ভারতে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প একটি বৃহৎ শিল্প এবং এই শিল্প উৎপাদন, বাণিজ্য ও উন্নয়নের বিচারে দেশের অন্যান্য শিল্পগুলির মধ্যে পঞ্চমস্থান অধিকার করেছে। কাঁচামালের সহজলভ্যতা, পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রা এবং সরকারি উদারনীতি ভারতে এই শিল্পের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে। বর্তমানে ভারতের মােট GDP-র প্রায় 7% স্থান দখল করে আছে এই শিল্প। উদীয়মান শিল্প হওয়া সত্ত্বেও ভারতে এই শিল্প দ্রুত উন্নতি লাভ করেছে। এই উন্নয়নের কারণগুলি হল—

বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষি জলবায়ুর অবস্থান : ভারতে বৈচিত্র্যপূর্ণ জলবায়ু অঞ্চল অবস্থান করায়, এখানে বিভিন্ন ধরনের কৃষি-জলবায়ু অঞ্চল দেখা যায়। ফলে ভারতে নানাধরনের খাদ্যশস্য, তৈলবীজ, ফল ও সবজি, মশলা উৎপাদন এবং বিপুল পরিমাণে পশুপালন করা হয়ে থাকে। যা ভারতকে বিশ্বে এক অন্যতম খাদ্য উৎপাদক দেশে পরিণত করেছে। ফলে ভারতে খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের জন্য বিপুল পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল সহজেই পাওয়া যায়।

উন্নতমানের প্রযুক্তি ও গবেষণার সুযোগ : সবুজ বিপ্লবের পরে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তির উপর্যুপরি ব্যবহার ঘটিয়ে ভারতে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণের বৃদ্ধি ঘটানাে হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকার কৃষিজ ফসল ও প্রাণীজ দ্রব্যকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে আরও আকর্ষণীয় ও বাজারজাত করে তােলা হচ্ছে, যা বিশ্বের বাজারে বিশ্বের উন্নত দেশগুলির উৎপাদিত দ্রব্যের সঙ্গে সমানভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করছে।

দেশীয় বাজারের বিপুল চাহিদা : ভারতের প্রায় 121 কোটি জনসংখ্যা বর্তমানে নানাভাবে এই প্রক্রিয়াকৃত খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল। ফলে দেশের অভ্যন্তরেই এই শিল্পের এক বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের ক্রেতার মধ্যে প্রায় 30 কোটি হল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত। 2010-এর মধ্যে প্রায় 20 কোটি জনসংখ্যা এই শিল্পজাত দ্রব্য ক্রয়ে ক্রমশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

অত্যন্ত উন্নত পরিকাঠামাে ও বণ্টন ব্যবস্থা : এই শিল্পের কাঁচামাল ও শিল্প থেকে উৎপাদিত দ্রব্যগুলি যেহেতু অধিকাংশই পচনশীল, তাই এই শিল্প গড়ে তােলার ক্ষেত্রে পরিকাঠামাে ও বণ্টন ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নতমানের হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বলা যায়, ভারতে এই শিল্প গড়ে তােলার জন্য উপযুক্ত ও উন্নত পরিকাঠামাে ব্যবস্থা সহজেই পাওয়া যায়। বিভিন্ন জলপথ, স্থলপথ ও বিমানপথের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রুত পাঠানাের ব্যবস্থা করা হয়।

ভৌগােলিক অবস্থান : ভারতের তিন দিকে জল থাকায় এবং ভারত দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় মধ্যে স্থানে অবস্থান করায় জলপথ ও বিমানপথে আন্তর্জাতিক যােগাযােগ ব্যবস্থার মাধ্যমে ইউরােপ, দূরপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম এশীয় দেশগুলির বাজারে এই শিল্পে উৎপাদিত দ্রব্য খুব সহজেই পৌঁছায়।

অন্যান্য কারণ : উপরােক্ত কারণগুলি ছাড়াও অন্য যেসমস্ত কারণ খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের দ্রুত উন্নতি এনে দিয়েছে সেগুলি হল—দ্রুত নগরায়ণ, বৃদ্ধিশীল সাক্ষরতা, পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রা, নারীকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি প্রভৃতি।

ভারতের অর্থনীতির দুটি প্রধান স্তম্ভ হল কৃষি ও শিল্প খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প এই দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে সংযােগসাধন করে থাকে। ভারতের মতাে কৃষিপ্রধান ও প্রায় 121 কোটি জনসংখ্যার দেশে খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। ভারতের সব উদীয়মান শিল্পের মধ্যে একমাত্রই ক্ষেত্রটির দ্বারাই কসঙ্গে ভারতের অর্থনীতি, কৃষিক্ষেত্র ও কর্মসংস্থানের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়েছে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মানের বিবিধ পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। ভারতের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটেই শিল্পের গুরুত্ব বিস্তারিত আলােচনা করা হল一

  • বিভিন্ন কৃষিজাত ও প্রাণীজাত দ্রব্যগুলিকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করা হয়। তাই খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নতি ভারতের মতাে দেশে কৃষি ও শিল্পের সমন্বয়কে আরও জোরালাে করে।

  • খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের মূল ভিত্তি হল কৃষিজ দ্রব্য। তাই এই শিল্পের উন্নতির সঙ্গে ভারতের কৃষিজ দ্রব্যের চাহিদা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এই শিল্পের উন্নতি ভারতের বাণিজ্যিক কৃষির উন্নতিকেও ত্বরান্বিত করে।

  • খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের প্রসার ও উন্নতি যত বেশি হবে কৃষির উৎপাদনের সঙ্গে কৃষকদের আয়ও তত বৃদ্ধি পাবে এবং তার সঙ্গে কৃষি ও শিল্পে কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাবে। ফলে ভারতের মতাে উন্নয়নশীল দেশের মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রার মান সামগ্রিকভাবে উন্নত হবে। বর্তমানে ভারতের প্রায় 16 কোটি শ্রমিক এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছে, যা ভারতের সমগ্র শিল্পক্ষেত্রে নিযুক্ত শ্রমিকের প্রায় 16.3%। বর্তমানে এই শিল্প থেকে দেশের মােট আয় হয় প্রায় 144000 কোটি টাকা।

  • বর্তমানে ভারতে নেস্টলে, মাদার ডেয়ারি, আই. টি. সি প্রভৃতি কোম্পানিগুলি খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করছে। যার ফলে এই শিল্পে বহির্বাণিজ্য ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ভারত নেপাল, ভুটান,পাকিস্তান, মায়ানমার-সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশ ও জাপান, ইংল্যান্ড, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সহ বেশ কিছু উন্নত দেশে প্রক্রিয়াকৃত খাদ্য রপ্তানি করছে।

  • আধুনিক সময়ে ভারতের মতাে দেশগুলিতে কর্মের প্রসার যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি কর্মক্ষেত্রে প্রতিযােগিতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই মানুষের হাতে সময়ের যথেষ্ট অভাব ঘটেছে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্যের ব্যবহারের ফলে মানুষের বিশেষত শহরের জনসংখ্যার সময়ের অপচয় অনেক হ্রাস পায় ও মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয়ে ওঠে।

  • আধুনিক ভারতে জনগণের জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন, মাথাপিছু ও বাণিজ্যিক আয় বৃদ্ধি এবং পরিকাঠামাের উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের যেভাবে দ্রুত প্রসার ও চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের জাতীয় আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে।