[1] উপযুক্ত শীর্ষ নেতৃত্বের অভাব: ভারত ছাড়াে আন্দোলন সম্পূর্ণরূপে গান্ধিজির নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই গান্ধিজি-সহ কংগ্রেসের সব শীর্ষনেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়। গান্ধিজির অবর্তমানে সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতাে শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতিতে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

[2] কমিউনিস্ট-সহ অন্যান্য দলের বিরােধিতা: ভারতের কমিউনিস্ট দল পরােক্ষভাবে ভারত ছাড়াে আন্দোলনের বিরােধিতা করেছিল। জাতীয় আন্দোলনের মূলস্রোত থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে তারা ব্রিটিশের সহযােগিতা করে। মুসলিম লিগ, অনুন্নত সম্প্রদায়, লিবারেল গােষ্ঠী, হিন্দু মহাসভা, র্যাডিক্যাল ডেমােক্র্যাটিক পার্টি এই আন্দোলনে সহযােগিতা করেনি। ফলস্বরূপ আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

[3] অসময়ে সূচনা: সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন এই আন্দোলনের সূচনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু গান্ধি অনুগামীরা তখন তা করেননি। সেই আন্দোলন গান্ধিজি শুরু করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে ইংল্যান্ড-সহ মিত্রপক্ষ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। ফলে এই বিলম্ব আন্দোলনকে ব্যর্থ করে।

[1] স্বাধীনতার অজেয় সংকল্প: ১৯৪২-এর ভারত ছাড়াে আন্দোলন ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতবাসীর ঘনীভূত ক্ষোভ ও তা থেকে মুক্তির জন্য অজেয় সংকল্প এই বিদ্রোহে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। এই আন্দোলনে সমাজের গরিব শ্রেণির অংশগ্রহণের সুন্দর বিবরণ রয়েছে সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’ এবং ‘টোড়াই চরিত মানস’—এই দুই উপন্যাসে।

[2] সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা: মুসলিম লিগ এই আন্দোলনে যােগ না দিলেও উত্তরপ্রদেশ, বিহার, চট্টগ্রাম, শিলচর প্রভৃতি স্থানের বহু মুসলিম এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে অংশ নেয়। আন্দোলন চলাকালে কোথাও কোনাে সাম্প্রদায়িক বিরােধ বাধেনি। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ছিল এই আন্দোলন্সের এক বিশাল সম্পদ।

[3] জাতীয় বিপ্লব: ৪২-এর আন্দোলনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন- “নেতা সংগঠন নেই, উদ্যোগ আয়ােজন কিছু নেই, কোনাে মন্ত্রবল নেই, অথচ একটা অসহায় জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মপ্রচেষ্টার আর কোনাে পথ না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠল—এ দৃশ্য বাস্তবিকই বিস্ময়ের।” এই আন্দোলনকে তিনি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বড়ােলাট লর্ড লিনলিথগােও এই আন্দোলনকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর সবচেয়ে বড়াে বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন। অরুণ চন্দ্র ভূঁইয়া তাঁর ‘The Quit India Movement’ গ্রন্থে বলেছেন যে, এই আন্দোলনের ফলে একটি অভূতপূর্ব জাতীয় জাগরণ ও জাতীয় ঐক্যবােধ গড়ে ওঠে।

[4] স্বাধীনতা অর্জনের ভিত্তিস্থাপন: ৪২-এর আন্দোলনের গভীরতা ও ব্যাপকতা যে ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল, সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। একদিকে যখন সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র বিপ্লবী তৎপরতায় ভারতের ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, ঠিক তখনই ভারত ছাড়াে আন্দোলনের তীব্রতা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসনিক ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল। এর ফলে ইংরেজরা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়।

[5] কংগ্রেসের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা: এই আন্দোলন থেকে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিল জাতীয় কংগ্রেস। আন্দোলনকালে মহাত্মা গান্ধির অনশন জাতির হৃদয়ে কংগ্রেসের মর্যাদাকে পুনরায় অধিষ্ঠিত করে। কংগ্রেস নেতাদের দুঃখবরণ ও আত্মত্যাগ দেখে জাতি আপ্লুত হয়। সমাজবাদী কংগ্রেস নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ ‘Towards Struggle’ গ্রন্থে লেখেন, “The Congress alone is the country’s salvation.”

[6] গণ আন্দোলন হিসেবে: এই আন্দোলনে শ্রমিক ও কৃষক-সহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়ে একে গণ আন্দোলনের রূপদান করে। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিও এই আন্দোলন গণযুদ্ধ আখ্যা দিয়েছিল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মতে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে এ ধরনের ব্যাপক বিদ্রোহ ইতিপূর্বে আর কখনও সংঘটিত হয়নি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মন্ত্র মুখর’ উপন্যাসে আগস্ট বিপ্লব বা ভারত ছাড়াে আন্দোলনের গণজাগরণের চিত্র ধরা পড়ে।