ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক মানুষ:

সাধারণভাবে মানব কঙ্কালের অবশেষ বা জীলাশা এবং হাতিয়ারের কারিগরি বৈশিষ্ট্য থেকে ভারত উপমহাদেশে এবং ভারতবর্ষে আধুনিক মানুষের আবির্ভাবের একটা ইঙ্গিত পাওয়া সম্ভব। এই পরিযায়ী আদি-মানবের দল আফ্রিকার দক্ষিণ অংশ থেকে যাত্রা শুরু করে প্রায় ৯০ হাজর বছর আগে পশ্চিম এশিয়ায় উপস্থিত হয়েছিল। এশিয়া মহাদেশে ঘুরতে ঘুরতে তারা আনুমানিক ৫০-৬০ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ করেছিল। আফ্রিকা থেকে তাদের এই যাত্রাপথের মাঝে ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থান। তাই আশা করা যায় যে, ৬০ হাজার বছরের কিছু আগেই আদি-মানব গোষ্ঠী ভারত-উপমহাদেশে পৌঁছেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হোমোসাপিয়েন্স প্রজাতির মানব গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ভারতে দেখা যায় নি। প্রাচীনতম যে মানব-জীবাশ্ম এই উপমহাদেশে পাওয়া গেছে, তা শ্রীলঙ্কার ফানহিয়েন গুহা থেকে। এই শিলীভূত কঙ্কালটিকে ‘হোমো-সাপিয়েন্স সাপিয়েন্স’ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত বলে সনাক্ত করা হয়েছে। আদি-মানবের পরিযানের সময় ভারতবর্ষ থেকে শ্রীলঙ্কার ভূমিতে তাদের যেতে আনুমানিক ২০ হাজার বছর লেগেছিল বলে অনুমান। কারণ ফা-হিয়েন গুহার জীবাশ্মটি আনুমানিক ৩০-৩৫ হাজার বছর আগেকার বলেই নৃতাত্ত্বিকদের বিশ্বাস। সেক্ষেত্রে ৫০-৬০ হাজার বছর আগে ভারতভূমিতে আদিমানব গোষ্ঠীর হোমো-সাপিয়েন্স সাপিয়েন্স প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছিল, ধরে নেওয়া যায়। অবশ্য শ্রীলঙ্কার অন্যক্ষেত্রে যেমন বাটাডোমরা লেনা গুহাতে ২৮-২৯ হাজার বছরের প্রাচীন মানব কঙ্কালের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পরিযানকালে আধুনিক মানুষের যে দল ভারতের সীমান্তদেশে পৌঁছেছিল তারা সম্ভবত পিঠওয়ালা ছুরি নির্মাণ (পাথরের) প্রযুক্তির অধিকারী ছিল না। কারণ পাকিস্তানের সোয়ান উপত্যকায় মধ্য-প্রাচীন প্রস্তরযুগের সংস্কৃতির যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে পিঠওয়ালা ছুরির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে সমকালীন সংস্কৃতির হাতিয়ার ও অন্যান্য সামগ্রীর ধ্বংসাবশের বিশ্লেষণ করে ড. ইরফান হাবিব মধ্যশ্মীয় সংস্কৃতির যুগে আদিম মানব সমাজে ‘শ্রম বিভাজন’ ব্যবস্থার অস্তিত্বের আভাস লক্ষ্য করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, সেকালে আদিম মানবের একটি দল যখন বনে-জঙ্গলে শিকারে ব্যস্ত থাকত, তখন অন্য দল হয়ত উন্নত হাতিয়ার তৈরীর জন্য নদীগর্ভ বা খাদান থেকে উন্নতমানের পাথর সংগ্রহ করে হাতিয়ার নির্মাণের কাজে নিয়োজিত থাকত। অর্থাৎ শ্রম বিভাজন ব্যবস্থার বা বিনিময় প্রথার একটা আদিম ও অতি সূক্ষ্ম সম্ভাবনা সেকালেই সূচিত হয়েছিল। অন্যদিকে ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ১১ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ শত বছর আগেকার কিছু আদিম শিল্প নিদর্শন পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে পিঠওয়ালা ছুরির ফলাও আছে। অনুমিত হয় যে, একই সময়কালে মায়ানমারের দিক থেকেও ভারতবর্ষে আদিম মানবের পরিমান ঘটেছিল।

আধুনিক মানুষ যখন ভারতে পরিযায়ীরূপে প্রবেশ করে, তখন স্থানীয় বসবাসকারী প্রায় মানব প্রজাতিদের সাথে তাদের সম্পর্কের স্বরূপ কেমন ছিল? এই প্রসঙ্গে নিয়ানডারথাল ও হোমো ইরেকটাস প্রজাতির সাথে আধুনিক আদি মানবগোষ্ঠীর সংঘাত বা সমন্বয়ের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান ভারতের সীমান্তবর্তী কোন কোন দেশে নিয়ানডারথাল প্রজাতির অস্তিত্বের আভাস পাওয়া গেছে। পাকিস্তানের ‘সাংঘাও’ গুহা, আফগানিস্তানের ‘দারা-এ-কুর’ অঞ্চলে এমন কিছু হাতিয়ারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যা নির্মাণ কৌশল কেবল নিয়ানডারথাল প্রজাতির আয়ত্বাধীন ছিল। এই সকল অঞ্চলের সন্নিকটে উজবেকিস্তান থেকে প্রাপ্ত একটি মস্তিষ্কের অংশকে নিয়ানডারথাল প্রজাতির বলেই নৃতাত্ত্বিকদের অনুমান। মহারাষ্ট্রের মুলাবাঁধে প্রায় ৩১ হাজার বছরের প্রাচীন এবং গুজরাটের বরদিয়াতে প্রায় পনেরশো বছরের পুরানো কিছু হাতিয়ার পাওয়া গেছে, যেগুলি নিয়ানডারথালদের আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত (লেভালোইন মাউস্টেরিয়ান) বলে প্রমাণিত। অর্থাৎ ভারতে পরিযায়ী আধুনিক মানুষের দল হয় আদি আদিবাসী নিয়ানভারথালদের পরাজিত ও বিতাড়িত করে এলাকা দখল করেছিল। অথবা ঐ আদিম প্রজাতির সাথে হোমোসাপিয়েন্স সাপিয়েন্স প্রজাতির সঙ্গে অন্তপ্রজনন ঘটেছিল। পরিযানের সময়কালের প্রেক্ষিতে অনুরূপ ঘটনা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে হোমো ইরেকটাস গোষ্ঠীর সাথে আধুনিক পরিযায়ী মানবগোষ্ঠীর মধ্যে ঘটে থাকতে পারে। ড. হাবিবের মতে, পূর্ব এশিয়ার ‘মঙ্গোলীয়’ এবং অস্ট্রেলিয়ার ‘অস্ট্রোলয়েড’ গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে হোমো ইরেকটাস প্রজাতির কিছু কিছু অপ্রধান শারীরিক মিল আছে। তবে এই অন্তপ্রজননকালে নিয়ানডারথাল বা হোমো ইরেকটাসদের সংখ্যা এতটাই নগণ্য ছিল যে, বিপুল সংখ্যক হোমো সাপিয়েন্স প্রজাতির ওপর তাদের জিনগত প্রভাব খুব কম ছিল।

ভারতে প্রস্তরযুগের সংস্কৃতি :

আদি-আধুনিক মানব প্রজাতির সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের কাজে মূলত তাদের ব্যবহৃত ও আবিষ্কৃত হাতিয়ারগুলির ক্রম-রূপান্তরে বিষয়টিকে বিবেচনা করা হয়। আদি মানব পাথর, হাড় বা কাঠের হাতিয়ার ব্যবহার করত। তবে হাড়ের হাতিয়ারের বিশেষ নিদর্শন পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে সহজে ক্ষয়শীল কাঠের অস্তিত্ব না থাকাই স্বাভাবিক। তাই মূলত আদিম সভ্যতায় ব্যবহৃত প্রস্তর নির্মিত হাতিয়ারগুলি বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতেরা ভারতসহ বিশ্বের আদিমতম মানব-সংস্কৃতির স্বরূপ উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া পাথরের হাতিয়ারগুলি ছিল তুলনামূলকভাবে অধিক কার্যকরী। তাই আদিপর্বে পাথরের হাতিয়ার ছিল আত্মরক্ষা ও শিকারের প্রধান অস্ত্র। প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রস্তর নির্মিত হাতিয়ারের প্রাধান্যের প্রেক্ষিতে আদি-মানবসভ্যতাকে প্রস্তরযুগের সংস্কৃতি (বা সভ্যতা) নামে আখ্যায়িত করেছেন। তবে গোটা প্রস্তরযুগে মানবসংস্কৃতি গতিহীন বা পরিবর্তনহীন ছিল না। তাই হাতিয়ার নির্মাণের কৌশলগত পরিবর্তনের ভিত্তিতে প্রস্তরযুগকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করেছেন— (১) পুরা (প্রাচীন) প্রস্তরযুগ বা প্রত্নাশ্মীয় যুগ (Palaeolithic Age); (২) মধ্যপ্রস্তর বা মধ্যাশ্মীয় (Masolithic) যুগ। এটিকে ক্ষুদ্রাশ্মীয় (Microlithic) আয়ুধের যুগও বলা হয়; (৩) নব্যপ্রস্তর বা নবাশ্মীয় (Neolithic) যুগ। ভি. গর্ডন চাইল্ড আদিমপর্বে মানুষের খাদ্য সংগ্রহের প্রকৃতির ভিত্তিতে প্রাচীন প্রস্তরযুগ ও মধ্য প্রস্তরযুগের প্রথমভাগকে ‘খাদ্য সংগ্রহকারীদের যুগ’ বলে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী পর্বটি ‘খাদ্য উৎপাদনকারী পর্ব’ রূপে চিহ্নিত হয়েছে। এইভাবে প্রস্তরযুগের দীর্ঘ সময়কালে আদি মানব খাদ্য সংগ্রহকারী থেকে ক্রমে খাদ্য উৎপাদনকারী মানুষে উত্তীর্ণ হয়েছে।

ঠিক কত বছর আগে পুরা প্রস্তরযুগের সূচনা হয়েছিল, তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এই যুগের সূচনা যিশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে ঘটেছিল বলে অনুমিত হয়। তবে ভারতে এর সূচনা হয়েছে বহু পরে। খুব সম্ভবত ভারতে প্রিস্টোসিন যুগে পুরা প্রস্তর সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে মহারাষ্ট্রের ‘বোরি’ থেকে প্রাপ্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে ভারতে পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতির সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর ভিত্তিতে নিম্ন-পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতি খ্রিষ্টপূর্ব ১০ লক্ষ বছর থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার বছর আগে; মধ্য পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতি ১ লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার বছর আগে এবং উচ্চ-পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতি ৩৫ হাজার থেকে ১০ হাজার বছর পূর্বে বিকাশ লাভ করেছিল বলে মনে করা হয়। পরবর্তীকালে গোদাবরী ও কৃয়া উপত্যকায় যথাক্রমে নেভাসা ও ইয়েদুরওয়াড়িতে প্রাপ্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে নিম্ন-পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতির সূচনাকালে আনুমানিক ৪ লক্ষ বছর আগে শুরু হয়েছিল মনে করা হয়।