[1] শ্রমিকদের ভূমিকা: শ্রমিকশ্রেণি সক্রিয়ভাবে ভারত ছাড়াে আন্দোলনে যােগ দিয়ে এই আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছিল।
-
[i] আমেদাবাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির শ্রমিকরা তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তােলে এবং কারখানাগুলিকে ৩ মাস বন্ধ করে রাখে।
-
[ii] জামশেদপুরে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দের পরিচালনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে শামিল হয়।
-
[iii] আমেদাবাদে সুতাকলের শ্রমিকরাও সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
-
[iv] বাংলার হাওড়া, কলকাতা, হুগলি ও মেটিয়াবুরুজের বস্ত্র শিল্প ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প কারখানাগুলির শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট ডাকে।
[2] কৃষকদের ভূমিকা: ভারত ছাড়াে আন্দোলনে যােগ দিয়ে কৃষকরা গৌরবজনক ভূমিকা পালন করেছিল। মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক কৃষক এমনকি খেতমজুররাও ভারত ছাড়াে আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যােগদান করে ও এই আন্দোলনকে জঙ্গি রূপ দেয়।
-
[i] বিহারের পালামৌ জেলার কৃষকরা আগস্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
-
[ii] বােম্বাইয়ে খান্দেশ ও সাঁতারার কৃষকরা এই আন্দোলনে শামিল হয়।
-
[iii] বাংলার মেদিনীপুর জেলার কাথি ও তমলুকের কৃষকরা ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরােধ গড়ে তােলে। তমলুক থানা দখল করতে গিয়ে শহিদ হন বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা।
-
[iv] বীরভূম, ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল, দিনাজপুর, বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া প্রভৃতি জেলার কৃষকগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলনকে গণমুখী করে তােলে। তাই ম্যাক্স হারকোট বলেছেন—“এই আন্দোলন ছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ, জাতীয় বিদ্রোহ নয়।”
[3] নারীদের ভূমিকা: ভারত ছাড়াে আন্দোলনের সময় বেশিরভাগ জাতীয় নেতা কারারুদ্ধ ছিলেন। তাই প্রথম কোনাে জাতীয় আন্দোলনে নারীরা সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন। বােম্বাইয়ে অরুণা আসফ আলি এবং উষা মেহতা, আসামে কনকলতা বড়ুয়া, পাঞ্জাবে রাজকুমারী অমৃতা কাউর ও ভােগেশ্বরী ফুকোননী, বাংলার মেদিনীপুরে মাতঙ্গিনী হাজরা, করাচিতে হেমু কালানি, ঢাকায় আশালতা সেন, সুচেতা কৃপালানী প্রমুখ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই সময় আন্দোলনের প্রচারকাজ পরিচালনার জন্য গােপনে বেতার কেন্দ্র চালানাে হত। এই বেতার কেন্দ্র পরিচালনার ভার নেন উষা মেহতা। মেদিনীপুরে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠিত হলে তার সঙ্গে যুক্ত নারীরা এক সামরিক সংগঠন গঠন করে যা ভগিনী সেনা নামে পরিচিত। গান্ধিবুড়ি নামে খ্যাত তিয়াত্তর বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা কুড়ি হাজার নারীকে নিয়ে গঠিত এই সেনাদলকে নেতৃত্ব দেন। ভারত ছাড়াে আন্দোলন পর্বে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি বাংলার দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। অরুণা আসফ আলি নারীদের নিয়ে বৈপ্লবিক কাজকর্ম সংগঠিত করেন।
[4] ছাত্রদের ভূমিকা: ভারত ছাড়াে আন্দোলন শুরু হলে ছাত্র সমাজ সর্বশক্তি নিয়ে এই আন্দোলন পরিচালনা করে। কলকাতায় ও ঢাকায় ব্যাপক ছাত্র ধর্মঘট শুরু হলে পুলিশ ছাত্রদলের ওপর বর্বর আক্রমণ চালায়। মেদিনীপুরের কাথি, তমলুক, মহিষাদল, নন্দীগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে আন্দোলন জঙ্গি রূপ ধারণ করে। আন্দোলনকারীরা থানা ও সরকারি ভবন দখল করে এবং রেললাইন ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। পূর্ব বাংলার ফরিদপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ, যশােহর, খুলনা ইত্যাদি অঞ্চলে ছাত্ররা একটানা ধর্মঘট পালন করে। বাংলার পুলিন সেন, উপেন জানা, বীরেন মাল, গােরাচাদ ঘােডুই প্রমুখ ছাত্ররা অনুভব করেন যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মােকাবিলার জন্য অস্ত্র প্রয়ােজন। উত্তরপ্রদেশের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভারত ছাড়াে আন্দোলন প্রসারের লক্ষ্যে উত্তরপ্রদেশের গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। এলাহাবাদ, বারাণসী, কানপুর, লখনউ প্রভৃতি অঞ্চলে ছাত্র আন্দোলন জঙ্গি রূপ নেয়। মহারাষ্ট্রের আহম্মদনগর, গুজরাটের আমেদাবাদ, বােম্বাই-সর্বত্র ছাত্ররা ব্যাপকভাবে ভারত ছাড়াে আন্দোলনে অংশ নেয়।
[5] মুসলিম সম্প্রদায়ের ভূমিকা: ভারত ছাড়াে আন্দোলনে মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ আশানুরূপ ছিল না। মুসলিম লিগ বােম্বাই অধিবেশনে (১৯৪২ খ্রি.) এই আন্দোলনের নিন্দা করে। লিগ নেতা মহম্মদ আলি জিন্না এই আন্দোলন থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে দূরে থাকার নির্দেশ দেন। তা সত্ত্বেও মুসলিম সমাজের বেশ কিছু মানুষ এই আন্দোলনে যােগ দেয়। লিগের বহু কর্মী গােপনে আন্দোলন পরিচালনায় সহায়তা করেন। তবে এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল আন্দোলনের সময় কোনাে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়নি বা লিগ কর্মীরা ইংরেজদের হয়ে গুপ্তচরের কাজ করেনি।
[6] সরকারি কর্মীদের ভূমিকা: ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিযুক্ত কর্মচারীরা ভারত ছাড়াে আন্দোলনে যথেষ্ট সাড়া দিয়েছিল। পুলিশকর্মীরাও গােপনে আন্দোলনকে নানাভাবে সহায়তা করেছিল।
Leave a comment