ভূমিকা: ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস যাঁর নামটি এক বিশাল জ্যোতিষ্কের মতাে চিরদিন ভাস্বর হয়ে থাকবে তিনি হলেন সুভাষচন্দ্র বসু। দুঃসাধ্যের সাধক, দুর্গম পথের নির্ভীক এই যাত্রীকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাদ করে বলেছিলেন— “সুভাষচন্দ্র, বাঙালি কবি আমি, বাংলা দেশের হয়ে তােমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি।”

[1] রাজনীতিতে অংশগ্রহণ: ছাত্রজীবন থেকেই সুভাষচন্দ্র ইংরেজ শাসনবিরােধী এক তীব্র মনােভাব পােষণ করতেন। তাই তিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের লােভনীয় চাকরিকে প্রত্যাখ্যান করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুপ্রেরণায় তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। কংগ্রেসের মধ্যে যে বামপন্থী চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটে তাতে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে তিনিও নেতৃত্ব দেন।

[2] গান্ধিজির সঙ্গে মতবিরােধ: ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা‌ কংগ্রেসে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। সুভাষচন্দ্রের সংগ্রামী দৃষ্টিভঙ্গি গান্ধিজি ও তাঁর অনুগামীদের ক্ষুদ্ধ করে। গান্ধিজি ত্রিপুরি কংগ্রেসে (১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ) সভাপতি হিসেবে পট্টভি সীতারামাইয়ার নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্র পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন। এতে গান্ধিজি ও তার সমর্থকরা সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কোনােরকম সহযােগিতা না করার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে বাধ্য হয়ে সুভাষচন্দ্র সভাপতির পদ ত্যাগ করেন। জাতীয় আন্দোলনকে গতিশীল ও সংগ্রামমুখী করে তুলতে তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি নতুন দল গঠন করেন (২২ জুন, ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ)। পরিণতি হিসেবে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন।

[3] ভারত ত্যাগ: ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সুভাষের যুদ্ধবিরােধী মনােভাবে উদবিগ্ন হয়ে ব্রিটিশ তাকে ভারত রক্ষা আইন-এ গ্রেফতার করে (২ জুলাই, ১৯৪০ খ্রি.)। মুক্তির দাবিতে সুভাষ কারাগারের মধ্যেই আমৃত্যু অনশন করেন। স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে পুলিশ তাকে স্বগৃহে অন্তরিন করে রাখে (৫ ডিসেম্বর, ১৯৪০ খ্রি.)। কিন্তু ব্রিটিশের কড়া প্রহরা এড়িয়ে, জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে সুভাষ দেশত্যাগ করেন (১৭ জানুয়ারি, ১৯৪১ খ্রি.)।

[4] জার্মানিতে কার্যকলাপ: দিল্লি থেকে সুভাষ পৌঁছলেন আফগানিস্তানের কাবুলে। কাবুল থেকে তিনি রাশিয়ায় যান ভারতবাসীর স্বাধীনতালাভে রুশ সাহায্যের লক্ষ্যে। কিন্তু রুশ রাষ্ট্রপ্রধান স্টালিন এসময় রাশিয়ার ওপর জার্মানির সম্ভাব্য আক্রমণের পরিস্থিতিতে ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা আশা করেছিলেন। তাই সাহায্যের কোনাে আশ্বাস না পেয়ে তিনি বিমানযােগে জার্মানির বার্লিনে চলে আসেন (২৮ মার্চ, ১৯৪১ খ্রি.)। বার্লিনে সুভাষ জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপের সঙ্গে দেখা করেন এবং জার্মানির সহযােগিতায় ব্রিটিশবিরােধী প্রচার ও বন্দি ৪০০ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে একটি মুক্তি সেনা গঠনের প্রয়াস চালাতে থাকেন। জার্মানির বিদেশ দপ্তরের তথ্যকেন্দ্রের সহায়তায় সুভাষচন্দ্র গঠন করেন ওয়ার্কিং গ্রুপ ইন্ডিয়া, যা পরে ‘স্পেশাল ইন্ডিয়া ডিপার্টমেন্ট’-এ রূপান্তরিত হয়। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে সুভাষচন্দ্র বার্লিনে গিরিজা মুখার্জি, এম. আর. ব্যাস, এ. সি. এন. নাম্বিয়ার-সহ ২০ জন ভারতীয়কে নিয়ে গঠন করেন ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’। এর মুখপত্র হয় ইংরেজি ও হিন্দি দ্বিভাষিক পত্রিকা ‘আজাদ হিন্দ’। জার্মানির হাতে বন্দি ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে সুভাষ ‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’ বা ‘ফ্রি ইন্ডিয়া আর্মি’ নামে এক সেনাদল গঠন করেন (ডিসেম্বর, ১৯৪২ খ্রি.)। এটাই ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের প্রথম পরিকল্পনা। ‘উল্লম্ফনকারী ব্যাঘ্র’ ছিল সেনাবাহিনীর প্রতীক। এই সেনাদল, সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেম ও বিপ্লবী আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সর্বপ্রথম তাঁকে নেতাজি অভিধায় ভূষিত করে এবং ‘জয়হিন্দ’ ধ্বনি দিয়ে অভিবাদন জানায়। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে গতিশীল করে তােলার উদ্দেশ্যে তিনি ‘আজাদ হিন্দ রেডিয়াে’, ‘ন্যাশনাল কংগ্রেস রেডিয়াে’‘আজাদ মুসলিম রেডিয়াে’ নামে তিনটি গােপন প্রচার কেন্দ্র থেকে ফারসি, ইংরেজি, হিন্দি, গুজরাতি, বাংলা ভাষাতে নিয়মিত প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন।

[5] জাপানি সরকারের প্রতিশ্রুতি আদায়: এদিকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে জার্মানির হঠাৎ রাশিয়া আক্রমণ এবং ওই বছর ৭ ডিসেম্বর ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে জাপানের যুদ্ধ ঘােষণায় বিশ্বযুদ্ধের পট পরিবর্তন ঘটে। সুভাষচন্দ্র উপলদ্ধি করেন যে ভারতের মুক্তি প্রচেষ্টায় জাপানি সহযােগিতাই অধিকতর কার্যকারী হবে। ঠিক এই সময় জাপান-প্রবাসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সুভাষচন্দ্র ৩ মাসের অধিক সময় ধরে এক দুঃসাহসিক সাবমেরিন অভিযান শেষে টোকিও উপস্থিত হন (১৩ জুন, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ)। ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে সুভাষচন্দ্র পরপর দুবার জাপানি প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তােজো (Hideki Tojo)-র সঙ্গে দেখা করেন। জাপানের আইনসভা ডায়েট (Diet)-এ সুভাষচন্দ্রের উপস্থিতিতে তােজো ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য জাপানের তরফে সুভাষকে নিঃশর্ত সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে জাপানি সরকারের সর্বতােভাবে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে যান।

[6] আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা: সিঙ্গাপুরে ৪ জুলাই রাসবিহারী সুভাষচন্দ্রের হাতে তার প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ বা ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। পরে ২৫ আগস্ট নেতাজি আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর সর্বাধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন এবং ২১ অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকার নামে অস্থায়ী ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আজাদ হিন্দ সরকার ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে।

[7] দিল্লি অভিযান: ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ৪ জানুয়ারি নেতাজি রেঙ্গুনে এসে তার সামরিক দপ্তর স্থাপন করেন। ইতিমধ্যে আজাদ হিন্দ ফৌজ পাঁচটি ব্রিগেডে বিভক্ত হয়ে যায়, যথা—গান্ধি ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড, নেহরু ব্রিগেড, সুভাষ ব্রিগেড, ঝাসির রানি ব্রিগেড। সুভাষচন্দ্র সেনাদলের সামনে ধ্বনি দেন ‘দিল্লি চলাে’। জাপানি নেতৃবৃন্দের সহযােগিতায়, নেতাজির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এবং উজ্জীবনী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ চালায়। তারা মণিপুরের কোহিমা শহরটি দখল করে (৬ এপ্রিল, ১৯৪৪ খ্রি.) জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এবং রাজধানী ইম্ফল দখলের জন্য অগ্রসর হয়। শেষ পর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধে জাপান তথা অক্ষশক্তির পরাজয় আসন্ন হয়ে পড়লে আজাদ হিন্দ সেনাদল দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছােতে ব্যর্থ হয়।

মূল্যায়ন: সুভাষচন্দ্র ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম তাৎক্ষণিক বিচারে ভারতকে স্বাধীন করতে পারেনি সত্য, কিন্তু তার পরিকল্পনা, দেশপ্রেম, আদর্শ ও আত্মত্যাগ স্বাধীনতা অর্জনের পথকে যে প্রশস্ত ও সুগম করেছিল এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই।