শ্রবণযন্ত্র এবং বাগযন্ত্রের ত্রুটির কারণে যে সকল শিশু শ্রুতি সহায়ক যন্ত্র দিয়েও শুনতে পায় না এবং নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে না, তাদের মুক ও বধির [Deaf and Dumb] বলা হয়। সমাজের বিভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজন করবার জন্য প্রয়োজন যথোপযুক্ত শিক্ষা প্রদান।
মূক ও বধির শিশুর শ্রবণ ও বাক জনিত সমস্যার কারণে অক্ষমতার শিকার। এই কারণে এদের অগ্রগতি প্রয়োজন। এই অগ্রগতির হার বর্তমান পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে যথেষ্ট কম। আমাদের দেশে মূক ও বধিরদের শিক্ষার জন্য যতটা অগ্রগতি হয়েছে তা বর্ণিত হল—
(১) সংখ্যা নির্ধারণ: সারাদেশের মূক ও বধিরদের সংখ্যা কত? প্রথমে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে হবে। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ এডুকেশন এবং কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬) এই সংক্রান্ত রিপাের্টে বলে, ভারতে ৫-১৪ বছর বয়স্ক শিশুদের মধ্যে ১ কোটি ২৫ লক্ষ বধিরতার শিকার। ২০ লক্ষের থেকে বেশি শিশু মূক ও বধির।
(২) বিদ্যালয়ের সংখ্যা : মুক ও বধিরদের বিদ্যালয়ের সংখ্যা স্বাধীনতার আগে ছিল ৪টি। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তা হয় ৩৫টি, ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ১৮০টি এবং RCI* তথ্যানুযায়ী বর্তমানে তা হয় ৪৭৮টি, পশ্চিমবঙ্গে এইরূপ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৫টি।
(৩) বৃত্তিমূলক কার্যাবলী : ভারতে মূক ও বধিরদের পাঠক্রমে ভারত সরকারের প্রচেষ্টায় বৃত্তিমূলক কার্যাবলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
(৪) বেসরকারি উদ্যোগ : এদেশের ধর্মীয় সংগঠনগুলি মূক ও বধিরদের সামাজিক উন্নতিসাধনের জন্য এগিয়ে আসে এবং তাদের উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
(৫) পাঠক্রম : মূক ও বধিরদের পাঠক্রমের মধ্যে যে ক্ষেত্রটিতে জোর দেওয়া হয়েছে সেগুলি হল বিভিন্ন বৃত্তিমূলক কার্যাবলি যেমন— ছেলেদের জন্য সামাজিক বিজ্ঞান, বই বাঁধানো, কামারের কাজ, কাঠের কাজ, দর্জির কাজ ইত্যাদি। মেয়েদের জন্য ব্যাগ বানানো, পুতুল বানানো, ঝুড়ি তৈরি, সেলাই ইত্যাদি। এ ছাড়া অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
(৬) সরকারি উদ্যোগ : ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সংবিধান-সংশোধন ১৫(১) অনুচ্ছেদে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ সাংবিধানিক ব্যবস্থা করা হয়। ভারতে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাইতে ও ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় মূক ও বধির শিশুদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বর্তমানে ভারতে প্রত্যেক রাজ্যে মূক ও বধিরদের জন্য একটি করে সরকারি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়। প্রতিবন্ধীদের সরকারি নিয়ােগের জন্য C ও D গ্রুপে ১% আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে।
(৭) কলকাতায় মূক ও বধির বিদ্যালয় : Calcutta Deaf & Dumb School হল কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ মূক ও বধিরদের জন্য প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে Preparatory I, II, III, IV মোট চারটি শ্রেণি রয়েছে প্রাথমিক বিভাগে, যেখানে ৪-১২ বছরের মুক ও বধির শিশুরা পড়াশােনা করে। এই প্রাথমিক বিভাগের পর রয়েছে Junior, যা ২ বছর ধরে পড়ানাে হয় এবং Junior III ও Senior I, II, III, যা চার বছর ধরে পড়ানো হয়।
(৮) শিক্ষক-প্রশিক্ষণ : মূক ও বধির শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণের দরকার। তাই ৬টি শিক্ষক-শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। যথাক্রমে কলকাতা, মাদ্রাজ, দিল্লি, লখনউ, আহমেদাবাদ এবং অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভৃতি। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৮৫-৯০) গঠিত হয় The National Institute for Rehabilitation Training & Research (NIRTR)।
(৯) বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র : ভারত সরকার বয়স্ক মূক ও বধিরদের জন্য হায়দরাবাদে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছে।
(১০) আবাসিক বিদ্যালয় : সরকারি বিদ্যালয় যেগুলি ভারত সরকার মূক ও বধিরদের জন্য তৈরি করেছে সেগুলো এখন আবাসিক করা হয়েছে এবং তার সঙ্গে বৃত্তিদানের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
আমাদের সকলকে ভাবতে হবে যে এই শিশুরা সমাজ-বহির্ভূত নয়। তাই সরকারকেও আরও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে আসতে হবে।
Leave a comment