সূচনা: ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা, প্রসার ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী।

[1] সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগেই সেনাবাহিনী গঠনে তৎপর হয়। ব্রিটিশ ক্যাপটেন স্ট্রিঞ্জার লরেন্স ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয়দের নিয়ে একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্রিটেনের বাড়তি রাজকীয় নৌবাহিনী এদেশে নিয়ে আসেন। পলাশির যুদ্ধের (১৭৫৭ খ্রি.) পর ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভও ব্রিটেন থেকে নৌবাহিনী ভারতে এনে সেনাদলের শক্তিবৃদ্ধি করেন।

[2] ইউরােপীয়দের প্রাধান্য: কর্নওয়ালিশের সময় থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়ােগ বন্ধ ছিল। সেনাবাহিনীর উচ্চপদগুলিতে সর্বদা ইউরােপীয় অফিসাররা নিযুক্ত হতেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে সেনাবিভাগে মাসিক ৩০০ টাকার বেশি বেতন পেত, এমন ভারতীয় সেনার সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ জন। কোম্পানির ডিরেক্টররা পৃষ্ঠপােষকতার মাধ্যমে অধিকাংশ ইউরােপীয় অফিসারকে নিয়ােগ করতেন।

[3] নিয়ােগে পছন্দ: ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেনাদলে সৈন্যসংখ্যাও বাড়তে থাকে। ফলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরে ভারতীয়রা নিযুক্ত হওয়ার সুযােগ পায়। সেনাবাহিনীর নিয়ােগে অযােধ্যার উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ও ধনী রাজপুত কৃষক, বিহারের ভূমিহার ব্রাক্ষ্মণ ও রাজপুতদের অধিক সংখ্যায় নিয়ােগ করা হত। পরবর্তীকালে কিছু পাহাড়ী উপজাতির মানুষকে নিয়ােগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বাহিনীতে নেপালের গােরখাদের নিয়ােগ শুরু হয়।

[4] সেনাবাহিনীর আয়তন বৃদ্ধি: ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর আয়তন বাড়তে থাকে। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতে কোম্পানির সিপাহিদের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার। এই সংখ্যা বেড়ে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ১ লক্ষ ৫৪ হাজার এবং ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ২ লক্ষ ১৪ হাজার হয়।

[5] জাতপাতের বিষয়: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী সিপাহি জাতিগুলিকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ইংরেজদের অনুগত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠান, পাঞ্জাবের জাঠ, উত্তর ভারতের রাজপুত, নেপালের গােরখা প্রভৃতি জাতিগুলিকে ‘যুদ্ধােপযােগী জাতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে সেনাবাহিনীতে নিয়ােগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। পিল কমিশন-এর (১৮৫৮ খ্রি.) সুপারিশ অনুসারে, বিভিন্ন জাতির মানুষের সমন্বয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠন করা হয়।

[6] বেতন ও ভাতা: কোম্পানির সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত ভারতীয় সেনারা নিয়মিত বেতন, অবসরকালীন ভাতা, অন্যান্য ভাতা, পুনর্বাসন ও অন্যান্য কিছু সুবিধা পেত।তবে ১৮২০-র দশকে সেনাদের বিভিন্ন আর্থিক ও সামাজিক সুবিধা কমানাে হলে তারা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।

[7] গুরুত্ব: ঐতিহাসিক ড. বিপানচন্দ্র তারা গ্রন্থ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বলে উল্লেখ করেছেন। পার্সিভ্যাল স্পিয়ার লিখেছেন, “সিভিল সার্ভিস গভর্নরের দক্ষিণ হস্ত হলে সেনাবাহিনী ছিল তাঁর বাম হস্ত।” 

  • [i] সেনাবাহিনীর শক্তির দ্বারা ভারতে কোম্পানির একচ্ছত্র রাজনৈতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। 

  • [ii] সেনাবাহিনী ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক সম্প্রসারণে সহায়তা করে। ফলে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ, অর্থাৎ মাত্র একশাে বছরের মধ্যে ইংরেজ কোম্পানি ভারত জয় সম্পন্ন করে। 

  • [iii] ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্ভাব্য বিপদ বা সমস্যা থেকে কোম্পানির সাম্রাজ্যকে রক্ষা করত সেনাবাহিনী। 

  • [iv] সেনারা সরকারবিরােধী কৃষক বিদ্রোহ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, শ্রমিক ধর্মঘট প্রভৃতি নিমর্মভাবে দমন করত। 

  • [v] বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরােধে সেনাবাহিনীর বিশেষ গুরুত্ব ছিল।

উপসংহার: ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা রক্ষার লক্ষ্যেই সেনাবাহিনীকে গড়ে তােলা হয়েছিল। এক্ষেত্রে ভারতীয়দের স্বার্থ ও নিরাপত্তার বিষয়টি অবহেলিত ছিল।