বর্তমানে বিভিন্ন কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলি ব্যক্তি বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর প্রতিনিয়ত হস্তক্ষেপ করে চলেছে। সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলি আজ অসহায় হয়ে পড়েছে। এই অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তি ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা থাকা একান্ত প্রয়ােজন।

হাইকোর্টের বিচারপতিরা যাতে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সেইজন্য সংবিধানে তাদের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য অধ্যাপক বেকন, গার্নার, ল্যাস্কি, অ্যালান বল প্রমুখ তাত্ত্বিকবৃন্দ কতকগুলি বিষয়ের সুপারিশ করেছেন। এইসকল সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল বিচারকের一

  • (1) সুষ্ঠু নিয়ােগ পদ্ধতি,
  • (2) সুনির্দিষ্ট যােগ্যতা,
  • (3) কার্যকালের স্থায়িত্ব,
  • (4) উপযুক্ত বেতন ও ভাতা,
  • (5) অপসারণের ব্যবস্থা,
  • (6) বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণ।

[1] সুষ্ঠু নিয়োগ পদ্ধতি: সাধারণত তিন ভাবে বিচারক নিয়োগ করা যায়―

  • জনগণ কর্তৃক বিচারক নিয়োগ: বিচারকগণ প্রত্যক্ষভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। অধ্যাপক ল্যাস্কি মনে করেন, জনগণ কর্তৃক বিচারক নিয়োগ হল ‘বিচারক নিয়ােগের সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি।
  • আইনসভা কর্তৃক বিচারক নিয়োগ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে আইনসভা কর্তৃক বিচারপতিদের নিযুক্ত করা হয়।
  • শাসন বিভাগ কর্তৃক বিচারক নিয়োগে: বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বিচারপতিরা শাসন বিভাগ কর্তৃক নিয়ােগপত্র পান। যাইহােক, বিচারপতি নিয়ােগের সুষ্ঠু নিয়ােগ পদ্ধতি না থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হতে পারে।

[2] সুনির্দিষ্ট বিচারকদের যােগ্যতা: বিচারকদের যোগ্যতা নির্দিষ্ট মাপকাঠির উপর তাদের স্বাধীনতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। যদিও ভারতের সংবিধানে বিচারকদের যােগ্যতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে—

  • বিচারককে অবশ্যই ভারতীয় নাগরিক হতে হবে,
  • ন্যায়বিচার প্রদানকারীর শিক্ষাগত যােগ্যতা, ৫ বছর বিচারপতি পদে কাজ করার অভিজ্ঞতা [১২৪ (৩)], ১০ বছর আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থীকে সংবিধানের ২২৪ (৩) নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতির মতে, একজন বিশিষ্ট আইনজীবী হতে হবে। সাহস, নির্ভীকতা ইত্যাদি গুণের অধিকারী হতে হবে,
  • কোনাে অযােগ্য ব্যক্তি বা রাজনৈতিক মদতপুষ্ট কোনো ব্যক্তি বিচারক পদে নিযুক্ত হতে পারবেন না। যদি তিনি নিযুক্ত হন তাহলে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ভূলুণ্ঠিত হতে পারে।

[3] কার্যকালের স্থায়িত্ব: কার্যকালের স্থায়িত্ব একটি অন্যতম শর্ত বলে বিবেচিত হয়। কারণ বিচারপতিবৃন্দ অল্প সময়ের জন্য নিয়ােগপত্র পেলে তারা নিজস্ব কাজে যথাযথভাবে মনােনিবেশ করতে পারেন না। এর ফলে বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে উৎকোচ গ্রহণ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা কিংবা সংবিধান অবমাননা প্রভৃতি বিষয়ে ইমপিচমেন্ট পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে বিচারপতিদের পদ থেকে অপসারিত করা হয়।

[4] উপযুক্ত বেতন ও ভাতা: বিচারপতিদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার উপর বিচারপতিদের স্বাধীনতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। জরুরি অবস্থা ছাড়া আর অন্য কোনাে সময় তাদের বেতন ও ভাতা হ্রাস করা যায় না। বেতন ও ভাতার বিষয়ে পার্লামেন্টের অনুমােদনের প্রয়ােজন থাকে না। তাই বিচারকদের জন্য সম্মানজনক বেতন ও ভাতা ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে প্রদান করা হয়।

[5] অপসারণের ব্যবস্থা: বিচারকদের অপসারণ পদ্ধতির উপরও বিচারপতিদের স্বাধীনতা নির্ভরশীল। বিচারক যদি সবসময় এই সংশয়ে থেকে কাজ করেন যে, তারা যে-কোনাে সময় পদচ্যুত হতে পারেন তাহলে তারা কখনােই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না। বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত নিয়মাবলিতে বলা হয়েছে যে, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অক্ষমতা ছাড়া অন্য কোনাে কারণে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের কোনাে বিচারপতিকে অপসারণ করা যায় না। ভারতের সংবিধানের ১২৪ (৪)নং ধারায় উভয় কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে উপস্থিত সদস্যদের ২/৩ অংশ সদস্য দ্বারা অপসারণ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করতে হয়, তারপর রাষ্ট্রপতি কোনাে বিচারপতিকে অপসারিত করতে পারেন।

[6] বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণ: সরকারের অন্যান্য বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে স্বতন্ত্র রাখার উপরও বিচারপতিদের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। ল্যাস্কির মতে, শাসনের হাতে বিচারের ভার অর্পিত হলে ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না। ভারতের সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে নির্দেশমূলক নীতিতে এই বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।

অন্যান্য রক্ষাকবচ: (a) বিচারপতিদের রায় পার্লামেন্টে এক্তিয়ার বহির্ভূত রাখা প্রয়ােজন, (b) অবসর গ্রহণের পর বিচারপতিদের কোনাে লাভজনক পদে থাকা চলবে না, (c) বিচারপতিদের স্বাধীনতা ও কাজকর্মের সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় কর্মচারী নিয়ােগের ক্ষমতা সংবিধানগতভাবে প্রধান বিচারপতির হাতে ন্যস্ত থাকবে।

সমালোচনা: উপরোক্ত সাংবিধানিক ব্যবস্থা উল্লেখ করে সংবিধানে বিচারপতিদের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে তার বিপরীত চিত্র আমাদের চোখে পড়ে一

  • নিয়ােগ প্রক্রিয়া লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ভারতে বিচারপতিরা শাসন বিভাগ দ্বারা নিয়ােজিত হন, ফলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়েও বিচারপতি পদে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি অ্যাডভােকেট জেনারেলের পদ উল্লেখ করা যায়।
  • বিচারপতিদের অপসারণের বিষয়টিও ত্রুটিমুক্ত নয়। কারণ অসদাচরণ বা সামর্থ্য বলতে কী বােঝায় তার ব্যাখ্যা কারাের কাছে পরিষ্কার নয়। ফলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্টে ইমপিচমেন্ট পদ্ধতি কার্যকরী করতে কোনাে সমস্যা থাকে না। এরূপ পরিস্থিতিতে বিচারপতিরা কতটা স্বাচ্ছন্দ্য ভােগ করে থাকেন, সে বিষয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ প্রকাশ পায়।
  • বিচারপতিদের নির্দিষ্ট বেতন ও ভাতার বিষয়টিও সমালােচকদের সমালােচনার ঊর্ধ্বে রাখতে পারেনি। কারণ উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা না থাকলে বিচারপতিরা উৎকোচ গ্রহণে উৎসাহিত হয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারেন। যদিও সাম্প্রতিককালে বিচারপতিদের বেতন ও ভাতা বৃদ্ধি অনেকাংশেই কমে গেছে।
  • এ ছাড়াও হাইকোর্টের বিচারপতিদের অন্য রাজ্যে বদলি করার ব্যবস্থা বিচারপতিদের স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে বিবেচিত হয়।

পরিশেষে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে কারাের কোনাে দ্বিমত নেই, তবে মাত্রাতিরিক্ত সামাজিক পারিবারিক ঐতিহ্য, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক চেতনা ও শ্রেণিচেতনা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। সর্বোপরি শাসকদলের আশীর্বাদমুক্ত হয়ে কীভাবে তারা ন্যায়বিচার সম্পন্ন করবেন সেই বিষয়টিও বিচারপতিদের কপালে চিন্তার ভাজ সৃষ্টি করে।