সূচনা: আফ্রিকা-সহ বিভিন্ন ব্রিটিশ উপনিবেশে কৃষি ও অন্যান্য উৎপাদনমূলক কাজে বিপুল সংখ্যক বহিরাগত শ্রমিকের প্রয়ােজন মেটানাের উদ্দেশ্যে ভারতের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার ১৮২০-র দশক থেকে এদেশের বিপুল সংখ্যক ভারতীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিককে বিদেশে পাঠাতে শুরু করে। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে শ্রমিকের রপ্তানি যথেষ্ট বৃদ্ধি পায় এবং তা চলে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ভারতের বর্তমান বাংলা, আসাম, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্য ভারত প্রভৃতি অঞ্চল থেকে এসব শ্রমিক সংগ্রহ করে বিদেশে পাঠানাে হত।

[1] শ্রমিক সংগ্রহ ও যাত্রার ব্যবস্থা: ভারত থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে বিদেশে পাঠানাের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন এজেন্সি গড়ে ওঠে। এসব সংস্থার এজেন্টরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে বিদেশে পাঠানাের যাবতীয় ব্যবস্থা করত। ব্রিটিশরা ইউরােপীয় দেশগুলির বিভিন্ন উপনিবেশ, যেমন- ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মরিশাস, ট্রিনিদাদ, গুয়ানা, সুরিনাম, ফিজি প্রভৃতি স্থানে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় শ্রমিককে কাজে পাঠায়। এ ছাড়া গ্রানাডা, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট কিটস, সেন্ট ভিনসেন্ট, নাটাল প্রভৃতি স্থানেও বহু ভারতীয় শ্রমিককে পাঠানাে হয়।

[2] যাত্রাকাল: শ্রমিকদের যাত্রাকালে প্রতিটি জাহাজে একজন করে মেডিকেল সার্জন নিযুক্ত হত। এই সার্জনরা শ্রমিকদের চিকিৎসার দায়িত্ব ছাড়াও তাদের নিয়ােগের কাগজপত্রাদি রক্ষার দায়িত্ব পালন করত।। কলকাতার বন্দর থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিয়ে জাহাজ ওয়েস্ট ইন্ডিজে ২০ সপ্তাহে, নাটালে ১২ সপ্তাহে এবং মরিশাসে ১০ সপ্তাহে পৌছােত। বন্দরে পৌছােনাের পর কর্মক্ষেত্রে পাঠানাের আগে শ্রমিকদের অন্তত ১ সপ্তাহ বন্দর এলাকায় অপেক্ষা করতে হত।

[3] মরিশাস যাত্রার সূত্রপাত: সর্বপ্রথম ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় শ্রমিকদের মরিশাসে পাঠানাে হয়। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অন্তত ২৫ হাজার ভারতীয় শ্রমিককে মরিশাসে পাঠানাে হয়। ব্রিটিশ সরকার ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় শ্রমিকদের বিদেশে রপ্তানির দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। এ বছর ধাঙড় সম্প্রদায়ের ১১,৫৪৯ জন কুলি শ্রমিক মরিশাস-এ আসে।

[4] অন্যান্য স্থানে যাত্রা: সরকারি উদ্যোগে জামাইকা, ব্রিটিশ গুয়েনা ও ট্রিনিদাদে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে, গ্রানাডায় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে, সেন্ট লুসিয়ায় ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে এবং নাটালে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক পাঠানাের বিষয়টি বৈধ হয়। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৫,২৫,৪৮২ জন চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় শ্রমিক ব্রিটিশ ও ফরাসি উপনিবেশগুলিতে পাড়ি দেয়।

[5] কাজের মেয়াদ: এজেন্টরা বিদেশে প্রেরিত ভারতীয় শ্রমিকদের সঙ্গে সাধারণত ৫ বছর মেয়াদের কাজের চুক্তি করত। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাদের ফিরে আসতে হত। সাধারণত যে বন্দর থেকে শ্রমিকরা বিদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিত, মেয়াদ শেষে আবার সেই বন্দরেই তাদের ফিরিয়ে আনা হত।

[6] নির্দেশনামা: ভারতীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানাের বিষয়ে ভারতের ব্রিটিশ সরকার ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে একটি নির্দেশনামায় কিছু শর্ত আরােপ করে। এই নির্দেশনামা অনুসারে, বিদেশগামী শ্রমিক এবং তার প্রেরণকারী এজেন্টকে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে হাজির হয়ে শ্রমিকের কাজের মেয়াদ সম্পর্কে লিখিত চুক্তি করতে হত। এ ছাড়া শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় বিদেশে কাজে যাচ্ছে বলে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তারা ঘােষণা করত।

[7] মহিলা শ্রমিক: ভারতীয় শ্রমিকরা বিদেশে পারিবারিক জীবনযাপনের সুযােগ করে দিয়ে সেখানে তাদের দীর্ঘদিন কাজে নিয়ােগের চিন্তাভাবনা করা হয়। এই উদ্দেশ্যে তাদের সঙ্গে তাদের স্ত্রী কন্যাদেরও বিদেশে শ্রমিক হিসেবে পাঠানাে শুরু হয়। মরিশাসে যাওয়া ভারতীয় শ্রমিকদের মধ্যে ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ৪,৩০৭ জন এবং ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ১,৮৪০ জন ছিল মহিলা শ্রমিক। ১৮৫৬-৫৭ খ্রিস্টাব্দে অন্তত ২৫ শতাংশ মহিলা শ্রমিক পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পরের বছর ঘােষণা করা হয় যে, চুক্তিবদ্ধ মহিলা শ্রমিকদের চেয়ে পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ৩ গুণের বেশি হবে না। এর ফলে বিদেশে প্রেরিত চুক্তিবদ্ধ মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে।

উপসংহার: ভারতের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে প্রেরিত হতে থাকে। ইউরােপের উপনিবেশগুলির জন্য ভারত থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক পাঠানাের বিষয়টি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়। বিদেশে তারা নানা দুঃখদুর্দশা ও মৃত্যুর শিকার হয়। ভারত থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের সর্বশেষ জাহাজটি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্ট ইন্ডিজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এবং সর্বশেষ জাহাজটি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে ভারতে ফিরে আসে।