ভারতীয় উপমহাদেশে নব্যপ্রস্তর যুগ:

মানব সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসে প্রস্তরযুগের তৃতীয় পর্বটি ‘নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতি’ বা নবাশ্মীয় যুগ (Neolothic age) নামে খ্যাত। প্রাচীনপ্রস্তরযুগ ও মধ্যপ্রস্তরযুগ অতিক্রম করে মানবজাতি তৃতীয় পর্যায় বা নবপ্রস্তর সংস্কৃতির যুগে প্রবেশ করে। অতীতের মতই যুগ বিভাজনের কাজে এ-ক্ষেত্রেও হাতিয়ারের প্রযুক্তিগত পরিবর্তন বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। পাথরের হাতিয়ার তৈরীর কৃৎকৌশল অবশ্যই এ-যুগে আগের তুলনায় উন্নততর হয়েছিল। অবশ্য মধ্যপ্রস্তরযুগের ক্ষুদ্রাশ্মীয় হাতিয়ারের ব্যবহার এ যুগেও প্রচলিত ছিল। কিন্তু জীবনযাপন পদ্ধতির ক্ষেত্রে নব্যপ্রস্তরযুগে যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছিল, তা বিস্ময়কর। এ-যুগে জীবনযাপন পদ্ধতির রূপান্তরের পাশাপাশি উৎপাদনসম্পর্কের পরিবর্তনগুলিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বপ্রেক্ষাপটে নব্যপ্রস্তরযুগের করণকৌশল প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১০, ০০০ থেকে ৯,০০০ অব্দে সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে। ভারত উপমহাদেশে এই পর্বের আবির্ভাব ঘটেছে অনেক পরে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৭,৫০০ অব্দে। কার্বন পরীক্ষা পদ্ধতির নিরিখে আফগানিস্তানের ঘর-ই-আস্থা বা আখ-কুপরাক-এর দ্বিতীয় পর্যায়ে এই নিদর্শনের অস্তিত্ব দেখা যায়। এখান থেকেই নব্যপ্রস্তরযুগীয় করণকৌশল উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে তাও সর্বত্র সমানতালে বা একইসময়ে নয়। বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত বালুচিস্তানের মেহেরগড় প্রত্নক্ষেত্রে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির প্রথম পর্যায়টি খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ অব্দে সূচিত হয়েছিল বলে মনে হয়। অন্যদিকে দক্ষিণভারতের এবং পূর্ব ভারতের কোন কোন অঞ্চলে এমন কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে যেগুলি ১,০০০ খ্রিষ্টপূর্বকালের আগের নয়। অর্থাৎ কালের বিচারে এগুলি প্রায় হরপ্পা সংস্কৃতির সমকালীন। বহু অঞ্চলে তাম্র-প্রস্তর সংস্কৃতির সাথে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির সহাবস্থান দেখা যায়। কৃষ্ণা ও কাবেরী উপত্যকায় মিশ্র সংস্কৃতি (তাম্রপ্রস্তর)তে নব্যপ্রস্তর উপাদানের প্রাধান্য দেখা যায়।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নব্যপ্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির অস্তিত্বের আভাস মেলে। এদের মধ্যে সর্বাধিক প্রাচীন ও সমৃদ্ধ কেন্দ্রটি হল বোলান গিরিপথের সন্নিকটে মেহেরগড়। এছাড়া কাশ্মীর উপত্যকায় বুরঝহোম, মাদ্রাজের তিরুনেলবেলি জেলা, গোদাবরী নদীর নিম্নতর অববাহিকা অঞ্চল, মহারাষ্ট্রে খণ্ডিবালি, নর্মদা ও মহি নদীর উপত্যকা, মহীশূরের ব্রত্নগিরি এবং বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের নানাস্থানে নব্যপ্রস্তরযুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে। বিহারের হাজারিবাগ, পাটনা, সিংভূম অঞ্চলে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির বহু নিদর্শন পাওয়া যায়। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গে-র বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর, নদীয়া ও দার্জিলিং জেলায়, আসামের গারো ও নাগা পাহাড়, উত্তরপ্রদেশের হামিরপুর, এলাহাবাদ ও বান্দা জেলায়, মধ্যপ্রদেশের মরিলা, বুলুতরাই (সাগর জেলা); অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর, রায়চুর, ওয়ারাংগাল জেলায় ; মহীশূরের ব্যাঙ্গালোর ও চিতলদ্রুগ জেলায়, তামিলনাড়ুর অনন্তপুর, সালেম, তাঞ্জোর, বেলারি, উত্তর আর্কট জেলায় নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া গেছে।

নবপ্রস্তরযুগের হাতিয়ার নির্মাণের প্রধান উপাদান ছিল ঘন রঙের আগ্নেয় শিলাখণ্ড। প্রস্তরযুগের প্রথমদিকের হাতিয়ারগুলি পাথর দিয়ে পাথর ভেঙে তৈরী করা হত। ফলে সেগুলি হত অসম ও অমসৃণ। এখন পাথরের ওপর পাথর ঘষে হাতিয়ার তৈরীর প্রযুক্তি মানুষ শিখে নেয়। ফলে নব্যপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ারগুলি গোলাকার, মসৃণ, সুসম আকারবিশিষ্ট এবং অধিক কার্যকরী হতে পারে। এইসকল আয়ুধের (হাতিয়ার) মধ্যে আছে কুঠার, বাটালি, পাথরের লাঠি, হাতিয়ার মসৃণ করার পাথর, হাতুড়ির মাথা, তীরের ফলা ইত্যাদি। তীক্ষ্ণ, ধারালো, মসৃণ হওয়ার কারণে এ-যুগের হাতিয়ারগুলি পূর্ববর্তী পুরাপ্রস্তর ও মধ্যপ্রস্তরযুগের হাতিয়ারের তুলনায় অনেক বেশী কার্যকরী হয়ে ওঠে। নব্যপ্রস্তর ( Neolithic = Neo-নব্য lithic প্রস্তর) যুগীয় হাতিয়ার আদিম মানব সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এ-যুগেই মানুষ প্রথম ভূমিকর্ষণ, পশুপালন, বয়ন ও স্থায়ী বসতি স্থাপন করে সমাজ তৈরীর পটভূমি গড়ে দেয়।

নবপ্রস্তর সংস্কৃতির ভিত্তি ছিল ভূমিকর্ষণ। এ-যুগেই মানুষ পশুশিকার, খাদ্য সংগ্রহবৃত্তির পর্ব অতিক্রম করে পুরোপুরি খাদ্য উৎপাদকের ভূমিকা নিতে সক্ষম হয়। ভূমি কর্ষণের সূচনা কীভাবে হয়েছিল, তা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। সম্ভবত এই কাজে প্রাথমিক উদ্যোগ এসেছিল মেয়েদের কাছ থেকে। পুরাপ্রস্তরযুগে মানুষ বন থেকে বনাত্তরে পরিযান করে পশুশিকার বা ফল সংগ্রহ করত। তবে তুষারপাতের তীব্রতার কারণে বহু দূরে যেতে পারত না। মধ্যাশ্মীয় যুগে তুষারপাত কমে গেলে মানুষ শিকারের উদ্দেশ্যে আরো দূরে যেতে শুরু করে। ফলে পুরুষরা তাদের গুহাবাসে ফিরত অনেকটা সময় পরে। তখন মেয়েরা ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য গাছের ফল বা বন্য শস্যদানা ভক্ষণ করত। এই সময় তাদের ভাবনায় শস্য উৎপাদনের কল্পনা দানা বাঁধতে থাকে। সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া তাদের জানাই ছিল। এখন তারা ভূমিকে নিজের সমতুল্য কল্পনা করে নেয় এবং পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ একখণ্ড পাথর দিয়ে ভূমিকর্ষণ করে শস্য দানা ফেলে দেয়। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে আমাদের ধর্মশাস্ত্রে নারীকে ‘ক্ষেত্র’ বা ‘ভূমি’ বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। প্রাইলাস্কি (Przyluski) তাঁর ‘Non-Aryan Loanss in Indo-Aryan’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, ‘লিঙ্গ’, ‘লাল’ ও ‘লাঙ্গল’ তিনটি শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে সৃষ্টি। পরবর্তী স্তরে পুরুষও নারীর সহযোগী হিসেবে কৃষি কাজে লিপ্ত হয়।

কৃষি উৎপাদন নব্যযুগের মানবসমাজে একাধিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। ইতিপূর্বে ফল সংগ্রহকারী বা পশু শিকারী মানুষের পক্ষে একস্থানে স্থায়ীভাবে বাস করা সম্ভব হত না। খাদ্য সংগ্রহের জন্য তাদের যাযাবরের মত ঘুরে বেড়াতে হত। এখন বীজবপন থেকে পাকা ফসল ঘরে তোলার জন্য একই স্থানে অনেকটা সময়কাল থাকার প্রয়োজন হয়। তাছাড়া প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করতে সক্ষম মানুষ অতীতের অনিশ্চিত খাদ্য সংগ্রহের বৃত্তি থেকে সরে আসতে চেষ্টা করে। কৃষিকাজের প্রয়োজনে তারা ভ্রাম্যমান জীবনধারা বর্জন করে ক্রমে স্থায়ী বসতি স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এইভাবে গড়ে ওঠে ‘গ্রামসমাজ’। কৃষিকাজ সম্প্রসারিত হলে মানুষ গবাদি পশুর গৃহপালনের উপযোগী দৃঢ়তর একটা ভিত্তি পায়। শস্য কেটে নেওয়ার পর পরিত্যক্ত জমিতে গরু-মোষের প্রয়োজনীয় খাদ্য (জাব) পাওয়া যেত। ফলে গৃহপালিত গবাদিপশুর বৈচিত্র্য ও সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আবার গবাদি পশু থেকে দুধ ও মাংস দুটোই পাওয়া গেলে শিকারের ওপর নির্ভরতা কমতে থাকে। ক্রমে কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় পাথরের লাঙ্গল, কাস্তে, পেষাই ইত্যাদির উদ্ভাবন ঘটে।

মাটি খননকারী পাথরের দণ্ড (আদি কোদাল) এবং তার সূঁচালো ডগা দিয়ে কৃষিক্ষেত্রের মাটি ঝুরঝুরে করার ফলে কৃষি-উৎপাদন দ্রুত বাড়ানো সম্ভব হয়। এইভাবে গ্রামে একটি কৃষিজীবি গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। নব্যপ্রস্তরযুগে এইভাবে মানুষের বৃত্তি পরিবর্তন একই ধারায় চলেনি। পূর্ববর্তী দুটি পর্বে (পুরা ও মধ্যপ্রস্তর) শিকার ও পশুপালনের জীবিকা মানবগোষ্ঠীকে যেমন একস্থানে বেশিদিন থাকতে দিত না, তেমনি খাদ্য উদ্বৃত্ত হওয়ার বিষয়টিও ছিল না। ফলমূল বা শিকার করা পশুর মাংস বেশিদিন রাখা যেত না। স্বভাবতই প্রয়োজনমত খাদ্য সংগ্রহ করা কিংবা সংগৃহীত খাদ্য দ্রুত শেষ করে ফেলার প্রয়োজন হত। সেক্ষেত্রে গোষ্ঠীর সবাই সংগৃহীত খাদ্যের ভাগ পেত। ফলে উদ্বৃত্ত সমাজ বণ্টনজাতীয় সমস্যা বিশেষ ছিল না। গোষ্ঠীর সর্দার কিংবা পুরোহিত ওঝা প্রমুখ কিছু বিশেষ বা অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও, তা সামাজিক বৈষম্য তৈরী করত না। কিন্তু একইস্থানে বসত গড়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এখন মাটির দেওয়ালবিশিষ্ট কুটীরের মধ্যে উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য মজুত করে রাখা সম্ভব হয়। কৃষি উৎপাদনের সাথে যুক্ত নয় এমন সকল শ্রেণীর মানুষ যেমন কারিগর, প্রশাসক, বণিক প্রমুখের ভরণপোষন উদ্বৃত্ত কৃষি-উৎপাদন থেকে সম্ভব হয়। কিন্তু এই প্রভাবশালী সামাজিক গোষ্ঠী তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং বুদ্ধির জোরে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নিতে সক্ষম হয়। এইভাবে সমাজে ধনবৈষম্য ও শোষন প্রবণতার জন্ম হয়। পূর্বেকার সামাজিক সাম্য ভেঙ্গে শোষক ও শোষিত জনগোষ্ঠীর উদ্ভব সমাজজীবনে জটিলতা নিয়ে আসে। উদ্বৃত্তের দখলদারীর ভিত্তিতে সমাজে সৃষ্টি হয় ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রেণী, রাষ্ট্র ইত্যাদি। নব্যপ্রস্তরযুগে মানবজীবনে পরিবর্তনের এই ব্যাপকতা ও গভীরতার প্রেক্ষিতে পুরাতাত্ত্বিক ডি. গর্ডন চাইল্ড নব্যপ্রস্তরযুগের পরিবর্তনকে ‘নব্যপ্রস্তর বিপ্লব’ (neolithic revolution) বলেছেন।

ভারতে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির প্রাচীনতম কেন্দ্র মেহেরগড়ে খননকার্যে প্রাপ্ত প্রত্নাবশেষ থেকে এই সংস্কৃতিতে শিল্পক্ষেত্রে অভূতপূর্ব রূপান্তরের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এই যুগে মৃৎপাত্র নির্মাণ শিল্পে বিশেষ উৎকর্ষ অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। প্রথমদিকের মৃৎপাত্রগুলি খুব শৌখিন বা সুদৃশ্য ছিল না। ক্রমে কারিগরি ক্ষেত্রে বিস্ময়সৃষ্টিকারী কুমোরের চাকা আবিষ্কার সম্ভব হলে, মৃৎপাত্র নির্মাণশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। কুমোরের চাকা ঘুরিয়ে কাদামাটির মণ্ড থেকে সুদৃশ্য ও সৌখিন মৃৎপাত্র তৈরী করা সম্ভব হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে সৌখিন মৃৎপাত্রের পাশাপাশি মাটির ছোট ছোট মূর্তি তৈরীর প্রয়াসও দেখা যায়। পরবর্তী এক শতকের মধ্যে (খ্রিঃপূঃ ৪০০০ অব্দ) রক্তিম (পীতবর্ণ) বা কৃষ্ণবর্ণের মৃৎপাত্র নির্মাণ করা সম্ভব হয়। এগুলির গায়ে জ্যামিতিক নক্শা পাত্রগুলির সৌন্দর্যায়নের কাজ করেছিল। রানা খুনডাই থেকে একটি স্বতন্ত্র্য্যধরনের মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। এটি লালচে-হলুদ বর্ণযুক্ত এবং কালো রঙের জ্যামিতিক রেখায় কিছু ষাঁড়ের প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়েছে। মৃৎপাত্র ছাড়াও পাথরের বাটি, পুঁতির মালা, ঝিনুকের অলংকার নব্যপ্রস্তরযুগের শিল্পকলার উৎকর্ষ বৃদ্ধি করেছিল।

নব্যপ্রস্তরযুগের মানুষ লোকাতীত জীবনে বিশ্বাস করত। মেহেরগড়ে প্রাপ্ত সমাধিক্ষেত্রগুলির অবশেষ থেকে এমন ধারণা দৃঢ়তর হয়। মধ্যপ্রস্তরযুগের মতই সমাধিতে শায়িত দেহ বা দেহযুগলের পাশে জীবনধারণের উপযোগী বিভিন্ন উপকরণ রাখা হত। তবে মৃতদেহগুলি লাল রঙের একটা প্রলেপ দেওয়া হত, যা পূর্ববর্তী যুগগুলিতে ছিল না। বেশিরভাগ কবরে দেখা যায় মৃতদেহগুলির পা ভাঁজ করা এবং পাশ ফিরিয়ে শায়িত। সমাধির ভেতরে রাখা সামগ্রীর মধ্যে ছিল হাতিয়ার, হত্যা করা পশুর দেহাংশ। একটি সমাধিক্ষেত্রে মৃতদেহের পাশে একটি মোরগের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। সম্ভবত কোন অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশ্যে এগুলি উৎসর্গ করা হত। এছাড়া থাকত নানারকম দামি অলংকার ও পাথর। নীলকান্তমণি, নীলা পাথর, কর্ণেলিয়াম ইত্যাদি মহার্ঘ পাথর কোন কোন সমাধিতে দেখা গেছে। উল্লেখ্য যে, মেহেরগড়ের সন্নিহিত কোন স্থানে এ ধরনের দামি পাথর দেখা যায়নি। অনুমিত হয় যে, বাণিজ্যপথে দূর দেশ থেকে এগুলি আনা হত। তাছাড়া সকল সমাধিতে এমন মহার্ঘ পাথর ছিল না। এই বিষয়টিকে তৎকালীন সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্যের দৃষ্টান্ত বলে মনে করা হয়।

নব্যপ্রস্তরযুগের মানুষ মৃত ব্যক্তির সমাধির ওপর একটি লম্বা পাথর খাড়াখাড়িভাবে প্রোথিত করত। এমন ঋজুভাবে প্রোথিত প্রস্তর ফলক পশ্চিমবঙ্গের নানাস্থানে পাওয়া গেছে। নানা অঞ্চলে এগুলি এখনও নানা নামে অভিহিত হয়। যেমন হুগলি জেলাতে এগুলিকে ‘বীরকাড়’ বলা হয়। নীলগিরি পাহাড়ের অধিবাসী কুড়ুম্বা উপজাতির মানুষ এ-ধরনের প্রস্তর ফলককে ‘বীরকল্প’ বলেন। ছোটনাগপুরের খেড়িয়া উপজাতির মধ্যেও এমন স্মৃতিফলক প্রোথিত করার রেওয়াজ আছে। সাধারণভাবে এগুলিকে বীরপুরুষের স্মৃতিফলক বলে মনে করা হয়। ড. অতুল সুরের মতে, বাংলাদেশে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পর গ্রামের বাইরে যে ‘বৃষকাষ্ঠ’ প্রোথিত করা হয়, সেগুলিকে নব্যপ্রস্তরযুগীর প্রস্তর ফলকেরই পরবর্তী সংস্করণ বলা যায়।

‘নব্যপ্রস্তরযুগের বিপ্লব’ সংক্রান্ত বিতর্ক:

নব্যপ্রস্তরযুগে মানবগোষ্ঠীর জীবনধারার অভাবনীয় পরিবর্তন, অগ্রগতি, সমাজবদ্ধতা ইত্যাদির প্রেক্ষিতে গর্ডন চাইল্ড একে ‘নবাশ্মীয় বিপ্লব’ (Neolithic Revolution) আখ্যা দিয়েছেন। পরবর্তীকালে কেউ কেউ ‘বিপ্লব’ শব্দটির প্রয়োগের যৌক্তিকতা বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সাধারণভাবে ‘বিপ্লব’ বলতে বোঝায় অল্পসময়ে এবং প্রায় আকস্মিক বিশাল কোন পরিবর্তন। কিন্তু নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির পরিবর্তন অপ্রত্যাশিত বা আকস্মিক ছিল না। আদিম মানবগোষ্ঠী তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রাচীন প্রস্তরযুগ থেকে মধ্যপ্রস্তরযুগে তাদের জীবনধারার যে ক্রম রূপান্তর ঘটিয়েছিল, সেই ধারার তৃতীয় ধারাটি ছিল নব্যপ্রস্তরযুগ। তাছাড়া এই পরিবর্তন আকস্মিক ঘটেনি। মেহেরগড় প্রত্নক্ষেত্রের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রায় ৩০০০ বছর ধরে ধাপে ধাপে পরিবর্তনগুলি এসেছিল। তাই একে ‘বিপ্লব’ না বলে ‘বিবর্তন’ বলাই যুক্তিযুক্ত বলে অনেকে মনে করেন।

বস্তুত নব্যপ্রস্তরযুগে যে সকল পরিবর্তন বা অগ্রগতি ঘটে, সেগুলি পূর্ববর্তী যুগের পরিবর্তনের তুলনায় অনেক বেশী গতিশীল ও মৌলিক। অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিল্পভাবনা— প্রতিটি ক্ষেত্রেই “এইসময় আমুল পরিবর্তন ঘটেছিল। খাদ্য সংগ্রাহক ও পরিযায়ী মানুষ এই যুগে খাদ্য-উৎপাদক পর্বে প্রবেশ করে এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রস্তুতি শুরু করে। পরিণামে গ্রাম-সমাজ গড়ে ওঠার সূচনা ঘটে। আবার উৎবৃত্ত উৎপাদনের সূত্রে সামাজিক বৈষম্য, বিভেদ ও শোষণ প্রবণতার জন্ম হয়। এ-সকল পরিবর্তন নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। তাছাড়া পূর্ববর্তী পুরাপ্রস্তর ও মধ্যপ্রস্তরযুগে পরিবর্তনের বিচারে নব্যপ্রস্তরযুগের পরিবর্তনের গতিশীলতা অনেক বেশী। পূর্ববর্তী মধ্যপ্রস্তর সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ছিল ছোট ছোট পাথরের হাতিয়ার। এর বিকাশ ঘটেছিল প্রায় ২৫০০০ বছর ধরে। কিন্তু নব্যপ্রস্তরযুগের পরিবর্তনগুলি প্রায় চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে মধ্যাশ্মীয় যুগের ১/৮ ভাগ সময়ে। স্বভাবতই নবপ্রস্তরযুগে এত অল্প সময়কালে এত ব্যাপক, উন্নত ও সুদূরপ্রসারী আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনগুলির গুরুত্ব বোঝাতে গর্ডন চাইল্ড যথার্থভাবেই ‘বিপ্লব’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।