ভারী পানি কি?
ভারী পানি | Image Source: Internet |
ভারী পানি একটি যৌগ যা অক্সিজেন এবং ডিউটেরিয়াম দ্বারা গঠিত। ডিউটেরিয়াম হল হাইড্রোজেনের একটি ভারী আইসোটোপ যাকে ‘2H’ বা ‘D’ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। ভারী পানিকে ডিউটেরিয়াম অক্সাইডও বলা হয়।
একই মৌলের ভিন্ন ভিন্ন পরমাণুর যদি প্রোটন সংখ্যা পরস্পর সমান থাকে কিন্তু ভর সংখ্যা বা নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন থাকে, তবে তাদেরকে পরস্পরের আইসোটোপ বলে।
হাইড্রোজেনের প্রোটিয়াম, ডিউটেরিয়াম এবং ট্রিটিয়াম নামে তিনটি প্রাকৃতিক আইসোটোপ রয়েছে। এদেরকে 1H(প্রোটিয়াম), 2H (ডিউটেরিয়াম)এবং 3H(ট্রিটিয়াম) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এদের মধ্যে প্রোটিয়াম দিয়ে সাধারণ পানি এবং ডিউটেরিয়াম দিয়ে ভারী পানি গঠিত হয়।
সাধারণ পানির সংকেত H2O এবং এক অণু সাধারণ পানির অণুতে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু ও একটি অক্সিজেন পরমাণু থাকে। অন্যদিকে, ভারী পানির রাসায়নিক সংকেত D2O। ভারী পানির এক অণুতে দুটি ডিউটেরিয়াম পরমাণু ও একটি অক্সিজেন পরমাণু থাকে।
সাধারণ পানির চেয়ে ভারী পানির মোলার ভর বেশি থাকে কারণ ভারী পানিতে থাকা ডিউটেরিয়ামের এটমিক ভর সাধারণ পানিতে থাকা প্রোটিয়ামের (হাইড্রোজেন) এর এটমিক ভরের চেয়ে বেশি।
শুধু তাই নয়, সাধারণ পানীয় জল থেকে ভারী পানির বিভিন্ন ধর্ম ও বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন হয়ে থাকে অনেকটা। বিজ্ঞানী হেরল্ড উড়ে (Harold Urey) ১৯৩৩ সালে সর্ব প্রথম সাধারণ জল থেকে ভারী জল পৃথক করতে সমর্থ হন এবং ডিউটেরিয়াম আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার এ ভূষিত হন।
ভারী পানি কোথায় পাওয়া যায়?
প্রকৃতিতে ডিউটেরিয়াম আইসোটোপের সংখ্যা খুবই নগণ্য। প্রতি ১ লক্ষ হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যে সাধারণত ১৫টি ডিউটেরিয়াম পরমাণুর আইসোটোপ পাওয়া যায়। আর এই আইসোটোপ যখন অক্সিজেনের সাথে মিশে জল উৎপন্ন করে তাকে ভারী জল বলে।
প্রকৃতিতে ভারী জল একক ভাবে বিরাজ করে না। সাধারণ জলের সাথে মিশে থাকে। বৃষ্টির জল, পুকুর, নদী, খাল, নলকূপ, কুয়ো, সমুদ্রের জলের সাথে মিশে থাকে। তবে নদী বা সমুদ্রের ০.০১৫ শতাংশ জলই ভারী জল। নলকূপ কুয়া পুকুরের পানিতে প্রতিটনে ভারী পানি থাকে প্রায় 200g – 250g।
ভারী পানির উৎপাদন
ভারী পানির উৎপাদন প্রক্রিয়া খুবই সহজ। যেহেতু এটি সাধারণ পানির সাথে বিদ্যমান তাই একে স্বাভাবিক তড়িৎ বিশ্লেষণ ও পাতন প্রক্রিয়ায় আলাদা করা যায়। বার বার পাতন করে প্রায় ৯৯% ভারী পানি পাওয়া যায়।
ইলেক্ট্রোলাইট: NaOH যুক্ত পানি।
ক্যাথোড: স্টিলের পাত্র।
অ্যানোড : গর্তযুক্ত নিকেল শিট।
এই তড়িৎ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়াটি চলতে থাকলে পানিতে ক্রমাগত ভারী পানির ঘনত্ব বাড়তে থাকে। এমনকি এভাবে প্রায় সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ভারী পানি পাওয়া সম্ভব।
ভারী পানির বৈশিষ্ট্য
ভারী পানির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলো হল-
১। ভারী পানির রাসায়নিক অক্সাইড এবং এর সংকেত D2O
২। ভারী পানির আণবিক ভর 20.02 গ্রাম / মোল
৩। ভারী পানির ঘনত্ব 1.107 গ্রাম / মি.লি
৪। ভারী পানির দ্বিমেরু ভ্রামক 1.87 D
৫। ভারী পানির গলনাঙ্ক 3.82 ডিগ্রী সেলসিয়াস
৬। ভারী পানির স্ফুটনাঙ্ক 101.4 ডিগ্রী সেলসিয়াস
ভারী পানির ভৌত ধর্ম
ভারী পানির ভৌত ধর্ম অনেকটাই সাধারণ পানির মতই। তবে দু একটা ক্ষেত্রে এই ধর্মের কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায়। চলুন দেখে নেওয়া যাক ভারী পানির ভৌত ধর্মগুলো।
১। প্রমাণ তাপমাত্রা ও চাপে ভারী জল বর্ণহীন।
২। কক্ষ তাপমাত্রায় ভারী পানি সাধারণ পানির মতই গন্ধহীন তরল।
৩। ভারী পানির ঘনত্ব সাধারণ পানির তুলনায় প্রায় 11% বেশি। তাই H2O বা সাধারণ পানির একটি আইস কিউব পানিতে ভেসে থাকলেও ডিউটেরিয়াম অক্সাইড বা ভারী পানির একটি আইস কিউব পানিতে ডুবে যাবে।
৪। ভারী পানিকে যখন সাধারণ পানির সাথে মেশানো হয় তখন একটি সমসত্ত্ব মিশ্রণ তৈরি করে।
ভারী পানির রাসায়নিক ধর্ম
হাইড্রোজেনের তিনটি আইসোটোপ রয়েছে- প্রোটিয়াম, ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম। পারমানবিক ভরের পার্থক্যের জন্য প্রত্যেকটি আইসোটোপ ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক ধর্ম প্রদর্শন করে থাকে। চলুন দেখে নেওয়া যাক ভারী পানির রাসায়নিক ধর্মগুলো।
১। তড়িৎ বিশ্লেষণ: ভারী পানির তড়িৎ বিশ্লেষণে ক্যাথোডে ডিউটেরিয়াম পাওয়া যায়।
২। ক্ষার এবং ক্ষারীয় ধাতুর সাথে বিক্রিয়ায় ডাই-ডিউটেরিয়াম গঠন করে, তবে এটি খুব ধীর গতিতে ঘটে।
৩। ধাতব অক্সাইডের সাথে ধীর গতির বিক্রিয়া ঘটে এবং সংশ্লিষ্ট ধাতুর ডিউটোরক্সাইড তৈরি করে।
৪। অধাতব অক্সাইডগুলির সাথে বিক্রিয়ায় ডিউটারো-অ্যাসিড উৎপন্ন হয়। ফসফরাস পেন্টক্সাইড এবং সালফার ট্রাইঅক্সাইডের মতো অধাতব অক্সাইডগুলি সহজেই ভারী পানিতে দ্রবীভূত হয়।
৫। যখন ভারী পানি ধাতব নাইট্রাইড, ফসফাইড এবং আর্সেনাইড এর সাথে বিক্রিয়া করে যথাক্রমে ডিউটেরোমোনিয়া, ডিউটেরোফোসফাইন এবং ডিউটেরোয়ারসিন উৎপন্ন হয়।
৬। ভারী পানি বিভিন্ন যৌগের সাথে যুক্ত হয়ে ভারী পানির স্ফটিক গঠন করতে পারে, যা ডিউটেরেটস নামে পরিচিত।
ভারী পানির জৈব ধর্ম
যেহেতু রাসায়নিক ধর্মের দিক দিয়ে ভারী পানি সাধারণ পানির চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন তাই এর বিশেষ কিছু জৈব বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
১। অধিক পরিমাণের উপস্থিতির কারণে পানির দ্রাবক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হয় যা জৈবিক পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
২। ভারী পানির উপস্থিতিতে তামাক বীজ জন্মায় না।
৩। ভারী পানি প্রাণী ও উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে।
ভারী পানির প্রকারভেদ
সাধারণত তিন ধরনের ভারী পানি রয়েছে-
১। সেমি-হেভি ওয়াটার (HDO)
২। হেভি-অক্সিজেন ওয়াটার
৩। ট্রিটিয়েটেড ওয়াটার (T2O)
১। সেমি-হেভি ওয়াটার (HDO): ভারী পানির বিশেষ এই রূপটিকে HDO দ্বারা প্রকাশ করা হয়, অর্থাৎ এটি একটি প্রোটিয়াম, একটি ডিউটেরিয়াম এবং একটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে তৈরি। পানির অণুগুলির মধ্যে একে অপরের সাথে হাইড্রোজেন পরমাণু বিনিময় করার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যে কারণে HDO কে প্রোটিয়াম এবং ডিউটেরিয়াম উভয়ই পানির নমুনায় পাওয়া যেতে পারে।
২। হেভি-অক্সিজেন ওয়াটারঃ 17O এবং 18O এর মতো অক্সিজেনের ভারী আইসোটোপযুক্ত পানিকে ভারী-অক্সিজেন পানি বা হেভি-অক্সিজেন ওয়াটার বলে।এটির ঘনত্ব সাধারণ পানির চেয়ে বেশি, যার কারণে একে ভারী পানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অক্সিজেনের 18O আইসোটোপযুক্ত ভারী-অক্সিজেন পানি ফ্লুরিনের 18F আইসোটোপ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এটি রেডিও-ট্রেসার এবং রেডিওফার্মাসিউটিকালসেও ব্যবহৃত হয়।
৩। ট্রিটিয়েটেড ওয়াটার (T2O): এটি জলের একটি তেজস্ক্রিয় রূপ যাতে প্রোটিয়ামের পরিবর্তে ট্রিটিয়াম থাকে। একে সাধারণত অতি-ভারী পানি বলা হয় এবং এটি T2O দ্বারা সূচিত করা হয়। ট্রিটিয়েটেড পানি কোন বস্তুতে মোট পানির পরিমাণ নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়। T2O এর মোলার ভর 22.03 গ্রাম/মোল এবং এর ঘনত্ব 1.85 গ্রাম/মি.লি।
ভারী পানির ব্যাবহার
ভারী পানির নানাবিধ ব্যাবহার রয়েছে। এগুলো হল-
১। নিউক্লিয়ার চুল্লীতে শীতলকারক হিসেবে ভারী পানির ব্যাপক ব্যাবহার হয়।
২। ভারী পানি ডিউটেরিয়াম উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
৩। শ্বসন এবং সালোকসংশ্লেষণ গবেষণায় ভারী পানি ব্যবহৃত হয়।
৪। Nuclear Magnetic Resonance বর্ণালীতে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে উৎপন্ন চৌম্বকক্ষেত্র পর্যবেক্ষণে ভারী পানি ব্যবহৃত হয়।
৫। IR (ইনফ্রারেড) স্পেক্ট্রোগ্রাফিতে অনেকসময় সাধারণ পানির পরিবর্তে ভারী পানি ব্যবহার করা হয়।
৬। পারমাণবিক চুল্লীতে গতিশীল নিউট্রন ধীর করার জন্য মডারেটর হিসাবে ভারী পানি ব্যবহৃত হয়।
৭। D2O এবং ভারী-অক্সিজেন পানির মিশ্রণের সাহায্যে মানুষ এবং প্রাণীতে বিপাকের হার পরীক্ষা করা হয়।
ভারী জলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক বিক্রিয়া
তড়িৎ বিশ্লেষণ: 2D2O → 2D2 (ডিউটেরিয়াম) + O2
অর্থাৎ, ২ অণু ভারী পানির তড়িৎ বিশ্লেষণে ২ অণু ডিউটেরিয়াম ও ১ অণু অক্সিজেন উৎপন্ন হয়।
ধাতুর সাথে বিক্রিয়া: 2Na + 2D2O → 2NaOD + D2
সোডিয়ামের (ধাতু) সাথে বিক্রিয়ায় সোডিয়াম ডিউটারঅক্সাইড এবং ডিউটেরন উৎপন্ন করে।
অধাতুর সাথে বিক্রিয়া: D2O + Cl2 → DCl + DOCl
ধাতব অক্সাইডের সাথে বিক্রিয়া: MgO + D2O → Mg(OD)2
অধাতব অক্সাইডের সাথে বিক্রিয়া:
SO3 + D2O → D2SO4 (ডিউটারো সালফিউরিক অ্যাসিড)
ম্যাগনেসিয়াম নাইট্রাইডের সাথে বিক্রিয়া:
Mg3N2 + 6D2O → 3Mg(OD)2 + 2ND3 (ডিউটারো অ্যামোনিয়া)
ক্যালসিয়াম ফসফাইডের সাথে বিক্রিয়া:
Ca3P2 + 6D2O → 3Ca(OD)2 + 2PD3 (ডিউটারো ফসফাইড)
ক্যালসিয়াম কার্বাইডের সাথে বিক্রিয়া:
CaC2 + 2D2O → Ca(OD)2 + C2D2 (ডিউটারো অ্যাসিটিলিন)
অ্যালুমিনিয়াম কার্বাইড সহ বিক্রিয়া:
Al4C3 + 12D2O → 4Al(OD)3 + 3CD4 (ডিউটারো মিথেন)
ভারী পানি কি পান করা যায়? এটা কি বিপদজনক?
ভারী পানি নিয়ে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে কৌতূহল তা হল ভারী পানি কি পান করা যায়? কিংবা ভারী পানি পান করা কি বিপজ্জনক?
স্বাভাবিকভাবেই পানির সাথে তুলনার ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে এ ধরনের প্রশ্ন জেগে থাকে। আর বেশিরভাগ সময় যখন আমরা ভারী জলের বিষয়ে কথা বলি তখন আমরা একে পারমাণবিক চুল্লি এবং তেজস্ক্রিয় পদার্থের সাথে সম্পর্কিত ভেবে থাকি।
তবে খাঁটি ভারী পানি তেজস্ক্রিয় নয় এবং স্বল্প পরিমাণে খেলে এটি তেমন ক্ষতি করে না (বি.দ্রঃ ভারী পানি পান করা থেকে বিরত থাকুন)।
তবে কেউ যদি অধিক পরিমাণে গ্রহণ করে বা দীর্ঘ সময় ধরে ভারী পানি গ্রহণ করে তবে এটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক এবং বিপজ্জনক হতে পারে। এটি আমাদের শরীরে বিষক্রিয়া ঘটতে পারে এবং মাথা ঘোরা, রক্তচাপ হ্রাসের মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
এই ছিল আমাদের ভারী পানি নিয়ে আজকের আলোচনা। কোন প্রশ্ন থাকলে বা পরবর্তীতে ভারী পানি নিয়ে আরও কিছু চমকপ্রদ লেখা পেতে চাইলে কমেন্ট করে জানান।
কমেন্ট বক্সে লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানান |
Leave a comment