বিশিষ্ট মনীষী প্রাবন্ধিক অন্নদাশংকর রায় ভারতে হিন্দির বহুল প্রচলন থাকা সত্ত্বেও তাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধী। এর অনেক কারণ আছে—প্রবন্ধে প্রসাধন বহুধর্মী রাষ্ট্র ভারতের ধর্ম ও ভাষা সম্বন্ধীয় মূলনীতি কী হওয়া দেশের পক্ষে হিতকর সে বিষয়ে তাঁর কিছু পর্যবেক্ষণ প্রসূত মূল্যবান অভিমত ব্যক্ত করেছেন। হিন্দি সে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে তার কিছু মুক্তি আছে কিন্তু তা কেবল ভোটদান ও দলদলির মাধ্যমে। যদি একটি ভোট ইংরেজি ভাষার দিকে পড়তো তাহলে হিন্দির সাথে ইংরেজিকে ও রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গণ্য করা হত কিন্তু তা হবার নয়। তবে ইংরেজিকে একেবারে বিদায় করে দেওয়া হয়নি। কারণ ইংরেজিকে যদি বিদায় করে দেওয়া হয়, তাহলে হিন্দি একছত্র আধিপত্য পেয়ে যাবে, এবং অপরের ওপর অধিকার বিস্তারের প্রয়াস দেখা যাবে। কিন্তু অপর ভাষা-ভাষীরা অবশ্যই নত মস্তকে সেই অধীনতা স্বীকার করে নেবে না। তামিল ভাষার ভিত্তিতে স্বতন্ত্রতার যে আন্দোলন দেখা দিয়েছে, তেমন আলোচনা সারা দেশের পক্ষে ভয়াবহ আকারে দেখা দিতে পারে। ১৯৬২ সালে লিখিত এই প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন ‘উর্দুই একমাত্র ভাষা হবে এটা তারা কোনো কালে মেনে নেবে না… উর্দু ভাষীরা যদি মানতে নারাজ হয়, তবে রাষ্ট্র দুভাগ হয়ে যাবে।” এর দশ বছরের মধ্যে ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান দুভাগ হল, স্বাধীন বাংলা দেশে নামে নতুন রাষ্ট্র হল। আশঙ্কা হয় জোর করে একমাত্র হিন্দিকেই রাষ্ট্রভাষার আসনে বসালে ভারতেরও অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

হিন্দিকে ভারতের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা বলে নিঃসন্দেহে স্বীকার করে নেওয়া চলে। সেদিক থেকে তার গুরুত্ব অবশ্য স্বীকার্য। ভারতের যে সমস্ত অঞ্চলে হিন্দি ভাষা মাতৃভাষা রূপে ব্যবহৃত হয় না, সেই সমস্ত অঞ্চলেও হিন্দির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হবার যে যোগ্যতা, তা তো হিন্দির নেই। হিন্দিতে শিক্ষণীয় বিষয় বিশেষ কিছু নেই যার লোভে কেউ হিন্দি শিখতে চাইবে। এছাড়া হিন্দির ব্যাকরণও যথেষ্ট জটিল। বলা হয় ‘মহাত্মা গান্ধিকী জয়’—এখানে ‘কা’ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হিন্দি ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে ‘জয়’ স্ত্রী-লিঙ্গ বলেই তার বিশ্লেষণ এবং ক্রিয়াকে ও স্ত্রীলিঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু ‘জয়’ স্ত্রীলিঙ্গ কেন? কারণ এর প্রতিশব্দ ফার্সী ভাষার ‘যাতে’ স্ত্রীলিঙ্গ বলে। কী যুক্তিহীন নিয়ম। হিন্দির উন্নতিবিধান প্রয়োজন, হিন্দি যদি দেবনাগরীর মোহ কাটিয়ে, রোমান, বাংলা প্রভৃতি লিপিতে হয়, যদি সে উর্দুকে আত্মসাৎ করে নিতে পারে এবং তার ব্যাকরণের জটিলতা কমিয়ে আনতে পারে, তখনই হয়তো হিন্দি সকলের আগ্রহ সঞ্চার করতে পারবে আর হয়তো তখনই লেখক তাকে সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দেবে।

ইংরেজির গুরুত্ব থাকলে বিশেষ ক্ষেত্রে ইংরেজির প্রয়োজন ফুরোতে পারে বলে লেখকের মন্তব্য। হিন্দির পূর্বে ইংরেজিই ছিল ভারতের সরকারি ভাষা। এক সময়ে দায়ে পড়ে ইংরেজিকে মেনে নিতে হলেও কালক্রমে তাতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এক্ষণে হিন্দি তৎস্থলবর্তী হওয়াতে মনে হতে পারে যে বিরোধটা বুঝি ইংরেজির সঙ্গে হিন্দির। কিন্তু আসল কথা হিন্দি বনাম ইংরেজি নিয়ে নয়। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে আপাত ব্যবস্থা হিসেবে হিন্দিকেও রাখা হয়েছে। কিন্তু এর পর যদি ইংরেজিকে বিদায় দিয়ে হিন্দিকেই এক ছত্রাধিপত্য দেওয়া হয় তবে তার বিরোধ বাঁধবে ভারতের প্রায় অবশিষ্ট সকল ভাষার সঙ্গেই। কারণ এমনই ভিন্ন ভাষাভাষীদের অনেকেই হিন্দির বিরোধীতা করে যাচ্ছে। এখনকার শাসক দল হিন্দির পক্ষপাতী হতে পারেন। পরবর্তীকালে যদি এমন কোনো দলের হাতে শাসন ক্ষমতা শায়িত যারা হিন্দি পক্ষপাতী নয় তারা অহিন্দিভাষীদের হিন্দিভাষীদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে পারেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বহুজনের জাতীয় ভাষা হিন্দি। আমরা ইংরেজের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি, সেই দোহাই দিয়ে ইংরেজি তথা বিদেশি ভাষাকে আমরা তাড়াতে চাই। আমাদের শাসনব্যবস্থা, সংবিধান, আইন-আদালত, স্কুল-কলেজ, সিনেমা-থিয়েটার, ট্রেন-বাস সবই তো বিদেশি। এসবও অভাবে। আসলে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। যুগোপযোগী চিন্তা ও ভঙ্গুর অনুকূল করে জাতীয় স্তরে আমাদের চিন্তা করতে হবে। ভারতের মতো বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় দেশে ভাষার সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আর যদি হিন্দির ব্যাপকতা ফিরে আসে তবে ইংরেজির ব্যবহার বা প্রয়োজন কমে যাবে। তবে ইংরেজির প্রয়োজন ফুরাবে বললে তা সহজে সম্ভব নয় কারণ হিন্দি হল রাষ্ট্রভাষা আর এই রাষ্ট্রভাষার সঙ্গে যদি অন্য কোনো ভাষা বিরোধীতা না করে তাহলে হিন্দির মর্যাদা বেড়ে যাবে। এবং হিন্দিই একছত্র অধিকার ভোগ করলে তা হলে ভাষার সমস্যা হতে পারে। যদি হিন্দির পাশাপাশি আমরা ইংরেজিকে রেখে দিই তাহলে হিন্দি ও ইংরেজি দৈন্দিভাবে বিরাজমান করবে এবং ভাষার কোনো সমস্যা হবে না। আর প্রয়োজনের দিক থেকে হিন্দির জনপ্রিয়তা বেশি হলে ইংরেজির প্রয়োজন কমে যাবে তবে তার ফলে আংশিক ক্ষতি হবে।

সাম্প্রতিক কালে লেখকের বক্তব্যের সঙ্গে নিজের মতামত দিতে গেলে বলতে হয়, বর্তমান যুগটা ইংরেজির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে যে-কোনো কাজের জন্য ইংরেজি না জানলে হবে না কারণ ইংরেজির এতটা ব্যাপকতা যে ইংরেজি ছাড়া অন্যভাষার কথা ভাবা যায় না। তবে হিন্দি যে একছত্র মানুষের ভাষা তা নয় কারণ হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা। আমাদের ভারতে অনেক ভাষা আছে কিন্তু হিন্দি ও ইংরেজির এত ব্যাপকতা যে বেশিরভাগ মানুষ হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় পটু। তবে বর্তমানে হিন্দি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তার ফলে ইংরেজির প্রয়োজন কিছুটা কমলেও কমতে পারে। মূলত হিন্দির ব্যাপকতা কারণ হিন্দি হল রাষ্ট্রভাষা। তবে ইংরেজের যুগ চলে গেছে, কিন্তু ইংরেজির যুগ চলে যায়নি। ইংরেজির মতো একটি সমৃদ্ধ ও প্রতিভাবান ভাষা থেকে ভারতের বিভিন্ন ভাষা প্রদীপ আপনার রসদ সংগ্রহ করে নিতে পারে। বিশ্বের বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার থেকে জ্ঞান আহরণ করতে হলে ইংরেজির দারস্থ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ইংরেজিকে বিদেশি ভাষা বলে খেদিয়ে না দিয়ে তাকে আন্তর্জাতিক ভাষা বলে বরণ করে নেওয়া উচিত। সহচর সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজিকে বরণ করে নেওয়ার মধ্যে রয়েছে একদিকে হিন্দিভাষী ও অহিন্দিভাষীদের স্বার্থের মধ্যে আপোস করার সর্বাপেক্ষা সঙ্গতিপূর্ণ উপায়। অন্যদিকে অহিন্দিভাষীদের ন্যায় বোধ চরিতার্থ হবার একটা পন্থা। তদুপরি, বিশ্বজ্ঞান ভাণ্ডারের বিপুল সম্পদের অংশীদায়িত্ব লাভের উপায়।