[1] গণবিদ্রোহ: ভারত ছাড়াে আন্দোলন ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গণবিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যােগ দিয়েছিল। বড়ােলাট লিনলিথগাে এই আন্দোলনের ব্যাপকতা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর এত বড়াে গণবিদ্রোহ ভারতে সংগঠিত হয়নি। ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন “১৯৪২-এর গণবিদ্রোহ প্রকৃত অর্থেই ছিল সৈনিক যুদ্ধ। সেনাপতি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কিন্তু সৈনিকদের ভূমিকা ছিল গৌরবময় কারণ তাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে শহিদ হয়েছেন।”

[2] গণযুদ্ধ: ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি আগস্ট আন্দোলনকে গণযুদ্ধ বলে স্বীকার করে নেয়। এই আন্দোলনকে ভারতের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় বলা যায়। অধ্যাপক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পলাশী থেকে পার্টিশান’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন “ফরওয়ার্ড ব্লক, এ. আই. টি. ইউ. সি., সি. এস. পি এবং এ. আই. কে. এস-এর মতাে কংগ্রেস অনুমােদিত ও সহযােগী সংগঠনগুলির পরিচালনায় গত দুই দশকের উগ্র আন্দোলনগুলি গণ অভ্যুত্থানের অনুকূল ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।” সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মতে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে এধরনের ব্যাপক বিদ্রোহ ইতিপূর্বে আর কখনও সংঘটিত হয়নি।

[3] অহিংস আন্দোলন থেকে বিচ্যুতি: গান্ধিজির অহিংস আদর্শ নীতি মেনে ভারত ছাড়াে আন্দোলন শুরু হলেও শেষপর্যন্ত এই আন্দোলন অহিংস আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়। এই পর্বে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির অধিবেশনেও স্বীকার করা হয় যে বহু স্থানেই জনতা কংগ্রেসের গৃহিত অহিংস নীতি থেকে সরে গিয়েছিল। শুধুমাত্র সাধারণ মানুষই নয়, গান্ধিবাদে সমর্থনকারী জাতীয় নেতাদের অনেকেই সহিংস পদ্মা মেনে আন্দোলন পরিচালনা করেন। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারে স্বরাষ্ট্র সমরমন্ত্রী ও জাতীয় সেনাদলের সর্বাধিনায়ক সুশীলকুমার ধাড়া নিজের আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘প্রবাহ’-তে লেখেন “মেদিনীপুর জেলায় ইংরেজ সরকারের সব কিছু মুছে পুছে দেব। তাতে যে জাতীয় হিংসা হবে বা অহিংসা থেকে বিচ্যুতি হবে তাকে গ্রাহ্য করা হবে না। যেমন—থানা পুড়িয়ে দেওয়া, রাস্তা কেটে বা পুল উড়িয়ে বা ট্রেনলাইন উঠিয়ে পথ অবরােধ করা। থানা বা সরকারি ঘাঁটিতে আগুন দিলে যদি কেউ বা পুড়ে মরে তাকে হিংসা বলে ধরার দরকার নেই।”

[4] জাতীয়তাবাদী আন্দোলন: ভারত ছাড়াে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সারা ভারতজুড়ে এক জাতীয় জাগরণ শুরু হয়। ভারত থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়নের লক্ষ্যে সকল ভারতবাসী এক জাতি এক প্রাণ হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সাধারণ কংগ্রেসকর্মী ছাড়াও ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, ছােটো ব্যবসায়ী ও কারিগরাও একত্রিত হয়ে এই আন্দোলনে সামিল হয়। এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে স্বাধীনতার জন্য আপামর ভারতবাসী সবধরনের অত্যাচার লাঞ্ছনা মেনে নিতে এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। বড়ােলাট লিনলিথগাে স্বীকার করেছিলেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের পর ইংরেজরা এর থেকে বড়াে সরকার বিরােধী কোনাে প্রতিরােধের মুখােমুখি হয়নি। জওহরলাল নেহরু বলেছেন—“নেতা নেই, সংগঠন নেই, উদ্যোগ-আয়ােজন কিছু নেই, কোনাে মন্ত্র বলা নেই, অথচ একটা অসহায় জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মপ্রচেষ্টার অন্য কোনাে পথ না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠল—এ সত্যই বিস্ময়ের ব্যাপার।”

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত জুড়ে শুরু হয় ব্রিটিশবিরােধী ভারত ছাড়াে আন্দোলন। এই আন্দোলনে নারীরা বিপুলভাবে অংশগ্রহণ করে।

[1] অংশগ্রহণের প্রকৃতি: ভারত ছাড়াে আন্দোলনে শহরের নারীরা ছাড়াও গ্রামের নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত নারীরা প্রকাশ্যে এই আন্দোলনে অংশ নেয়। পাশাপাশি বাংলার মেদিনীপুর-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক পরিবারের রমণীরাও এই আন্দোলনে যােগ দেন। আসামে ১৩ বছরের কিশােরী কনকলতা বড়ুয়া, পাঞ্জাবের গৃহবধূ ভােগেশ্বরী ফুকোননি, নাগাভূমিতে রানি গুইডালো প্রমুখ এই আন্দোলনে যােগ দিয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করেন।

[2] নেতৃত্ব: ভারত ছাড়াে আন্দোলনে নারীরা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেন। বাংলার মেদিনীপুরের তমলুকে থানা দখলে নেতৃত্ব দেন কৃষক পরিবারের বিধবা বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা। উত্তর ভারতে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন অরুণা আসফ আলি ও সুচেতা কৃপালিনী। উষা মেহতা বােম্বাইয়ে গােপন বেতারকেন্দ্র গড়ে তােলেন ও এই আন্দোলনের সপক্ষে প্রচার চালান। বাংলায় এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন লীলা রায়। অরুণা আসফ আলি বােম্বাইয়ে আগস্ট ক্রান্তি ময়দানে তেরঙ্গা পতাকা তােলেন।

[3] সংগ্রামী রূপ: নারীসমাজ এই প্রথম জাতীয় আন্দোলনে তীব্র সংগ্রামী রূপ ও মানসিকতা নিয়ে আবির্ভূত হয়। আন্দোলন চলাকালে নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে তাল মিলিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রতিরােধ গড়ে তােলে। শুধু তাই নয়, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী পুরুষদের মতাে নারীরাও সমানভাবে ব্রিটিশদের অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হয়।

[4] গুরুত্ব: 

  • প্রথমত, ভারত ছাড়াে আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ সমগ্র নারীসমাজকে স্বাধীনতা লাভের প্রশ্নে আগ্রহী করে তােলেন।

  • দ্বিতীয়ত, সমাজের প্রায় সকল স্তরের নারীদের অংশগ্রহণের ফলে এই আন্দোলন সর্ববৃহৎ গণ আন্দোলনের রূপ নেয়।

  • তৃতীয়ত, নারীদের অংশগ্রহণের জন্যই ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ধরা পড়ে, যার প্রভাব পড়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের ওপরেও।