ভূমিকা: ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মহান সংকল্প নিয়ে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অখণ্ড বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে এবং রাজ্যগুলির সর্বোচ্চ স্তরে হাইকোর্ট গঠনের পরিকল্পনা সংবিধান রচয়িতা এবং সংবিধান-বিশেষজ্ঞরা অনুভব করেছিলেন। এমনকি ন্যায়বিচারকে আরও সুদৃঢ় করার জন্য এইসব আদালতের অধীনে গ্রামস্তর পর্যন্ত একাধিক অধস্তন আদালত গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন প্রত্যেক গ্রাম এলাকার মানুষের কাছে ন্যায়বিচার পৌছে দেওয়ার লক্ষ্যে। এ ছাড়া অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য লােক আদালত গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রেতারা কোনাে পরিসেবা কিনতে গিয়ে প্রতারিত না হন, তার জন্য ক্রেতা আদালতের মাধ্যমে বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিম্নে এই বিভিন্ন ধরনের আদালতের গঠন ও কার্যাবলী আলােচনা করা হল―

সুপ্রিম কোর্ট

ভারতের অখন্ড বিচার ব্যবস্থার আকারে অনেকটা পিরামিডের মতাে। যার সবচেয়ে উপরের আসনে অধিষ্ঠান করে ভারতের (দিল্লি) সুপ্রিম কোর্ট। ভারতের এই সুপ্রিম কোর্ট একদিকে সর্বোচ্চ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত অন্যদিকে দেশের সর্বোচ্চ আপিল আদালত হিসেবে পরিচিত। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের সর্বোচ্চ আদালতের চাইতে যথেষ্টশক্তিশালী। কৃয়স্বামী আয়ারের ভাষায়, পৃথিবীর যে-কোনাে অংশের সুপ্রিম কোর্টের তুলনায় ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা অধিকতর (“The Supreme Court in the Indian union has more powers than any Supreme Court in any part of the world.”)। সংবিধানের ১২৪ থেকে ১৪৭ নং ধারায় সুপ্রিম কোর্ট সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে। বর্তমানে ১ জন প্রধান বিচারপতি এবং ৩০ জন সহকারী বিচারপতি সমেত মােট ৩১ জন বিচারপতি নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট গঠিত হয়। বিচারপতিগণ ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকেন।

সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী: সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলিকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাক্রমে সেই ভাগগুলি হল一

  • মল এলাকা,
  • আপিল এলাকা,
  • পরামর্শদান এলাকা,
  • আদেশ, নির্দেশ বা লেখ জারি এলাকা।

হাইকোর্ট

ভারতের অঙ্গরাজ্যের বিচার বিভাগের শীর্ষে হাইকোর্ট অবস্থিত। সংবিধানের ২১৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের জন্য একটি করে হাইকোর্ট থাকবে (“There shall be a High Court for each state.”) এবং প্রয়োজনে পার্লামেন্ট ৩২১(১) নং ধারা অনুসারে দুই বা ততােধিক রাজ্যের জন্য একটি করে হাইকোর্ট স্থাপন করতে হবে। বর্তমান ভারতে ২৯টি অঙ্গরাজ্যের জন্য এবং ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য মােট ২১টি হাইকোর্ট গঠন করা হয়েছে। হাইকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা না থাকলেও এ কথা শুধুমাত্র উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১ জন প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য কয়েকজন বিচারপতি নিয়ে হাইকোর্ট গঠিত হবে। বিচারপতিগণ ৬২ বছর বয়স পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকেন।

কার্যক্ষেত্র বা এলাকা: হাইকোর্টের কার্যক্ষেত্র বা এলাকাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন—

  • মূল এলাকা,
  • আপিল এলাকা,
  • লেখ জারি এলাকা।

অধস্তন আদালত

ভারতের অখন্ড বিচার ব্যবস্থার সর্বনিম্ন আদালত গুলোকে আইনি পরিভাষায় অধস্তন আদালত বলা হয়। সমগ্র ভারতের জন্য যেমন সুপ্রিম কোর্ট, রাজ্যের জন্য যেমন হাইকোর্ট রয়েছে তেমনি জেলাগুলির বিচারের জন্য যে বিচারালয় রয়েছে, তাকে অধস্তন আদালত বলা হয়। জেলা আদালতের শীর্ষে থাকেন ডিস্ট্রিক্ট জজ এবং মহানগরের ক্ষেত্রে মহানগরীয় ম্যাজিস্ট্রেট।

অধস্তন আদালতের বিভাগসমূহ: হাইকোর্টের অধীন এই অধস্তন আদালতকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা—

  • (a) জেলা আদালত এবং
  • (b) মহানগরীয় আদালত।

জেলা আদালত গুলির আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয়, যথা—

  • (a) দেওয়ানি আদালত (Civil Courts) এবং
  • (b) ফৌজদারি আদালত (Criminal Courts)।

দেওয়ানি আদালতগুলি আবার চার ভাগে বিভক্ত—

  • (a) জেলা জজ বা বিচারকের আদালত,
  • (b) সাব-জজ আদালত বা অবর বিচারকের আদালত,
  • (c) মুন্সেফের আদালত,
  • (d) ন্যায় পঞ্চায়েত বা ক্ষুদ্র আদালত।

ফৌজদারি আদালত গুলি আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়—

  • (a) দায়রা আদালত,
  • (b) অবর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত,
  • (c) পঞ্চায়েত আদালত।

হাইকোর্টের পরামর্শে মাননীয় রাজ্যপাল অধস্তন আদালতের বিচারপতিদের নিয়ােগ, পদোন্নতি, বদলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। কোনাে ভারতীয় নাগরিক ৭ বছর আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং সেই ব্যক্তি হাইকোর্ট কর্তৃক মনােনীত হলে রাজ্যপাল অধস্তন আদালতের বিচারপতিদের নিয়ােগ করতে পারেন।

লােক আদালত

ভারতের বিচারব্যবস্থায় বিরােধ নিষ্পত্তির এক অভিনব বিকল্প রূপ (an innovative form of alternative Disputes Resolution) এবং সাম্প্রতিক সংযােজন হল লােক আদালত। ১৯৯৪ খ্রিস্টব্দে আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ আইনটি সংশােধিত হয় এবং এই সংশােধনী আইনের ১৯(১) নং ধারায় বলা হয় যে, কেন্দ্র, রাজ্য, জেলা ও তালুকে আইনগত পরিসেবা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে, আর এই কর্তৃপক্ষের হাতেই লােক আদালত গঠনের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। ১৯(২) নং ধারায় উল্লেখ করা আছে যে, একটি অঞ্চলের লোক আদালত একজন কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এবং তার মনােনীত কোনাে অধস্তন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা কোনাে ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে গঠিত হয়।

লোক আদালতের ক্ষমতা ও কার্যাবলী: বিচারব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষের কাছে অতি অল্প ব্যয়ে এবং স্বল্প সময়ে পৌছে দেওয়ার এক প্রগতিশীল পদক্ষেপ হল লােক আদালত। আসলে আদালতে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা কিংবা বিচার শুরুর পূর্বাবস্থায় কোনাে আদালত বা কর্তৃপক্ষ কিংবা কমিটি সংশ্লিষ্ট বিরোধ কে লোক আদালতের কাছে পাঠাতে পারে, তবে কোনাে একটি বিরােধে লিপ্ত উভয় পক্ষ যদি লোক আদালতের মাধ্যমে তাদের বিরােধ নিষ্পত্তি করে নিতে সম্মত হয়, তাহলেই কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট বিরোধ কে এরূপ আদালতের কাছে প্রেরণ করা যেতে পারে। এককথায়, যেসব মামলা জটিল প্রকৃতি সম্পন্ন নয়, সেই মামলা নিষ্পত্তি করা হল লোক আদালতের প্রধান কাজ।

ক্রেতা আদালত

কোনাে ক্রেতা যদি হাটবাজার, দোকান বা শপিং মল বা কোনাে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনাে জিনিস কিনে প্রতারিত হন তাহলে সেই উপভােক্তা আইনি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাহায্য পেতে পারেন। এই আইনি প্রতিষ্ঠানকেই ক্রেতা আদালত বলা হয়ে থাকে। এই ক্রেতা আদালতের ভিন্ন নামই হল ক্রেতা সুরক্ষা আদালত। ভারত সরকার প্রণীত ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ক্রেতা সুরক্ষা আইন অনুসারে (Consumer Protection Act, 1986) ক্রেতা সুরক্ষা আদালত গঠন করা হয়। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে এবং ২০০২ খ্রিস্টাব্দে ক্রেতা সুরক্ষা আইনের সংশােধিত ও সংযােজিত করা হয়েছে।

ক্রেতা আদালতের ক্ষমতা ও কার্যাবলি: ক্রেতা আদালতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ক্রেতার স্বার্থরক্ষা করা। এ ছাড়া ক্রেতাদের সকল প্রকার পণ্য ও পরিষেবা সঠিকভাবে সরবরাহ করা এই আদালতের অন্যতম কাজ বলে বিবেচিত হয়। দেওয়ানি, ফৌজদারি ও ভারতীয় দণ্ডবিধি প্রয়ােগের ক্ষমতাও ক্রেতা আদালত ভােগ করে থাকে।

উপরোস্ত এই আদালতগুলি ছাড়া ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় আরও অন্যান্য ধরনের আদালতসমূহ লক্ষ করা যায়, যথা শিল্প আদালত— যা শ্রমিক-মালিকদের বিরােধ নিষ্পত্তি করে থাকে। সামরিক আদালত এই আদালত সামরিক বাহিনীর জন্য গঠিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনিক আদালত যে আদালত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মচারীদের চাকরি সংক্রান্ত বিরােধের নিষ্পত্তি করে থাকে।