ভূমিকা: আজাদ হিন্দ সেনারা দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছােতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবদান ভারতের ইতিহাসের পাতায় চিরকাল সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।

[1] সুভাষচন্দ্রের দেশত্যাগ: ভারত রক্ষা আইনে গ্রেফতার করে (১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই) পরে সুভাষচন্দ্রকে কলকাতার এলগিন রােডে তার নিজের ঘরে অন্তরিন রাখা হয় (১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ৫ ডিসেম্বর)। ব্রিটিশের কড়া প্রহরা এড়িয়ে মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে সুভাষচন্দ্র দেশত্যাগের জন্য বেরিয়ে পড়েন।

[2] বিদেশের সাহায্যলাভের প্রচেষ্টা

  • রাশিয়ায়: সুভাষচন্দ্র সিনর অরল্যান্ডাে ম্যাৎসােটা ছদ্মনাম নিয়ে কাবুল থেকে বার্লিন যাওয়ার পথে মস্কোতে কিছুদিন অবস্থান করেন। মস্কোয় তিনি রুশ নেতাদের কাছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু রুশ রাষ্ট্রপ্রধান স্টালিনের কাছ থেকে কোনােরকম সহযােগিতার আশ্বাস পাননি।

  • জার্মানিতে: সুভাষচন্দ্র এরপর বিমানযােগে জার্মানির বার্লিনে এসে পৌছােন (১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ)। বার্লিনে তিনি গিরিজা মুখার্জি, এম.আর. ব্যাস ও এ. সি. এন. নাম্বিয়ার-সহ ২০ জন ভারতীয়কে নিয়ে গড়ে তােলেন ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’। পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইউরােপ ও উত্তর আফ্রিকায় ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে গঠন করেন ‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’ বা ‘ফ্রি ইন্ডিয়া আর্মি’ (১৯৪২ খ্রি.)। সুভাষচন্দ্র হিটলারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ- এর সঙ্গে দেখা করেন ও ভারতীয় মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে এক পরিকল্পনা পেশ করেন। জার্মান সরকার সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পনার অন্যান্য শর্তগুলি মেনে নিলেও ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয়ে কোনাে প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি হয়নি।

    • অনুপ্রবেশ: সুভাষচন্দ্র জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুঃসাহসিক সাবমেরিন অভিযানে প্রায় কয়েক হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে জাপানের টোকিও-তে এসে পৌছােন (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন)। সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী তােজোর সঙ্গে দেখা করলে জাপানি পার্লামেন্ট ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সর্বতােভাবে সহায়তাদানের নীতি ঘােষণা করে। শুরু হয় সুভাষের স্বপ্নের অভিযান।

    • আই. এন. এ.-এর নেতৃত্ব গ্রহণ: ব্যাংকক শহরে এক সম্মেলনে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন) রাসবিহারীর সভাপতিত্বে গড়ে ওঠে ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ বা ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ। এরপর ক্যাপটেন মােহন সিং-এর সক্রিয় সহযােগিতায় ২৫ হাজার ভারতীয় সেনা (পরে বেড়ে হয় ৪০ হাজার) নিয়ে ভারতীয় জাতীয় বাহিনী (Indian National Army) বা আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয়। সুভাষচন্দ্র জাপানে এলে রাসবিহারি বসু সুভাষকে ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগের দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান। সুভাষচন্দ্র সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় রাসবিহারী বসুর হাত থেকে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট)।

    • আই. এন. এ.-এর পুনর্গঠন: আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর সুভাষচন্দ্র একে নতুন করে সাজিয়ে তােলেন। আজাদ হিন্দ বাহিনীকে তিনি গান্ধি ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড, নেহরু ব্রিগেড প্রভৃতি ব্রিগেডে ভাগ করেন। বালক, বালিকাদের নিয়ে বাল সেনাদল এবং নারীদের নিয়ে ঝাঁসির রানি ব্রিগেড গঠিত হয়। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত অনুগামীদের অনুরোধে নেতাজি নিজের নামে সুভাষ ব্রিগেড গঠন করেন।

[3] ভারত অভিযান: ২৩ অক্টোবর ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আজাদ হিন্দ সরকার ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। নেতাজি রেঙ্গুনে তাঁর প্রধান সামরিক দপ্তর গড়ে তােলেন ও শুরু করেন তার বহু কাঙ্ক্ষিত ভারত অভিযান। বীর আজাদ হিন্দ সেনারা তাইপােং থেকে যাত্রা শুরু করে পাহাড়, পর্বত নদী টপকে প্রায় ৪০০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে ভারত সীমান্তের দিকে পাড়ি দেন। কক্সবাজার থেকে ৫০ মাইল দুরে মৌডক নামক স্থানে ব্রিটিশ ঘাঁটি লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায় আজাদ হিন্দ সেনারা। ক্যাপটেন সুরজমলের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ সেনারা মৌডক জয় করে। অবশেষে কোহিমা পর্যন্ত এসে ভারতের মাটিতে তেরঙা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে (৬ এপ্রিল, ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ)।

[4] আত্মসমর্পণ: অবশেষে জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলে (আগস্ট, ১৯৪৫ খ্রি.) জাপানিদের দ্বারা অস্ত্র ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আজাদ হিন্দ সেনারা অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

মূল্যায়ন: নেতাজীর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনি চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ভারতবাসীর স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। তাই গান্ধিজি আজাদ হিন্দ বাহিনীর মূল্যায়নে বলেছিলেন—যদিও আজাদ হিন্দ ফৌজ তাদের আশু লক্ষ্যে পৌঁছােতে পারেনি, তবুও তারা এমন অনেক কিছু করেছে, যেজন্য তারা গর্ববােধ করতে পারে।