ভূমিকা: ভারতের আইনসভার নাম হল পার্লামেন্ট বা সংসদ। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা এবং নিম্নকক্ষ লোকসভা নিয়ে গঠিত। যেহেতু ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিকে গ্রহণ করা হয়েছে, এই কারণেই পার্লামেন্টের গুরুত্বও সর্বাধিক হয়ে উঠেছে। পার্লামেন্ট-শাসিত ব্যবস্থায় আইন প্রণয়নের পাশাপাশি দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ লক্ষ করা যায়। পার্লামেন্ট-শাসিত ব্যবস্থায় সরকার যতদিন পর্যন্ত পার্লামেন্টের বিশেষত নিম্নকক্ষের আস্থাভাজন থাকবে ততদিন পর্যন্ত সেই রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনা করে থাকে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ধাত্রীভূমি হল গ্রেট ব্রিটেন। ও গ্রেট ব্রিটেনে একমাত্র অলিখিত সংবিধান দেখা যায় এবং এখানকার সংবিধান-সংশােধন পদ্ধতিটি সুপরিবর্তনীয়। এই কারণেই ভারতের সংবিধানে ব্রিটিশ ব্যবস্থার অনুকরণে সংসদীয় ব্যবস্থার কাঠামাে গৃহীত হয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কি সার্বভৌম আইন প্রণয়ন ক্ষমতার অধিকারী প্রতিষ্ঠান বলা হয়, কারণ一

  • (a) ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে-কোনাে প্রকার আইন প্রণয়ন করতে পারে,
  • (b) পার্লামেন্ট যে-কোনাে আইন সংশােধন ও বাতিল উভয় কার্য করতে পারে,
  • (c) ব্রিটেনের বিচার বিভাগ পার্লামেন্টের আইন ব্যাখ্যা করতে পারে তাকে কোনােভাবেই বাতিল করতে সক্ষম হয় না।

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল ভারতে পার্লামেন্টের পরিবর্তে সংবিধানের সার্বভৌমিকতা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় পার্লামেন্ট কেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয় তা নিম্নে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা হলㅡ

[1] সুপ্রিম কোর্টের প্রাধান্য: আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারতের পার্লামেন্টের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত নয়। পার্লামেন্ট-প্রণীত আইন সংবিধান-নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে আদালত বিচারবিভাগীয় সমীক্ষার ক্ষমতা প্রয়ােগ করে অসাংবিধানিকতার দায়ে সংশ্লিষ্ট আইনকে অবৈধ ও বাতিল বলে ঘােষণা করতে পারে।

[2] সাংবিধানিক গণ্ডি: ব্রিটেনের পার্লামেন্টের মতাে ভারতীয় পার্লামেন্ট ইচ্ছামতাে যে-কোনাে সংবিধান সংশোধন করতে পারে না। ভারতের পার্লামেন্টের ক্ষমতা লিখিত সংবিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ হওয়ায় সংবিধানের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকে পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন করতে হয়। পার্লামেন্ট-সহ সরকারের অন্যসকল বিভাগের ক্ষমতা সংবিধান দ্বারা নির্দিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত। উল্লেখ্য যে, সংবিধান পার্লামেন্টকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামাের পরিবর্তন ও সংশােধনের ক্ষমতা প্রদান করেনি। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরল রাজ্য মামলায় ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট তার রায়ে উল্লেখ করে যে, সংবিধানের মৌল কাঠামাে (basic structure)-কে অপরিবর্তিত রেখে সংবিধানের যে-কোনাে অংশের পরিবর্তন করতে পারে। অবশ্য ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ৪২ তম সংবিধান-সংশােধনে পার্লামেন্টের হাতে প্রচুর ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু সুপ্রিমকোর্ট ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে মিনার্ভা মিলস মামলা ৪২ তম সংশােধনী আইনকে বাতিল করে সংবিধানের প্রাধান্য নিশ্চিত করেছে।

[3] সংবিধানের সর্বোচ্চ ক্ষমতা: ভারতে লিখিত সংবিধান দ্বারা স্পষ্ট ভাষায় পার্লামেন্টের ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতাে ভারতীয় পার্লামেন্ট অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী নয় বলেই সংবিধান-নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকেই ভারতীয় পার্লামেন্টের কাজ করতে হয়। ভারতীয় সংবিধানে পার্লামেন্টের পরিবর্তে সাংবিধানিক প্রাধান্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই কারণেই ভারতীয় সংবিধানের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের সংবিধান-প্রণেতারা সংবিধান রচনার সময় ব্রিটিশ মডেলকে অনুসরণ করলেও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে পার্লামেন্টের পরিবর্তে সংবিধানের সর্বোচ্চ ক্ষমতা বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কে গােপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য মামলায় বিচারপতি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে রায় প্রদানকালে উল্লেখ করেছিলেন, আইন প্রণয়নের ব্যাপারে ভারতীয় সংবিধান ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমিকতা নীতিকে গ্রহণ করেনি। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মডেল হিসেবে গণ্য করে সংবিধানের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা হয়েছে।

[4] যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন: ভারতের শাসনব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয়। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্র এবং রাজ্যের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে বন্টিত হয়েছে। কোনাে আইনসভায় এককভাবে আইন প্রণয়নের সকল ক্ষমতার অধিকারী নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার রীতি অনুসারে আইন সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্র, রাজ্য ও যুগ্ম এই তিনটি তালিকার মাধ্যমে বিভক্ত করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পার্লামেন্ট রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে না। তাই অনেকে ভারতের পার্লামেন্টের Non sovereign Law-making Body বলে। অভিহিত করার পক্ষপাতী।

[5] মন্ত্রিসভা বা ক্যাবিনেটের প্রাধান্য: তত্তগতভাৱে পার্লামেন্ট প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী হলেও বাস্তবে ক্যাবিনেট বা মন্ত্রীসভা ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থান করেছে। বলা যেতে পারে যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ক্যাবিনেট সার্বভৌমত্বে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন করে থাকে। সুতরাং ওই দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী ও শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রীবর্গ পার্লামেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। প্রকৃত প্রস্তাবে ভারতের পার্লামেন্ট হল দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। কিন্তু এই আইন প্রণয়নের প্রধান উদ্যোগ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাই গ্রহণ করে থাকে। মন্ত্রীরা যে বিল পার্লামেন্টে উত্থাপন করেন তাতে অসম্মতি জানানাের ক্ষমতা সরকারি দল বা জোটের সদস্যদের মধ্যে অনুপস্থিত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অনেকসময় পার্লামেন্টের ক্ষমতাসীন দল বা জোটের সদস্যদের লােকসভা ভেঙে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। বস্তুত, সংবিধানে পার্লামেন্টের হাতে সব ক্ষমতা প্রদত্ত হয়েছে বাস্তবে তা মন্ত্রীসভার ক্ষমতায় পর্যবসিত হয়েছে।

উপসংহার: ভারতীয় পার্লামেন্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতাে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। কারণ ভারতীয় পার্লামেন্টকে পুরােপুরি সংবিধানের তত্ত্বাবধানে থেকে আইন প্রণয়ন করতে হয়। এই কারণে ডি এন ব্যানার্জি এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, ভারতীয় পার্লামেন্ট এর সঙ্গে সার্বভৌম ও সার্বভৌম আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সকল দেশের শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অপ্রতিহত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি আইনসভার ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।