তুর্কিজাতির উত্থান:
ভারতের বিরুদ্ধে আরবদের সামরিক অভিযানের ব্যাপ্তি ছিল সীমিত এবং স্থায়িত্ব ছিল স্বল্প। পশ্চিম সীমান্তের সিন্ধু ও মুলতান ছাড়া অন্য কোনো অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত হয়নি। কিন্তু আরবদের দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে তুর্কিরা ভারতের বিরুদ্ধে বিশাল ও ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে। ভারতে মুসলমান সাম্রাজ্য স্থাপনের কৃতিত্ব তুর্কিদেরই এবং এই কাজের সূচনা করেন আফগানিস্তানের অন্তর্গত গজনির তুর্কি সুলতানগণ। আদপে অ-মুসলমান তুর্কি উপজাতির দ্রুত উত্থান এবং মুসলমান রাজনীতির নিয়ন্ত্রকে পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল নবম-দশম শতকে মুসলমান জগতের অন্তর্বিরোধজনিত বিভেদ ও দুর্বলতা এবং জাতিগোষ্ঠী হিসেবে তুর্কি উপজাতির শক্তি, সাহস এবং কর্মোদ্যোগ।
তুর্কি উপজাতির আদি বাসস্থান ছিল আনাতোলিয়ার (মধ্যপ্রাচ্য) জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চল। এরা ছিল প্রকৃতির উপাসক এবং মুসলমানদের চোখে ধর্মহীন অসভ্য ও বর্বর। তুলনামূলকভাবে খর্বাকৃতি তুর্কিদের শারীরিক গঠন ছিল বলিষ্ঠ এবং যোদ্ধা হিসেবে ছিল দুর্ধর্ষ। এদের অর্থলোভ ছিল প্রবল এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল সীমাহীন। ওমাইয়া এবং আব্বাসিদ খলিফাবংশের বিরোধের সুযোগে এরা মুসলমান রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসতে সক্ষম হয়। আব্বাসিদ খলিফারা আরবদের সর্বময় প্রাধান্য হ্রাস করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদে আরবদের সাথে সাথে অ-আরবদের নিয়োগে গুরুত্ব দেন। খ্রিস্টীয় নবম শতকে আব্বাসীদ সাম্রাজ্যের মধ্যে প্রবেশ করে বহু তুর্কি ইসলামধর্ম গ্রহণ করে এবং প্রাসাদরক্ষী ও সৈনিকের বৃত্তি গ্রহণ করে। ক্রমে দক্ষ যোদ্ধা, সাহসী এবং কর্মঠ তুর্কিরা পারসিকদের পেছনে ঠেলে দিয়ে মুসলমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পদ কব্জা করে নেয়। শীঘ্রই তারা এত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে যে, রাজপদে মনোনয়ন তাদের ইচ্ছাধীনে পরিণত হয়। এদিকে খলিফার কর্তৃত্ব দুর্বল হবার সুযোগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বহু তুর্কি-নেতা স্বাধীন আঞ্চলিক রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। নিরুপায় খলিফা এই সকল দক্ষ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতাকে নিয়মমাফিক ‘আমির-উল-উমারা’অর্থাৎ খলিফার প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে নিজের মুখরক্ষা করেন। আপাতদৃষ্টিতে খলিফার প্রতিনিধি এই সকল শাসক আসলে স্বাধীন সুলতান রূপেই ক্ষমতা ভোগ করতে থাকেন। অধ্যাপক মহম্মদ হাবিব তুর্কিজাতির সমরদক্ষতা ও রাজকীয় গুণাবলিকে হিন্দুসমাজের ক্ষত্রিয়দের সাথে তুলনা করে বলেছেন যে, ক্ষত্রিয়দের মতো তুর্কিদের প্রধান বৃত্তি ছিল যুদ্ধ এবং রাজ্যশাসন। একসময় তুর্কি উপজাতি ছিল মুসলমানের শত্রু। কিন্তু ক্রমে বহু তুর্কি ইসলামধর্ম গ্রহণ করে ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক ও নির্ভরযোগ্য রক্ষকে পরিণত হয়। দশম শতকের পরবর্তীকালে মুসলমান সমাজে এই ধারণা দৃঢ়মূল হয়েছিল যে, মুসলমান সাম্রাজ্যের প্রসার ও স্থায়িত্ব তুর্কিদের সহায়তা ছাড়া অসম্ভব। অবশ্য অ-মুসলমান তুর্কিদের সাথে লড়াই করে ইসলামকে রক্ষা করার কাজে যেমন নিবেদিতপ্রাণ ছিল মুসলিম তুর্কিরা, তেমনি ইসলাম গ্রহণ করলেও আদি লুণ্ঠন-প্রবৃত্তিকে তারা সহজে ত্যাগ করতেও পারেনি। দুই কাজেই তারা দক্ষতা দেখাতে থাকে।
ভারতের বিরুদ্ধে তুর্কি মুসলমানদের অভিযান শুরু হয়েছিল গজনি রাজ্যকে কেন্দ্র করে। সামানিদ রাজ্যের জনৈক তুর্কি ক্রীতদাস আলপ্তগীন স্বাধীন গজনি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। নবম শতকের শেষভাগে ট্রান্স-অক্সিয়ানা (বোখারা সমরখন্দ প্রভৃতি অঞ্চল), খোরাসান এবং ইরানের কিছু অংশে সামানিদ-বংশ রাজত্ব করত। সামানিদরা ছিল পারসিক (ইরানি) মুসলমান। তুর্কি উপজাতির সাথে সামানিদরা দীর্ঘদিন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করেছিল। এই লড়াইতে গাজি নামক এক নতুন যোদ্ধা সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল, যারা ধর্মপ্রচারক হিসেবে কাজ করত, আবার ধর্মরক্ষার প্রয়োজনে আপ্রাণ যুদ্ধও করত। একথা সত্য যে, ‘গাজি’দের ত্যাগ ও দৃঢ়তা ছাড়া তুর্কিদের আক্রমণ থেকে শিশু মুসলিম রাজ্যকে রক্ষা করা সম্ভব হত না। ক্রমে বহু তুর্কি ইসলামধর্ম গ্রহণ করে ইসলামের রক্ষকে পরিণত হয়। যাই হোক্, সামানিদ রাজ্যের তুর্কি মুসলমান কর্মচারী আলপ্তগীন খোরাসানের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। দশম শতকের মাঝামাঝি আলপ্তগীন আফগানিস্তানের অন্তর্গত গজনিতে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
আলপ্তগীনের জনৈক বংশধর পিরাই ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত হিন্দুশাহি রাজ্যের বিরুদ্ধে তুর্কি অভিযানের মাধ্যমে ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। মুসলিম আক্রমণের প্রাক্কালে হিন্দুশাসিত এই রাজ্যের সীমানা উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বত, দক্ষিণে গোমতী নদীর উভয় তীরে, পূর্বে লামঘান, পেশোয়ার, জালালাবাদ, উন্দ, উত্তর-পূর্বে কাশ্মীর এবং পশ্চিমে পারস্য সাম্রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। চৈনিক ধর্মপর্যটক হিউয়েন সাঙ উল্লেখ করেছেন যে, সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে হিন্দুশাহি কাবুল রাজ্যে দক্ষ রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল। একসময় বর্তমান আফগানিস্তানের সম্পূর্ণটাই হিন্দুশাহি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভৌগোলিক অবস্থিতির কারণে মুসলমানদের আক্রমণের প্রথম ঢেউ এই রাজ্যের ওপর বারবার আছড়ে পড়েছে। আরবদের আক্রমণ দীর্ঘ তিন শতক ধরে এরা প্রতিহত করে গেছে। স্বভাবতই গজনির তুর্কি শাসকেরা উপলব্ধি করেন যে, হিন্দুশাহি রাজ্যকে ধ্বংস করতে না পারলে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাবে না। পরবর্তী শাসক সবুক্তগীনও (৯৭৭-৯৯৭ খ্রিঃ) পিরাই-প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হন এবং গজনির নিকটতর শত্রু শাহিরাজ্যের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি আক্রমণ চালান।
সবুক্তগীন ছিলেন দক্ষ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসক। তাই মধ্য-এশীয় রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকলেও পাঞ্জাবের শাহিরাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রস্তুতিতে তিনি অমনোযোগী হননি। এদিকে শাহিরাজা জয়পালও তুর্কিদের কাছ থেকে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই প্রথমেই আক্রমণ করে শত্রুকে ঘায়েল করার সিদ্ধান্ত তিনি নেন (৯৮৬-৮৭ খ্রিঃ)। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করলেও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে জয়পাল অপমানজনক এক সন্ধি স্বাক্ষর করে রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন। কিন্তু স্বরাজ্যে ফিরে এসে তিনি সন্ধির শর্ত মানতে অস্বীকার করেন। শর্তভঙ্গের অজুহাতে সবুক্তগীন শাহিরাজ্য আক্রমণ করে লামঘান বিধ্বস্ত করেন। এই সময়ে দিল্লি, আজমির, কনৌজ-সহ কয়েকটি ভারতীয় রাজ্য জয়পালের সাহায্যে তাঁর সাথে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ধর্ষ তুর্কিদের কাছে তারা পরাজিত হয়। লামঘান ও পেশোয়ার গজনির অন্তর্ভুক্ত হয়। এর অল্পকাল পরে সবুক্তগীনের মৃত্যু ঘটে (৯৯৭ খ্রিঃ)। এই সময় সবুক্তগীনের দুই পুত্র ইসমাইল ও মামুদ-এর মধ্যে সিংহাসনকে কেন্দ্র করে ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের সূচনা হয়। শেষ পর্যন্ত মামুদ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ইসমাইলকে পরাজিত ও বন্দি করে গজনির সিংহাসন দখল করেন (৯৯৮ খ্রিঃ)।
Leave a comment