিজের লক্ষ্য করেন নাই। বিচারকুশল প্রাচীনকালের প্রবীণ আর্যের ন্যায়, নিজের যুক্তি ও বিচারশক্তির সাহায্যে উভয়ের অন্তর্নিহিত সার্বভৌম উদার আলােকে উভয়কে বুঝিয়াছিলেন, চিন্তা ও গবেষণার দ্বারা নিজের গন্তব্য পথের নির্ণয়ে অগ্রসর হইয়াছিলেন। এই বিশ্লেষণ যথার্থ। ভূদেব নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তিনি শিক্ষালাভ করেন তখনকার দিনের প্রগতিশীলতার পীঠস্থান হিন্দু কলেজে। পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার চোখ-ধাঁধানাে ঔজ্জ্বল্য সেকালের শিক্ষিত যুবকদের মনে কি ধরনের মােহ বিস্তার করত তা ভুদেবের সহপাঠী মধুসূদন দত্তের জীবনী থেকে জানা যায়। কিন্তু এই ঘােরতর পাশ্চাত্ত্য প্রভাবের মধ্যে বড় হয়ে উঠলেও ভূদেব নির্বিচারে পাশ্চাত্তের অনুসরণ করেন নি। তিনি নব্যশিক্ষায় শিক্ষিত মন নিয়ে যুক্তির পথে প্রাচীন ভারতীয় আদর্শসমূহের সত্যাসত্য বিচার করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তাঁর চিন্তাভঙ্গি আধুনিক, কিন্তু নির্বিচারে আধুনিকতার সবকিছু মেনে নিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। এই কারণে সমকালীন প্রধান পুরুষদের তুলনায় তাকে কিছুটা রক্ষণশীল, কিছুটা প্রাচীনপন্থী মনে হয়। কিন্তু ভূদেবের রচনাবলী পাঠ করলে মনে, হয়, যে জীবনাদর্শ তিনি মেনে চলেছেন তা অন্ধ সংস্কারভিত্তিক নয়, যুক্তি-বিচারের ওপরেই তার ভিত্তি। এই প্রখর যুক্তিবাদিতার জন্যেই তাঁর রচনার ভাষাও হয়ে উঠেছে ভাবাবেগ-ব্জিত lan- guage of reason। ভাষার নিজস্ব সৌন্দর্যের চেয়ে বক্তব্যের যুক্তি-পারম্পর্য সঠিকভাবে প্রকাশের ক্ষমতাই এই ভাষার প্রধান গুণ। যুক্তির গ্রন্থনে বাক্যগুলি পরস্পরের সঙ্গে সংবদ্ধ হয়ে এক-একটা অনুচ্ছেদ বক্তব্যের এক-একটা স্তরকে স্পষ্ট এবং আকারবদ্ধ করে তােলে। বিচার বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ রচনায় ভূদেব অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বাঙলা প্রবন্ধ সাহিত্যে একজন শ্রেষ্ঠ লেখক-হিশেবে তার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিচিত্র বিষয় অবলম্বনে এত বিপুল সংখ্যক প্রবন্ধ উনবিংশ শতাব্দীর আর কোন লেখক লেখেন নি। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের সকল প্রাবন্ধিকই ভূদেব মুখােপাধ্যায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

বিভিন্ন সময়ে রচিত তার প্রবন্ধগুলি বিষয়বস্তু-অনুযায়ী বিন্যস্ত করে বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলন করা হয়েছিল। তার অধিকাংশ রচনাই প্রথমে প্রকাশিত হয় ‘এডুকেশন গেজেট’ পত্রিকায়। প্রবন্ধ নংকলনগুলির নাম-পারিবারিক প্রবন্ধ (১৮৮২), সামাজিক প্রবন্ধ (১৮৯২), ‘আচার প্রবন্ধ’ ১৮৯৪) এবং ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১ম খণ্ড—১৮৯৪, ২খণ্ড—১৯০৫)। এ ছাড়া তিনি অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছিলেন। তার প্রথম বই ‘শিক্ষাবিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৬) ‘শিক্ষাপ্রণালী বিষয়ক, পাঠ্যপুস্তকরূপে সমাদৃত ‘পুরাতত্ত্বসারে’ (১৮৫৮) পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব থেকে আরম্ভ করে প্রাচীন পারসীদের বিবরণ পর্যন্ত প্রাচীন ইতিহাসের বর্ণনা পাই। ভূদেব-রচিত অন্যান্য পাঠ্যপুস্তক হল ‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞান’, ‘ইংলণ্ডের ইতিহাস’, ‘গ্রীস এবং রােমের ইতিহাস’ ইত্যাদি। ‘আচার-প্রবন্ধে’ ভূদেব হিন্দুশাস্ত্র ও লােকাচারসম্মত নিত্য ও নৈমিত্তিক অনুষ্ঠানের তাৎপর্য বর্ণনা করেছেন। যে শিক্ষায় নারী সুগৃহিণী হতে পারে, সেটাই ‘পারিবারিক প্রবন্ধে’র বিষয়বস্তু। ভূদেব ‘সামাজিক প্রবন্ধে’ হিন্দু সমাজ গঠনের বৈশিষ্ট্য, ইংরেজের সম্পর্কে বাঙালি কিভাবে উপকৃত হতে পারে ইত্যাদি বিষয় সম্বন্ধে আলােচনা করেছেন। ‘আচার প্রবন্ধ’, ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ ও ‘পুষ্পাঞ্জলি’- এই প্রবন্ধ পুস্তকগুলির জন্য হিন্দু সমাজের উপদেষ্টা ভূদেবচন্দ্রকে বাঙালী অনেকদিন স্মরণে রেখেছিল।

ভূদেবের রচনাবলীর মধ্যে অন্যতম প্রধান গ্রন্থ ঐতিহাসিক উপন্যাস (১৮৫৭) -এর কথাও বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এই গ্রন্থটি দুটি ঐতিহাসিক রােমান্স জাতীয় সংক্ষিপ্ত রচনার সংকলন। কাহিনী দুটির নাম সফল স্বপ্ন’ এবং ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’। বিষয়বস্তু ‘Romance of History নামক গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত, কিন্তু রচনাভঙ্গিতে মৌলিকতা আছে। বিশেষভাবে ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ নামক আখ্যানটি পূর্ণাঙ্গ এবং উপন্যাসের লক্ষণযুক্ত। এর ভাষা বিদ্যাসাগরের বর্ণনাত্মক গদ্যের অনুবর্তী। অনেক সমালােচক মনে করেন, বঙ্কিমচন্দ্র ‘দুর্গেশনন্দিনী’ রচনায় ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’-এর দ্বারা বহুল পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছেন। সামাজিক উপন্যাস-এর সূচনা প্যারীচাদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ থেকে, আর বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক উপন্যাসের সূচনা হয়েছে ভূদেবের ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ থেকে।

ভূদেব মুখােপাধ্যায়ের স্বাধীন কল্পনামূলক রচনা হিসেবে ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস’ (১৮৯৪) বইটির নামও উল্লেখযােগ্য। রচনাটি প্রথমে এডুকেশন গেজেটে ৭ই কার্তিক ১২৮২ সাল থেকে এবং পুস্তকাকারে ১৩০২ সালে প্রকাশিত হয়। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে নায়কেরা যদি জয়লাভ করত, তবে স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষের রূপ কী হত, তারই একটি গৌরবমণ্ডিত কাল্পনিক চিত্র ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে’ তুলে ধরা হয়েছে। ভাষা সংস্কৃত-অনুযায়ী হওয়া সত্ত্বেও সহজ স্বচ্ছ ও লালিত্যপূর্ণ। ভূদেবের গদ্য-রচনায় প্রবন্ধ সাহিত্যের রূপ যেভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে, সে বিষয়ে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্য স্মরণীয়- “রামমােহন ও অক্ষয়কুমার যেমন যুক্তিবাদের দ্বারা উপনিষদ ও ব্রাহ্মধর্মের গ্রহণীয়তা প্রতিপন্ন করিয়াছিলেন, ভূদেব সেই যুক্তি-প্রয়ােগেই প্রচলিত হিন্দুধর্ম ও আচারের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করিতে চাহিয়াছেন। সুতরাং তাহার রচনা যে সাধারণতঃ মনন-প্রধান তাহা স্বতঃসিদ্ধ। তথাপি ইহারই পিছনে এক অবরুদ্ধ-সংযত আবেগ, এক আদর্শ স্বপ্নচারী ভাষাশিল্প ঈষৎ আভাসিত হইয়া প্রবন্ধগুলির উপর একটি অনতিস্পষ্ট কাব্যব্যঞ্জনা আরােপ করিয়াছে।”